E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০

ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত রুখতে হবে

স্মরণসভায় নেতৃবৃন্দের আহ্বান


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মতাদর্শে নিজেদের প্রতিনিয়ত শানিত করেই সমাজ প্রগ‍‌তির লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে। রুখতে হবে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তিকে। রক্ষা করতে হবে দে‍‌শের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চরিত্রকে। তাই বিজেপি’র বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চাই কেন্দ্রীয় স্তরে এবং রাজ্যে রাজ্যে।

প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আয়োজিত কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র স্মরণসভায় একথা বলেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ।

এদিন কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র, রামচন্দ্র ডোম, পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, কমরেড মদন ঘোষের স্ত্রী সোমা ঘোষ, কমরেড মৃদুল দের স্ত্রী স্বপ্না দে, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআই রাজ্য সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ।

এরপর কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করা হয়।

সভায় প্রয়াত কমরেডদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র সঙ্গে আমার কয়েক দশক ধরে একসঙ্গে কাজ করার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। দু’জন কমরেডের সঙ্গেই পার্টির প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে আমার বিদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দুজনেই পার্টির আদর্শের প্রতি অবিচল নিবেদিত প্রাণ থেকেছেন। দু’জনেই ৬০-এর দশকে পার্টিতে যোগ দেন। দেশ ভাগের সময় থেকে খুব বেশি দিনের ব্যবধান ছিল না ষাটের দশকের। দেশভাগের সময় সবচেয়ে নিষ্ঠুর দাঙ্গা বাংলাতেই হয়েছে। এই দু’জন কমরেডের বেড়ে ওঠা সেই সময়।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার দিন গান্ধীজি লালকেল্লায় যান নি। তিনি নোয়াখালিতে দাঙ্গার বিরুদ্ধে অনশন করছিলেন। দেশে আজকেও অনুরূপ পরিস্থিতি। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলছেন, কর্ণাটকে বিজেপি জিতলে মুসলিমদের জন্য কোনো সংরক্ষণ থাকবে না। ইসলামোফোবিয়া ছড়ানো হচ্ছে। সর্বোচ্চ আদালতে সংরক্ষণ সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, নেতাদের সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলা উচিত নয়। কোনো সাংবিধানিক সংস্থাকেই মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করা হচ্ছে আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে অসহিষ্ণু ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ব রাষ্ট্রে পরিণত করবার জন্য। ১০০ বছর আগে এই লক্ষ্যেই গঠিত হয়েছিল আরএসএস। মোদির লক্ষ্য হলো ভারতকে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা।

সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রকে রক্ষা করতে গেলে বিজেপি’কে সরানোর জন্য বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজ্যগুলির রাজধানীতে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। মানুষের আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। বেরোজগারি মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে রাজ্যে রাজ্যে। বিজেপি’কে হারাতে প্রতিটি রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী সমঝোতা এবং জোট গড়ার রণকৌশল নিতে হবে। কেরালায় কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলেই ওখানে বিজেপি শূন্য। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী ভোট একজোট করতে হবে। তামিলনাড়ুতে বিজেপি বিরোধী জোট আছে ডিএমকে’র নেতৃত্বে, বিহারে মহাগাঁটবন্ধন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এটাই করতে হবে। লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনটি রাজ্য রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ সব জায়গায় বিধানসভা ভোটে বিজেপি’কে পরাস্ত করতে হবে।

তিনি বলেন, ষাটের দশকে বাংলাজুড়ে বামপন্থী আন্দোলনের বিস্তৃতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হতে দেয়নি। ৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দাঙ্গায় আক্রান্ত দিল্লির মানুষ পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর বামফ্রন্ট শাসিত রাজ্যে আশ্রয় নেবার জন্য পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তর একেজি ভবনে এসে আরজি জানিয়েছিলেন। ৪৭-এর নোয়াখালির দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলা থেকে ৯০ এর দশকে সম্প্রীতির দুর্গে পরিণত করার লড়াইয়ে কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র অবদান স্মরণীয়।

তিনি বলেন, আমাদের আশু লক্ষ্য হলো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। সেই লক্ষ্যে এগোনোর ক্ষেত্রে আমাদের আজকের কাজ হলো সাম্রাজ্যবাদের অনুজ অনুচর করপোরেট-সাম্প্রদায়িক মদতপুষ্ট এই বিজেপি-কে সরকার থেকে সরানো। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

প্রয়াত কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র স্মৃতিচারণ করে সভার সভাপতি প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু বলেন, নিয়মানুবর্তিতা কীভাবে বজায় রাখতে হয় তা এই উভয় কমরেডের জীবনচর্যা থেকে এই প্রজন্মের শিক্ষণীয়, অনুকরণীয়। আমৃত্যু তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির নিয়মাবলি মেনে চলেছেন যা বড়ো বিষয়। যারা শ্রেণিশোষণের অবসান চান, শ্রেণি সংগঠনকে সংগঠিত করার কাজ করেন দেশের জন্য সমাজের জন্য তাদের এই গুণগুলি থাকা দরকার, যা কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে রপ্ত করেছিলেন।

সূর্য মিশ্র বলেন, কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে’র সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। মন্ত্রী হিসেবে অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় গিয়ে আমার পঞ্চায়েতের এমন কিছু কাজ দেখার অভিজ্ঞতা হয় যা আগে ভাবতে পারতাম না। কমরেড মদন ঘোষ তখন ওই জেলার সভাধিপতি ছিলেন। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে শুধু পঞ্চায়েত নয়, সাক্ষরতা আন্দোলন সহ অন্যান্য সংগঠনগুলিকে একসঙ্গে নিয়ে তাদের কাজ করার যে পদ্ধতি তা আমার প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা হয়। কমরেড মৃদুল দে প্রচুর লিখতেন। সমসাময়িক বিষয়ে তাঁর লেখা থেকে কী করতে হবে তার অভিমুখ বুঝতে পারতাম।

এরপর নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ‘ইস্পাত’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সূর্য মিশ্র বলেন, এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষ বলতে পারে, আমার সমগ্র জীবন সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেছি দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো আদর্শের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে। এই বোধ নিয়েই তাঁরা জীবন অতিবাহিত করেছেন। দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তাঁদের আমরা এভাবেই মনে রাখব।

স্মরণসভায় মহম্মদ সেলিম বলেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকে মানুষের জন্য কাজ করতে গেলে প্রতিদিন কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হয়। কমরেড মদন ঘোষ এবং কমরেড মৃদুল দে দুজনেই প্রতিনিয়ত নিজেদের মতাদর্শে শানিত করেছেন। সমাজ বিকাশের ধারায় ঘটা ঘটনা বোঝা, বিশ্লেষণ করা এবং তার প্রেক্ষাপটে যে চলমান আন্দোলন তাতে অংশ নেওয়ার জীবন তাঁরা অতিবাহিত করেছেন। সেই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে হলে ইতিহাসবোধ, অর্থনীতির চর্চা এইসবটা তাঁরা আয়ত্ব করে নিজেদের মতো করে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সংগঠনকে সমৃদ্ধ করেছেন, যা থেকে আমরা আকর গ্রহণ করব।

তিনি বলেন, যারা ধ্বংসের জন্য, তারা বই পোড়ায়। যাঁরা সৃষ্টির জন্য, তাঁরা বই পড়ে। দক্ষিণপন্থার যখন যেখানে উত্থান হয়েছে সেখানে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রগুলিকে ধ্বংস করেছে। যাঁরা সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাস করে তাঁরা সেগুলিকে তিল তিল করে গড়ে তোলে। ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাঁরা খেয়াল করেন না। পরপর অক্ষর সাজিয়ে যেমন শব্দ, শব্দ সাজিয়ে বাক্য, বাক্য সাজিয়ে যেমন লেখা তৈরি হয়, মতাদর্শে নির্ভর থেকে সেভাবেই তাঁরা পার্টিকে গড়ে তুলেছেন। কমিটিতে না থাকলেও এই কাজ থেকে তাঁরা অবসর নেননি।

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের ভাষা জাতি উপজাতিকে ব্যবহার করার ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে মণিপুরে। আমাদের এখানেও প্রতিদিন এই শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। একের বিরুদ্ধে অন্যকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মদন দা এবং মৃদুল দা-কে স্মরণ করার তাৎপর্য হচ্ছে, এই লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। মদন দা এবং মৃদুল দা এই আদর্শগত লড়াইয়ে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবিচল ছিলেন।

এদিনের অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিজিৎ ঘোষ।