E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০

বিশ্ববিদ্যাতীর্থাঙ্গনের বিনাশ নাই

বনবাণী ভট্টাচার্য


যে আমি ওই ভেসে চলে কালের ঢেউয়ে আকাশতলে
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।


হয়তো দেখছেন, হয়তো দেখছেন না। তাঁর ‘বড় আমির’ রক্ত মাংসের যে মূর্তি, সে তো ওই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরই। তিনি কি দেখছেন আজ‍‌কের ভারতে ‘সভ্যতার শ্মশান-শয্যা’? দেখছেন কি ‘উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ?’

রবীন্দ্র প্রতিভার পরতে পরতে বৈচিত্র্য। সাহিত্য প্রতিভার সাথে সমাজ-চিন্তা সঙ্গীতের আগাগোড়ার সাথে শিক্ষার সামগ্রিক ভাবনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে জমিদারি রক্ষা - বহু সমভাবনা ও বিপরীত ভাবনার সহ-অবস্থান রবীন্দ্র মনীষা। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের সশ্রদ্ধ প্রণতি - ‘‘অল্প অল্প ঋণের কথাই মনে পড়ে, কিন্তু যিনি অজস্র বিত্তসম্পদ দান করিয়া সমস্ত দেশকে ঋণী করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন তাহার ঋণ কি গনিয়া দেখা সম্ভব। বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণ কি বিপুল, তাহার স্পষ্ট ধারণা কাহারো আছে কিনা জানি না।’’

তিনি যেমন কবি, তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষাবিদও। তিনি তো সকল কাজের কাজী। কবি রবীন্দ্রনাথের থেকে শিক্ষাব্রতী-শিক্ষাবিদ রবীন্দ্রনাথের স্থান একটুও কম বলে মনে হয় না। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার স্থাপন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের স্বার্থে। এদেশে তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার উদ্দেশে বিদ্যালয়ের কারখানায় ইংরেজ, কেরানি উৎপাদনের আয়োজন করেছিল। এর মধ্যে ছিল না ভারতের কল্যাণ এবং ভারতবাসীর প্রতি শ্রদ্ধার লেশ। কিন্তু চিরকালের বাণী এই যে - শ্রদ্ধয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম। তাই অশ্রদ্ধার এই দানের অপূর্ণতায় ছাত্রছাত্রীর চিত্তের সেই বিকাশ ঘটতে পারেনি, যেখানে মনুষ্যত্বের বড়ো আসন পাতা থাকে। শিক্ষার অপূর্ণতা কবিকে দগ্ধ করেছে। তাছাড়া, শিক্ষার পঠন-পাঠন পদ্ধতি, শিশুর মনে লেখাপড়ার চাপ, কবির মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এবং বিদ্যালয়কে তিনি ইট-কাঠে ‍‌তৈরি হাসপাতাল ও জেলখানার থেকে বেশি কিছু ভাবতে পারেননি। ইংরেজের ‍‌তৈরি এই শিক্ষা প্রাণহীন। কারণ শিশু সমাজের ম‍‌‍‌ধ্যে থেকে শেখার সুযোগ পায় না। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন - নিজের সমাজ প্রতিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বিদ্যালয়‍‌গুলো, কবির কাছে ইঞ্জি‍‌নের মতো মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, এই ইঞ্জিন ‘‘বস্তু জোগায়, প্রাণ জো‍‌গায় না।’’

অথচ কবির সারাজীবনের সাধনা তো সারা দেশে শিক্ষার প্রসার। তিনি তো বলতে বাধ্য হ‍‌য়েছেন - ‘‘ভারতবর্ষের বুকের উপর যত কিছু দুঃখ আজ অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে অশিক্ষা।’’ তাই তিনি ব্রত উদ্‌যাপন করতে পদ্মাপারের জমিদারি থেকে ১৯০১ সালে আসেন বীরভূমের লাল মাটিতে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের পরিচর্যায়। কবির শৈশব ছিল বন্দি-অবহেলিত-কুণ্ঠিত। সেই বেদনা বু‍‌কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লালন পালন করেছেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে - আর শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছে তাঁর শিশুমুখী এক প্রকল্প। কবির এক অভিনব কাব্য রচনা যেন শান্তিনিকেতন, আর একটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের নেশায় যখন দেশীয় নেতৃত্ব মত্ত, তখন কবি বেদনার্ত হৃদয়ে সেই প্রয়াস থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে, তাঁর একান্ত নিজের প্রদীপখানা জ্বালিয়ে পথের ধারে বসে থাকবেন ব‍‌লে, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে জানিয়েছিলেন। না, তিনি অভিমানে, বসে তো থাকেননি। তিনি সৃষ্টি করলেন উচ্ছল-চঞ্চল ‍‌শৈশব কৈশোরের জন্য শিক্ষার আনন্দময় এক লীলাভূমি। গাছের ছায়ায় নীল আকাশের কোলে কোলে মেঘের ভেলায় চেপে, ছাত্র-শিক্ষকের দেওয়া নেওয়া চলল এক মায়াময় পরিবেশে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের লোকালয়ে প্রকৃতি যদি কোনোভাবেই প্রবেশাধিকার না পায়, তাহলে মানুষের চিন্তা-চৈতন্যও ক্রমশ কলুষিত ও ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে আত্মহনন করে। মানব জীবনের পূর্ণতা লাভও অসম্ভব হয়ে পড়ে। শিক্ষা বলতে কবি তো কেবল জ্ঞানের তপস্যাকে মানেননি। তিনি চেয়েছেন বোধের তপস্যা। কবির বিশ্বাস মানুষের ইতিহাস জীবধর্মী - সে নিগূঢ় প্রাণশক্তিতে বেড়ে ওঠে। এই প্রাণ ঝরনার উৎস, তরুলতা-পশুপাখি, নদী নির্ঝর থেকে শুরু করে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ মাটি। ‘‘প্রকৃতিই শিশুর শিক্ষক, প্রকৃতিই ‍‌শিশুর লীলা সহচর হলে তাদের মনোবিকাশ সহজ ও স্বাভাবিক হয়। প্রকৃতির রূপে রসে গন্ধে বর্ণে চিত্রে সঙ্গীতে তাদের হৃদয় শতদল পদ্মের মতো আনন্দে বিকশিত হ‍‌য়ে উঠবে।’’ - আর তার ভিতরে বাসা বাঁধবে ‘বড়োত্ব’ - কারণ, সে আকাশ বাতাসের মতো ‘বড়ো’র সাথে বাস করে, যারা তাকে ‘বড়ো’ হবার ডাক দেয় প্রতিনিয়ত। রবীন্দ্রনাথের গভীর প্রত্যয় তো এই-ই ছিল। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় সাধারণ স্কুল শিক্ষার প্যাটার্নের ব্যতিক্রমী বুনোটে বাঁধা। তপোবনের ভিতরকার সত্যটিকে আধুনিক জীবনযাত্রার আধারে প্রতিষ্ঠিত করা যেন ঐতিহাসিক এক মেলবন্ধন।

শিক্ষায়, কবির অভিপ্রায় কখনও উকিল ব্যারিস্টার-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, মানুষের মতো মানুষ গড়াই ছিল তার চিরকালীন লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে, শ্রম ও বিনোদন-সংযম ও স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ এবং বেদনার মধ্য দিয়ে জীব পালন ও সমস্ত প্রাণের পরিচর্যার অনুশীলনের সাহায্যে সব সংকীর্ণতা সব ক্ষুদ্রতা মুক্ত একটা আদর্শ জীবনের সম্পদে বিত্তশালী করতে চেয়েছেন। তাই তিনি জাগ্রত নির্মল নতুন প্রাণের ছাত্রদের ডিগ্রির নুড়ি কুড়োতে বিশেষ উৎসাহিত না করে বার্তা দিয়েছেন - ‘দুঃখই হোক তব বিত্ত মহান।’ হয়তো কবির বিশ্বাস ছিল দুঃখের তিমিরে মঙ্গল আলো একদিন না একদিন জ্বলে উঠবে।

এই মঙ্গল আলো, আলাদীনের প্রদীপের মতো জ্বলে ওঠার নয়। ম্যালেরিয়া টাইফয়েড পীড়িত - তৃষ্ণার্ত-ক্ষুধার্ত, অশিক্ষায় ছাওয়া অন্ধকার ভারতভূমিতে আলো জ্বালাতে হলে চাই লক্ষ কোটি সবল হাত - সবল মন, যা কেবল ডিসিপ্লিনের কড়া পাকে তৈরি করা যায় না। তাই, তিনি সকল কাজের সক্ষম করে মানুষ গড়তে শুরু করলেন। কবির ভিতরে যে কর্মী সংগঠকের সত্তা, শিলাইদহ, পতিসর থেকেই পল্লি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯২৩ সালে সুরুল কুঠিবাড়ি থেকে, ছাত্রের মধ্যেই জীবনের সমস্ত কাজও সৃষ্টি অটুট বন্ধনে বেঁধে দিতে শুরু হলো শ্রীনিকেতনের কর্মধারা। গ্রাম জাগানোর আকাঙ্ক্ষায় তিনি ছিলেন অস্থির-অশান্ত। শ্রীনিকেতনে ব্রতী দল গঠন করলেন, স্থাপন করলেন শিক্ষাসত্র। এই বাহিনী জঙ্গল পরিষ্কার, পুকুর সংস্কার, রাস্তাঘাট তৈরি থেকে অগ্নিকাণ্ড-দুর্ভিক্ষ-মহামারীতে গ্রামবাসীর পাশে থেকে তাঁদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে উঠলো। শ্রীনিকেতন ও তার শিক্ষাসত্র লোকশিক্ষা সংসদে প্রসারিত হয়ে, কর্ম প্রয়াস, শিল্পভবনে উন্নীত হয়ে, চামড়ার কাজ - বই বাঁধাই-তাঁত চালানোর মতো কর্মশিক্ষা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে, কবির যে স্বপ্ন, গ্রামের সম্পদ দিয়ে গ্রামবাসীর হাতে গ্রামোন্নয়ন - গ্রামীণ মানুষকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে তাদের আত্মশক্তি ও মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলা, সেই স্বপ্ন সফলের যেন উৎস তিনি ধন-মান নয়, চে‌‍‌য়েছিলেন গ্রামের জাগরণ - চেয়েছিলেন গ্রামীণ মানুষের মন।

গ্রামের মন জাগিয়ে, এবার বিশ্বকর্মা- কবি, বিশ্বভারতী স্থাপন করে ব্রতী হলেন বি‍শ্বের মন একসুরে বেঁধে দিতে। মিলনের গ্রন্থিতে। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রস্তর বিদেশিদের উপস্থিতিতে স্থাপনেই বিশ্বমানবের সাথে তাঁর আত্মীয়তা সাধন হলো যেন। বিশ্বভারতীর জন্মকাল, মানব সভ্যতার এক শ্মশান যাত্রার সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সদ্য শেষ হয়েছে, ঘটেছে জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর গণহত্যাকাণ্ড। স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত বেঁধেছে - দুরন্ত লোভ আত্মবিনাশী বৈরিতায় কদর্য মূর্তি ধরেছে - জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ। তিনি বিশ্বাস করতেন ঐক্য ও মিলনের শক্তি দেয় জ্ঞান। কবি বললেন, ‘‘সেই জানবার সোপান তৈরি করার দ্বারা মেলবার শিখরে পৌঁছবার সাধনা আমরা গ্রহণ করেছি।’’ এই মিলন তপস্যার বীজমন্ত্র ‘যত্রবিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্‌।’ স্বদেশের মাটিতে, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়েই দেশীয় সুবাসে বিশ্বভারতীকে বিদ্যার গৌরব ও দায়িত্ব বোধ থেকে ভূমিষ্ট করালেন, বিশ্বভারতী, জ্ঞানের অবারিত আতিথ্যের দ্বার খুলে দিয়েছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিদ্যার্থীরা প্রাণে প্রাণ মেলাতে জ্ঞানের এই অতিথিশালা, বিশ্বভারতীর শ্যামল-কোমল ছায়ায় আসেন। বছর বছর।

শান্তি-শ্রী ও বিশ্বভারতীর মিলন ও জ্যোতি দীক্ষার দ্বার আজ প্রায় বন্ধ হতে চ‍‌লেছে। অশান্তির দহন জ্বালায় পুড়ছে স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের আদর্শ - পুড়ছে তাঁর বিশাল সৃষ্টিতে ব্যাপ্ত তাঁর উদার অন্তর্লোক, পুড়ছে ভারতের ঐক্য ও সম্প্রীতির ধর্মনিরপেক্ষ সুমহান ঐতিহ্য। বদলে, ধর্মীয় বিদ্বেষ -জাতিবিদ্বেষের দানব শক্তি, প্রবল শক্তিধর হয়ে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ যে মানব ধর্মের মন্দির, তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে চলেছে। শিক্ষা চিন্তা-সমাজ ভাবনা ও আদর্শের বিনি সুতোয় গাঁথামালা শান্তিনিকেতন - শ্রীনিকেতন ও বিশ্বভারতী, তাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে জাহান্নামের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আজকের বিশ্বভারতী-প্রশাসন। বর্তমান প্রশাসন প্রধান, ছাত্র-শিক্ষক-আবাসিক থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীর স্নিগ্ধ পরিবেশ প্রতিবেশীর সাথে সংঘাতে নেমেছেন। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর আদরে সোহাগে গড়ে তোলা আলাপনী, শান্তিনিকেতন অনুরাগিনী স্থানীয় মহিলাদের সংঘকে হঠাৎই যাযাবর করে তুলতে প্রশাসন দ্বিধাহীন হলো। প্রাণের আরাম-চিত্তের শান্তির জন্য তাদের অঙ্গন দিয়ে সাধারণের পথচলা বাতিল করল তারা সেলফিস জায়েন্টের মতো শক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে, যে শিক্ষা মন্দিরকে কেউ কখনও বেড়াজালে আবদ্ধ করেনি। ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, হস্টেল বন্ধ রাখা - পরীক্ষার অনিয়ম-গবেষণার অব্যবস্থা, ছাত্রদের মুক্ত চিন্তাভাবনা করার অধিকার কাড়ায়, প্রশাসন স্বৈরাচারের কুৎসিত প্রমাণ দিচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন ছাত্র-শিক্ষক যে কোনো অছিলায় হেনস্তা করছে-ছাত্রকে একেবারে বিতাড়িত এবং অধ্যাপককে বরখাস্ত করে ক্ষমতার দাপট ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার দম্ভ, বিশ্ববরেণ্য নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদকে কলঙ্কিত করছে - সম্মানের আসন থে‍‌কে নামিয়ে আনতে ষড়যন্ত্র করছে। যার জন্য শুধু বাংলা নয় সমস্ত সমাজ ও সংস্কৃতি জগৎ অধ্যাপকের কাছে মার্জনা প্রার্থী। অন্যদি‍‌‍কে ক্ষোভে দুঃখে ফুঁসছে মানুষ, প্রতিবাদে হচ্ছে সোচ্চার।

মানুষের দুঃখ, শাসকের সৃষ্ট বাংলার দুর্ভাগ্যের জন্য। কবির স্বপ্নসন্তান এই বিশ্বভারতীর উপাচার্যের আসনের একদিন অলঙ্কার হয়েছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন, ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতো নক্ষত্ররা, আর আচার্য ছিলেন জওহরলাল নেহরুর মতো মুক্তবুদ্ধির মানুষরা। আজ, আচার্য-উপাচার্য হয়ে আছেন তারাই যারা জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হলে মানায়, যাদের পিছনে আছে এরাজ্যের মুখোশ পড়া অরণ্যদেব।

না, ওরা ওঝা গুণীন নন, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিন্দুত্বের প্রচারক - কেউ ঘোষিত, কেউ অঘোষিত। হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণই এদের জীবনের লক্ষ্য- আদর্শ, দেশের মানুষের শিক্ষা বা বিদ্যার গৌরবের অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যত, তাই উদ্যত হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক উগ্রজাতীয়তাবাদী নতুন শিক্ষানীতি প্রয়োগে - যাতে শুধু শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্র সংকুচিত করাই নয়, মনন দখল করা যায়। জাতপাতে ধর্মে ধর্মে ঘৃণা, ধনী দরিদ্রে উঁচু নিচুর ফারাক বৃদ্ধি করে মেধা বিনষ্ট করার আয়োজন চলছে মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস, অপবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান, পুরানকে ইতিহাস বলে পরিবেশন করে। তাই বিরোধ জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, দিল্লি, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মুক্তমনা ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে। দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির উত্থানের সাথে সাথে ফিন্যান্স পুঁজির বল্গাহীন দৌড়ে বাড়ছে রাষ্ট্রের দখলদারি। বিজেপি এবং তার সংঘ পরিবার, তাদের পেশিশক্তি নিয়ে দ্রুত ভারতকে মুসোলিনির ইতালি আর হিটলারের জার্মানি করতে চাইছে। আর বাংলায় বসে তাল দিচ্ছেন তিনি, যিনি বাংলাকে লন্ডন করবেন বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বাধীন শিক্ষা চেয়েছেন, যা স্বাজাত্যের-স্বধর্মের অহমিকামুক্ত। কিন্তু বিজেপি এবং আরএসএস-র ফ্যাসিস্তধর্মী সর্বব্যাপী আগ্রাসন গিলছে মনন-মেধা-মনুষ্যত্ব। তাদের আত্মঘাতী সামাজিক বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-বৈরিতা ধ্বংস করছে দে‍‌‍‌শের মেধা ও মননশীলতা। বিশ্বভারতীর কথা কবি বলেছেন ‘‘বিশ্বভারতী নামে যে প্রতিষ্ঠান, তা এই আহ্বান নিয়ে স্থাপিত হয়েছিল যে, মানুষকে শুধু প্রকৃতির ক্ষেত্রে নয়, মানুষের মধ্যে মুক্তি দিতে হবে।’’ চণ্ডীদাস-চৈতন্যদেব-কবীর-দাদূর যে ভারতের হৃদয় মথিত ঐক্যের বার্তা-মানবতার বাণী, যা সৃষ্টি করেছে ভারতের সম্প্রীতির মহান ঐ‍‌তিহ্য, তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্রতীপে ধারণের যোগ্য করে কবি রচনা করেছেন বিশ্বভারতী নামের মহাকাব্য, উচ্চতা ও ব্যাপ্তিতে যে হিমালয়, অথচ অরাজকতা উচ্ছৃঙ্খলতায় প্রায় শ্বাসরুদ্ধ-ক্ষমতার দম্ভে আক্রান্ত। স্বার্থের রণতরী বেয়ে স্বৈরশক্তি তাকে হাতের মুঠোয় বন্দি করতে উন্মত্ত।

প্রাণহীন শিক্ষার প্রতিবাদে মনুষ্যত্বের প্রাচুর্য এবং মানুষে মানুষে বন্ধন রচনায় একদিন, সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি আকাশচুম্বী প্রতিস্পর্ধায় মহামানবের সাগরতীরে যার নির্মাণ, তার লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী গ্লোবাল ভিলেজের ভাঁওতা নয়, মানুষের বিশ্বগত প্রাণে উত্তরণের সাধনার মধ্য দিয়ে, সগৌরবে দাঁড়িয়ে থেকে, গোটা পৃথিবীটাকে একটি মাত্র আবাসে পরিণত করা। তার অসম্মান, বিশ্বকবির অসম্মান, তার অসম্মান জাতির অসম্মান, যাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষুণ্ণ করাই আত্মহনন। তবু কলুষ কল্মষ, বি‍‌রোধ-বিদ্বেষের অমঙ্গল মাথা তুলতে চাইছে। বিশ্বমানবের মিলনের নীড়টিকে ‘ভগ্ননীড়ে’ পরিণত করার সমস্ত অকল্যাণকে পরাস্ত করবে মানুষের সম্মিলিত শুভ‍‌বোধের শক্তি। কান পেতে শুনতে হবে কবির অপরাজেয় বাণী -
স্বরতরঙ্গিয়া গাও বিহঙ্গম, পূর্ব পশ্চিম বন্ধু সঙ্গম -
মৈত্রীবন্ধন পুণ্যমন্ত্র-পবিত্র বিশ্ব সমাজে।।


জয় হোক বিশ্বকবির সৃজন, বিশ্বভারতীর উজ্জ্বল গৌরব - ‘যত্রবিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্‌।’