৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০
রবীন্দ্রনাথঃ আজ ও আগামীকালের জন্য...
পল্লব সেনগুপ্ত
জীবনাবসানের অল্পদিন আগে লেখা ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎ-বিশ্বের পরিণতি কী হতে পারে যে, তাই নিয়ে সুগভীর দুশ্চিন্তার প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাক্ষসী বেলা ...সারা পৃথিবী তখন সম্ভাব্য এক মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কায় অস্থির ছিল। আজ ৮২ বছর পরে বিশ্বের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপকভাবে পরিবর্তন ঘটে গেছে ঠিকই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মনন এবং সৃজনের বহু বহু কিছুই আজও একান্তই প্রাসঙ্গিক যে, এমনটা বললে ভুল হবে না। বিশেষ করে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষায় এটা সর্বশতাংশেই ঠিক।
রবীন্দ্রনাথের নাম করেই তাঁর ভাবনা ও আদর্শের পরিপন্থী অজস্র যে সমস্ত অপহ্নব ঘটানো হচ্ছে আমাদের দেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে - তাতে, রবীন্দ্রনাথকে অপব্যবহার করে তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করাই আসল উদ্দেশ্য এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না কারুরই সম্ভবত।
এঁদের ‘রবীন্দ্রভক্তির’ উচাটনটা দেখা যায় প্রধানত দিল্লি থেকে পশ্চিমবাংলায় যখন উড়ে আসেন - বিশেষ করে কোনও একটা বড়ো ধরনের নির্বাচন যখন সমাসন্ন হয়, তখন। আসলে অধিকাংশ বাঙালির মনেই যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিশেষ ধরনের একটা শ্রদ্ধা-নিবিড় অনুভব আছে, সেই সত্যটা ওঁদের অজানা নয়। তবে বহুক্ষেত্রেই অজ্ঞতাবশত এমন কিছু কথা ওঁরা বলে-টলে বসেন যাতে ব্যাপারটা প্রায়শই হাস্যকর এবং বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। যেমন, মান্যবর অমিত শাহ-ই একবার এসে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান হিসেবে শান্তিনিকেতনের উল্লেখ করেছিলেন! আর খাস শান্তিনিকেতনেই যাকে ওদের বর্গাদার হিসেবে বসিয়ে দিয়েছেন, তিনি তো বিশ্বভারতীকে প্রায় ‘নিঃস্বভারতী’ বানিয়ে তুলেছেন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ যে ভারতবর্ষের রূপমূর্তি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার সঙ্গে এই দিল্লির শাসকদের ব্যাখ্যাত (‘অপব্যাখ্যাত’ বললেই ঠিক হয়!) ভারত তথা হিন্দোস্তানের সত্যিই কি কোনও মিল আছে? রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে ভারতের প্রাণসত্তা নিহিত আছে সংহতি, সমন্বয় এবং সহাবস্থানের রসায়নে সঞ্জীবিত হয়ে। এদেশ তো তাঁর বিচারে ‘মহামানবের সাগরতীরে’ - এবং সেই ‘মহামানব’-এর অর্থ ‘গ্রেট ম্যান’ নয়, ‘অল্ মেন’ - সর্বমানব। কী তার স্বরূপ? না তার মাঝে ‘‘শক হূন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’’ আর এঁরা এঁদের বশংবদদের সাহায্যে ঠিক এই ব্যাপারটাই তো ছিঁড়ে ফেলে দিতে চাইছেন ইতিহাসের পাতা থেকে। সেই মহামানবের মিছিলে অংশ নেবার জন্য তিনি কাদের আহ্বান জানিয়েছেন? ...‘‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান /এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান।’’ সেটা কি আদৌ দেখা যাচ্ছে বর্তমানের ভারতে? প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা হচ্ছে হিন্দুতে-মুসলিমে, হিন্দুতে-খ্রিস্টানে, মুসলমানে-খ্রিস্টানে হানাহানি, বিহারিতে-মারাঠিতে, তামিলে-বিহারিতে, অসমিয়া-বাঙালিতে, মেইতেই-কুকিতে, তিপ্রায়-বাঙালিতে - শুধু দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দিয়ে এঁদের গুরু সাভারকরের উপাস্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শেখানো ‘‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’’ পদ্ধতির সাহায্যে গোটা দেশকে শাসন এবং শোষণ করা।
।। দুই ।।
এই বহুধাব্যাপ্ত-বিভেদের হোতা যাঁরা, তাঁরা ভোটের স্বার্থে ‘সেই’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছদ্ম ভক্তি দেখান, যিনি ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় ভারতের ভাবমূর্তি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, ‘‘বিভেদ ভুলিল জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া’’ - এই ব্যঞ্জনার মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথ ভারতের মানুষের বিভেদহীন যে রূপকে প্রত্যাশা করেছিলেন তাতে সবাইকে আন্তরিকভাবে আহ্বান করেছিলেন কেমন করে যে, সে তো এখনই আমরা দেখেছি। জানি সেখানের ‘ইংরাজ’ শব্দটা নিয়ে তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা ছি-ছিক্কার করে উঠতে পারেন। কিন্তু এখানে ‘‘ইংরাজ’’ কথাটা প্রতীচ্য দুনিয়ার প্রতীক হয়ে ব্যবহৃত হনয়েছে, সাভারকরীদের মতো ব্রিটিশ-আনুগত্যের দ্যোতক রূপে নয়! এখানে ‘ইংরাজ’ অর্থে শেকসপিয়র, মিল্টন, শেলি, বাইরন, কিটসের সৃষ্টি, নিউটন-ডারউইনের যুগান্তকারী আবিষ্কার প্রযুক্তিবিদ্যার সমন্বিত প্রতীক! আর এই ছদ্ম-রবীন্দ্রানুরাগীরা ডারউইনের তত্ত্বকেই শেখানো বন্ধ করছে, নিউটনের আবিষ্কারকে ‘‘ব্যাদে আছে’’ মার্কা (অপ) ব্যাখ্যানে ভূষিত করছে, শেকসপিয়র-শেলি পড়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। ...একটু আগেই দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের সঠিক সঙ্কেতকে নির্দেশ করেছিলেন ‘শক হূন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’’ বলে। এবং ওই পঙ্ক্তির পরের চরণটি তো আরও তাৎপর্যপূর্ণঃ ‘‘তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে কেহ নহে, নহে দূর /আমার শোনিতে রয়েছে ধ্বনিতে তারি বিচিত্র সুর!’’ বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে যে ঐক্য, সেই ‘সিনাক্রটিজ্ম’ই তো রবীন্দ্রভাবনার মূল ভিত্তি। আর সেটাকেই যে অস্বীকার করছেন দিল্লির তখ্ত-এ-তাউসে আসীন হওয়া অমিতবিক্রম শাহেনশাহরা! যে ‘পাঠান-মোগল’ ঐতিহ্যকে আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ধার্য করেছেন কবি সঠিক প্রতীতিতেই, সেই মোগল যুগকেই তো ইতিহাসের বই থেকে পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন তাঁরা! অথচ,বাংলায় এসে রবীন্দ্রসাধনার নামে ভণ্ডামির ভেক ধরছেন তাঁরা!
আমার ঠিক জানা নেই রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস দিল্লির কর্তারা পড়েছেন কি না! না কি, নামও শোনেননি? ...তা, যদি তাঁদের স্থানীয় হুকুম বরদারদের মধ্যে কেউ পড়ে থাকেন, তিনি তো জানেন (অবশ্য যদি বুঝে থাকেন) যে, গোরার চরিত্রের প্রগাঢ় দেশভক্তি বিবর্তিত হয়ে কাহিনির শেষে তাকে একই সঙ্গে বিশ্বমানবতার অভিভবে পৌঁছে দিয়েছিল। দিল্লি-দরবারিদের দেশভক্তির ঠুন্কো কাঠামোয় অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বজনীন ব্যঞ্জনাময় ‘ন্যাশনালিজ্ম’-কে ধরানো যাবে না। অবশ্যই তাঁর ‘ন্যাশনালিজ্ম’ প্রবন্ধটি তাঁরা পড়েননি - সেটা তো আবার ইংরেজিতে লেখা! এবং ওঁদের ফতোয়ায় ‘‘আংরেজি মে কাম নহি চলেগি!’’ ...আর ঠিক একই কথা বলতে হয় কবির ‘রিলিজিওন অব ম্যান’ সম্পর্কেও - ভেদ বিভেদভিত্তিক ধর্মবুদ্ধিকে যা সম্পূর্ণরূপেই অস্বীকার করেছে! আর ওই বিভেদকেন্দ্রিক ধর্মবুদ্ধিই ওঁদের ভাবপ্রেরণা!
।। তিন ।।
আমি জানিনে, রবীন্দ্রনাথ যদি এখনও থাকতেন আমাদের মধ্যে - তাঁর বিরুদ্ধে ওঁরা ‘লাভ জেহাদি’ হয়ে মামলা রুজু করতেন কি-না। কবির লেখা ‘মুসলমানীর গল্প’-তে হিন্দু পরিবারের মেয়ে কমলা পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে হবীর খাঁ-র বাড়িতে কন্যাস্নেহে আশ্রয় পায় - পরে তাঁর ছেলেকে ভালবেসে সে তাকে বিয়েও করে। ...এই গল্প পড়লে তো দিল্লির কর্তারা ‘‘সিয়ারাম, সিয়ারাম’’ বলে আঁৎকে উঠবেন! অথচ (ওঁদের নিজস্ব প্রচারে) ওঁরা কিন্তু প্রবল রবীন্দ্রপন্থী! কবির ‘সমস্যাপূরণ’ গল্পের কথা তো বলছিই নে আর - যেখানে ব্রাহ্মণ জমিদার মৃত্যুশয্যায় শুয়ে নিজের পরমধার্মিক ছেলেকে জানিয়েছেন যে, গরিব মুসলমান চাষি অছিমদ্দি আসলে তারই বৈমাত্রেয় ভাই, জমিদারের গোপন ‘যবনী-পত্নী’র গর্ভজাত সন্তান! অবশ্য ওঁরা যেখানে নিরঙ্কুশ সেই ইউ পি রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রম থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন নিঃশব্দে! দিল্লিওয়ালাদের মূল আদর্শ নিয়ন্তা যে নাগপুরিয়া আরএসএস - তারা তো মাঝে মাঝেই জিগির তোলে ‘‘জনগণমন অধিনায়ক’’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত বলে মানার বিরুদ্ধে। স্বয়ং অমিত শাহও তো সদ্য কলকাতার আরএসএস-পন্থীদের রবীন্দ্র অনুষ্ঠানে ওই গানকে জাতীয় সঙ্গীত বলে উল্লেখ না করে ‘রাষ্ট্রগীতি’ আখ্যা দিয়েছেন।
ওই সভাতেই মাননীয় অমিতবাবু সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই গুর্দেবকা আদর্শ্মাফিক চলবার ‘সলাহ্-বিমর্শ’ দিয়েছেন! এই ভাবের ঘরে চুরিটা বাস্তবিকই মনোজ্ঞ। ওঁর এই বচনামৃত তো একটা বিলিতি প্রবাদের কথা মনে পড়িয়ে দিলঃ ‘‘সামটাইম দ্য ডেভিল অলসো কোট্স ফ্রম দ্য স্ক্রিপচার?’’ শাদা বাংলায় যার ভাবানুবাদ হলো, কখনো কখনো শয়তানেও শাস্তর আওড়ায়! অবশ্য মান্যবরকে ‘ডেভিল’ বলছি নে ...তাতে আসল ব্যক্তিটি মিথকথার পাতা থেকে বেরিয়ে এসে রাগঝাল করতে পারে আবার!
অমিত শাহ রবীন্দ্রনাথকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে ফতোয়া দিয়েছেন। ভাল কথা। কিন্তু স্যরজি, আপনি ওই বাগ্বিভূতি বিচ্ছুরণ করার কিছু আগেই তো আপনার অনুগামীরা রবীন্দ্রভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ‘‘জয় শ্রীরাম’’ ধ্বনি সহকারে প্রবল হাতাহাতি করেছেন সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামের গেটে! এ নিয়ে কিছু বলবেন কি?
।। চার ।।
রবীন্দ্রনাথ যে আজও সর্বজনের কাছে কতখানি প্রাসঙ্গিক সেটা অবশ্য তাঁর জন্মদিন-স্মরণিক হিসেবে যে কথা বলেছেন তাঁদের টুইটার মাধ্যমে, সেটা দেখলেই উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। সারা বিশ্বের উদ্দেশে পাঠানো সেই প্রতিবেদনে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সেই অমর কবিতা ‘‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য-উচ্চ যেথা শির’’ - সেটির ইংরেজি রূপান্তরণ তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়া বই ‘সং অফারিংস’ থেকে পুরোটা উদ্ধৃত করেছেন। (আর সেই সঙ্গে ‘‘জনগণমন’’ গানের কবির নিজের ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপিও আছে।) ...আজকের পৃথিবীতে আজকের ভারতে - এই দৃপ্ত ঘোষণাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক নয় কি?