E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০

এক ক্যানভাসে মার্কস ও রবীন্দ্রনাথ! টুকরো কিছু কথা

আভাস রায়চৌধুরী


১৮৮৩-তে যখন মার্কস প্রয়াত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ তখন বাইশের তরতাজা যুবক। প্রায় সবে কবি ও লেখক হিসেবে তাঁর জীবন শুরু করছেন। যেকোনো মনীষার মতোই মার্কস ও রবীন্দ্রনাথের জীবনও এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে যাত্রা এবং উত্তরণের কাব্য। মার্কসবাদকে বলা যায় ইয়োরোপীয় রেনেসাঁ, আলোকপ্রাপ্তির এক যুক্তিসঙ্গত পরিণতি। রবীন্দ্রনাথের ‘গড়ে ওঠায়’ বিশ্বব্যাপী আলোর এই আহ্বান যেমন ছিল, তেমনি উনিশ শতকে বাংলার জাগরণের মধ্যে গড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এর অন্যতম এক স্থপতি। অবশ্য উনিশ শতকের বাংলার জাগরণকে ইয়োরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেকেই এই তুলনা করার বিরোধী। আলোকপ্রাপ্তির সূচনা ইয়োরোপের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলি থেকে শুরু হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে ইয়োরোপীয় মডেলের আলোকপ্রাপ্তিকেই সারা পৃথিবীর মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে? ইতিহাসের বস্তুবাদী চর্চা এ ধরনের ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় না। রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপের আলোকপ্রাপ্তি, আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বীভৎসাকে বর্জন করছেন। এখানেই মার্কসের চিন্তার সঙ্গে তাঁর একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতায় ভারতবর্ষীয় রূপটাই প্রধান। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মৌলিকত্ব হলো আন্তর্জাতিকতাবাদ, এখানে ভারতবর্ষ কখনওই বিশ্বের মানুষের আত্মীয়তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব বুর্জোয়া পৃথিবীকে নতুন পৃথিবীর মুখোমুখি করল। আধুনিকতার চরিত্রে এলো মানব মুক্তির সম্ভাবনার নতুন এক উন্মুক্ত পথ। মার্কসের মতে, মানুষ তার নিজের বাস্তবতায় নিজের ইতিহাস নির্মাণ করে। এবং এই নির্মাণে তার লক্ষ্য হলো ইমানসিপেশন অফ হিউম্যান বিয়িং। রুশ বিপ্লব পৃথিবীতে প্রথম সফলভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল তার এটাই লক্ষ্য ছিল। রুশ বিপ্লব-উত্তর আধুনিক মানুষের আধুনিক পথে যাত্রার এই নতুন বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের সঙ্গে কি আমরা মেলাতে পারি রবি ঠাকুরের ‘চির নূতনেরে দিল ডাক...’ আহ্বান কে? আসলে তিনি তো নিজের জন্মদিবস সম্পর্কে এ কথাগুলি বলেননি, পৃথিবীর মানুষের ইতিহাসের যাত্রাপথে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবনকে আহবান জানিয়েছেন।

মার্কস ও রবীন্দ্রনাথকে মেলানো এই রচনার বিষয়বস্তু নয়। বোধহয় তা সম্ভব না। আসলে মানুষের মুক্তির স্বপ্নসন্ধানীরা মার্কস ও রবীন্দ্রনাথকে কেমনভাবে দেখতে পারেন এবং তা দেখতে গিয়ে দু’জনকে একইসঙ্গে চিন্তা করা যায় কি? একই ক্যানভাসে দেখতে গিয়ে প্রথমেই দুটি পার্থক্য আমাদের মনে রাখা দরকার। মার্কস ছিলেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভাববাদী। অবশ্য রবীন্দ্র চিন্তায় দ্বান্দ্বিকতার উপাদানও রয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। মার্কস এবং রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্ভারের মহাসাগরের ভিতরে ডুব না দিয়ে সীমাবদ্ধ ধারণা নিয়ে একই ক্যানভাসে উভয়কে দেখতে যাওয়া হলো দুঃসাধ্য ইচ্ছে। তাই আলোচনার ক্ষেত্রকে একদমই সীমাবদ্ধ করে নেবার জন্য মুক্তধারা, রক্তকরবী, কালের যাত্রা (রথের রশি) নাটক তিনটিকে বেছে নেওয়া হলো। এই তিনটি নাটক রবীন্দ্রনাথের চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের পর্ব। যদিও ১৯১০ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত ডাকঘর, অচলায়তন, ফাল্গুনী, গোরা ইত্যাদি রচনাগুলিও ছিল রবীন্দ্র ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। তবে সেগুলি ছিল মূলত গোঁড়ামির প্রভাব মুক্ত ধর্ম সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময়। তিরিশের দশকে যা খুঁজে পাওয়া যায় ‘মানুষের ধর্ম’ আলোচনায়। ১৯২২ থেকে ১৯৩১, মুক্তধারা, রক্তকরবী, কালের যাত্রা নাটকগুলির রচনাকালের মধ্যে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ একটি বিশ্বযুদ্ধ অতিক্রম করেছে। রুশ দেশের বিপ্লবের প্রভাবে উপনিবেশগুলির জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নতুন মাত্রা লাভ করছে। রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে সামনে থেকে দেখছেন। ফলে এই সময়ের নাটকগুলির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত রবীন্দ্র চিন্তায় সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির ধারনা অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

মুক্তধারার রচনাকালে রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় কোনো দৃঢ় প্রত্যয় অভিব্যক্ত না হলেও তিনি নিঃসন্দেহে ছিলেন ইয়োরোপীয় সমাজ ও সভ্যতা মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে ব্যর্থ। পরবর্তীতে আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাতে সেখানকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈভব, ঐশ্বর্যের বিপুল আয়তন ও শক্তির প্রবলতাকে তিনি দানবপুরীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তিনি ‘লক্ষ্মীর’ সঙ্গে তুলনা করছেন এবং এই দৈত্যাকার পুঁজিবাদী ধন সঞ্চয়কে তিনি ‘কুবেরের ধন সংগ্রহে’র সঙ্গে তুলনা করছেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজ সভ্যতা সম্বন্ধে দার্শনিক প্রজ্ঞা এই সাংকেতিক নাটকগুলির মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে পাই। মুক্তধারা নাটকের দৃশ্যপটের যে উপস্থাপনা করা হয়েছে তা নেহাতই সমকালীন দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য। এই নাটকে বিষয়বস্তুর মধ্যে সমকালীন দেশীয় ও বিশ্ব রাজনীতির প্রতিফলন। মুক্তধারায় উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ ও তার উদ্ধত প্রজাদের সংলাপগুলি দেশীয় ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের কণ্ঠস্বর। এবং এগুলি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কোনো সংশয় ছিল না। তবে নেশন ও ন্যাশনালিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ভিন্ন ধারার। তিনি মনে করতেন লোভ ও ব্যাক্তিস্বার্থের তীব্র দ্বন্দ্বের সংঘাতই নেশনের যান্ত্রিক উদ্দেশ্যের মর্মকথা। মুক্তধারার উপস্থাপনায় এই ভাবনারই অনুরণন এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশিত হচ্ছে রবীন্দ্র ভাবনায়। তবে ন্যাশনালিজমের সঙ্গে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য ও দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রবীন্দ্রচিন্তায় অনুপস্থিত। ফলে মার্কসীয় রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে রবীন্দ্র ভাবনাকে বিচার করা অনুচিত। মুক্তধারায় রবীন্দ্রভাবনার দ্বিমুখী প্রকাশ হয়েছে। একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অন্যদিকে পুঁজিবাদী সভ্যতার বীভৎসা ও উগ্র জাতীয়তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ইয়োরোপে ফ্যাসিবাদ সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দিলে রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধিতায় উপস্থিত হয়েছেন সামনের সারিতে। সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র সম্পর্কে ১৯২২’র রবীন্দ্র ভাবনার সঙ্গে সমকালীন ইতালীয় মার্কসবাদী আন্তোনিও গ্রামশি’র ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ভাবনার কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

পুঁজিবাদী শোষণের হিংস্র দিকটি রক্তকরবীতে আরও স্পষ্ট। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে (১৯২৩) শিলং শহরে বসবাসকালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন যক্ষপুরী, পরবর্তীতে নাম হলো রক্তকরবী। নাটকের যক্ষপুরীতে (পুঁজিবাদী ব্যবস্থা) শ্রমিকরা সকলেই এসেছে গ্রাম থেকে। একসময় তারা ছিল কৃষক অথবা কৃষি শ্রমিক। এখানে তাদের কোনো নামের পরিচয় নেই। দুঃসহ এক যান্ত্রিক জীবনে দিন কাটায় শ্রমিকেরা। নাটকের অন্যতম চরিত্র ‘বিশু পাগল’ বলছে, ‘গাঁয়ে ছিলুম মানুষ এখানে হয়েছি দশ-পঁচিশের ছক। বুকের উপর দিয়ে জুয়োখেলা চলছে।’ আরেক চরিত্র ‘চন্দ্রা’ জিজ্ঞেস করে, ‘কত দিনে কাজ ফুরোবে?’ উত্তরে বিশুর কণ্ঠে উঠে আসে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকের হতাশা। পুঁজিবাদে শ্রমিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকেও উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এই ব্যাবস্থায় মানুষ তার সৃষ্ট শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রজাতি সত্তা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়। মার্কসের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের অনুরণন আমরা রক্তকরবীর সংলাপে খুঁজে পাই। বিশু বলছে, ‘পাঁজিতে তো দিনের শেষ লেখে না। একদিনের পর দু’দিন, দু’দিনের পর তিন দিন; সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দু’হাত, দু’হাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দুতাল, দুতালের পর তিন তাল। যক্ষপুরে অংকের পর অংক সার বেঁধে চলেছে, কোনো অর্থে পৌঁছয় না। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা।...’ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার শুরু থেকে আজকের ফিনান্স নেতৃত্বকারী নয়া উদারবাদে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা আজও রক্তকরবীর যক্ষপুরীর মানুষদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আজ উৎপাদন ও অর্থনীতির ধরন বদলেছে, বদলে চলেছে। কিন্তু লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেখানে মানুষের প্রাণময় অস্তিত্ব অপেক্ষা মুনাফা প্রধান লক্ষ্য। ১৯২২-২৩-এ রবীন্দ্রনাথ যখন মুক্তধারা ও রক্তকরবী লিখছেন তখনও তিনি লোভ আর লালসার দৈত্যাকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা দেখেননি। বিকল্পের সন্ধান তিনি প্রথম পেলেন ১৯৩০-এ রাশিয়া ভ্রমণের সময়।

রক্তকরবীতে কখনও ব্যঙ্গ কখনও সরাসরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নগ্নতা ও অমানবিকতা প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সাথে সাথে স্পষ্ট হয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অসারতা ও অক্ষমতা। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এর জোর কেবল শক্তিতে, শোষণে, মানুষের মুক্তির পথে নয়। রক্তকরবীর ‘রাজা’ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিভূ। মার্কসীয় ভিত্তি-উপরিকাঠামো তত্ত্বের নিরিখে বললে রাজাকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চিহ্নিত করা অমূলক হবে না। লেনিন বলেছেন, প্রকাশভঙ্গি যেমনই হোক না কেন শেষ বিচারে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বুর্জোয়া শ্রেণির একনায়কত্ব। এখন আমরা যদি রক্তকরবীর রাজাকে এই ভাবনা কাঠামোর মধ্যে বিচার করতে চাই সবটা সঠিক হবে না। তবে ভাবটা গ্রহণ করতে পারি। আজকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া সংকটগ্রস্থ নয়া উদারবাদে সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। এই ব্যবস্থার ভিতরে সীমাবদ্ধতার কারণে সংকট পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। এখানে মনে পড়ে যাবেই রক্তকরবীর রাজার সেই আকুতি, যা আসলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অনতিক্রম্য সংকট। পরিত্রাণের পথ খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত অবশ্যম্ভাবী বৃহত্তর সংকটে জুড়িয়ে যায় জড়িয়ে যায় পুঁজিবাদ। রাজার আকুতি আসলে পুঁজিবাদী সংকট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা। রাজা বলছেন, ...‘আমি এক প্রকাণ্ড মরুভূমি - তোমার মতো একটি ছোট্ট ঘাসের (নন্দিনী) দিকে হাত বাড়িয়ে বলছি, আমি তপ্ত, আমি রিক্ত, আমি ক্লান্ত। তৃষ্ণার দহে এই মরুটা কত উর্বরাভূমিকে লেহন করে নিয়েছে, তাতে মরুর পরিসরই বাড়ছে, ঐ একটুখানি দুর্বল ঘাসের মধ্যে যে প্রাণ আছে তাকে আপন করতে পারছে না।’

বিশ শতকের গোড়ায় লেনিন চিহ্নিত করলেন পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আজকের ফিনান্স নেতৃত্বকারী লুটেরা পুঁজিবাদের চরিত্র বদলেছে, কিন্তু অন্তর বিরোধ ও সংকট একটুও কমেনি বরং বেড়েই চলেছে। মার্কসবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতির এই গতির সঙ্গে রবীন্দ্র ভাবনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কী তার অর্থনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক কারণ, তা অবশ্য বলা কঠিন। রক্তকরবীতে রাজা আক্ষেপ করে বলেন, ...‘আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না।’ ...কিংবা, ...‘আমারই শক্তি দিয়ে আমাকে বেঁধেছে।’ নিজের সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভালো থাকে না। থাকে শুধু টিকে, রক্তকরবীতে অধ্যাপককে নন্দিনী জিজ্ঞেস করছে, ‘দিনরাত এই মানুষ ধরা ফাঁদের খবরদারি করে এরা একটুও কি ভালো থাকে?’ অধ্যাপক বলেন, ‘ভালোর কথাটা এর মধ্যে নেই, থাকার কথাটাই আছে। এদের সেই থাকাটা এত ভয়ংকর বেড়ে গেছে যে লাখো লাখো মানুষের উপর চাপ না দিলে এদের ভার সামলাবে কে? জাল তাই বেড়েই চলেছে। ওদের যে থাকতেই হবে।’ ব্যবস্থার ভিতর থেকে সৃষ্ট সংকটের বোঝা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপকের এই সংলাপগুলো কি রবীন্দ্রনাথ এটা ভেবে লিখেছিলেন? বলা কঠিন। তবে আজকের সময়ে অধ্যাপকের এই সংলাপগুলি এই কথাই মনে করায়।

...‘একদিন দূরদেশে আমারই মতো একটা ক্লান্ত পাহাড় দেখেছিলুম। বাইরে থেকে বুঝতেই পারিনি তার সমস্ত পাথর ভিতরে ভিতরে ব্যথিয়ে উঠেছে। একদিন গভীর রাতে ভীষণ শব্দ শুনলুম, যেন কোন্ দৈত্যের দুঃস্বপ্ন গুমরে গুমরে হঠাৎ ভেঙে গেল। সকালে দেখি পাহাড়টা ভূমিকম্পের টানে মাটির নিচে তলিয়ে গেছে। শক্তির ভার নিজের অগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে, সেই পাহাড়টাকে দেখে তাই বুঝেছিলুম।’ রবীন্দ্রনাথ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী নন। ফলে মার্কসীয় বিচার পদ্ধতি দিয়ে রবীন্দ্র ভাবনাকে দেখা যায় না। তবে রক্তকরবীর রাজার এই আক্ষেপ ও আকুতি মনে করাচ্ছে ক্যাপিটালে-র অমোঘ উপলব্ধি, সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য পুঁজি তার মালিককেও শূলে চড়াতে দ্বিধা করে না; কিংবা ২০০৮’র সংকটে লেম্যান ব্রাদার্স কিংবা আজকের দিনে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক উঠে যাওয়ার ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের মতো করে এই বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করার পথ খুঁজতে চেয়েছেন। যেখানে বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গে মার্কসীয় ভাবনার মিল খুঁজতে যাওয়া সঠিক হবেনা। বিশেষত ১৯২২ কিংবা ১৯২৩-এ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্বযুদ্ধকে দেখার অভিজ্ঞতা থাকলেও পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিকল্প তখনও তিনি দেখেননি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিকল্পের সন্ধান তিনি পেলেন ১৯৩০-এ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় পৌঁছে।

পুঁজিবাদী বীভৎসতার অবসানের যে পথ তিনি খুঁজছেন রুশ দেশে গিয়ে তার কিছুটা ধারণা তিনি পেলেন। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী হলেন এই ব্যবস্থাকে ভাঙতে হবে এবং ভেঙে গড়তে হবে। এবং ভাঙার কাজে নেতৃত্ব দেবে শ্রমজীবী মানুষ। চিন্তার উত্তরণের স্পষ্ট প্রকাশ কালের যাত্রা নাটকে। রক্তকরবী প্রকাশের আট বছর পরে কালের যাত্রা প্রকাশিত হয়েছে। নাটিকাটির প্রথম নাম ছিল রথের রশি। মহাকালের রথের চাকা এক পাও এগোবে না, যদি শূদ্র পাড়ার মানুষদের স্পর্শ রথের রশিতে না পড়ে। শূদ্র বলতে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষদের, যারা দলিত নিপীড়িত শোষিত। এদের শ্রমেই এই সভ্যতার আলো বিচ্ছুরিত হয়, অথচ এরাই আজ সমাজে বঞ্চিত ও অচ্ছুত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এরা সভ্যতার পিলসুজ। বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ভারতীয় সমাজে এই শূদ্রদের অংশই শ্রেণিগতভাবে শ্রমজীবী। রুশ বিপ্লবের পরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। সংগ্রামে শ্রমিক ও কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটতে শুরু করে। স্বাধীনতার সংগ্রাম ক্রমশই পূর্ণ স্বরাজ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার পথে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় ভারতের সামন্ত শ্রেণি ও পুঁজিপতি শ্রেণি আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের মধ্যে মিতালি করে নিয়েছে। ভারতীয় সমাজ বিকাশের এটাই অন্যতম প্রধান নেতিবাচক দিক, যার অবশেষ আজও বহন করতে হচ্ছে। ‘ভবিষ্যৎ’ ভারতের শাসক শ্রেণির এই আতঙ্কের কথা শোনা যায় কালের যাত্রা নাটকে।

মার্কসীয় দর্শনে থিসিস, অ্যান্টিথিসিস এবং সিন্থেসিস ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। মার্কস এই ধারণা গ্রহণ করেছেন দ্বান্দ্বিক ভাববাদী হেগেল দর্শন থেকে। তবে হেগেল দর্শনে দ্বন্দ্ব রয়েছে ‘স্পিরিটের’ একটি অবস্থা থেকে আরেকটি অবস্থায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের মধ্যে। অবশ্য তা শেষ পর্যন্ত স্পিরিটের আত্মমুক্তি ঘটিয়ে নিজের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্ব পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ঘুরতে থাকে। মার্কস দ্বান্দ্বিকতাকে প্রয়োগ করেছেন সমাজে। মার্কসের দ্বন্দ্বতত্ত্বে থিসিস অ্যান্টিথিসিস ও সিন্থেসিসের প্রক্রিয়ায় ‘সিন্থেসিস’ নতুন একটি ‘থিসিস’ হিসেবে উপস্থিত হয়। কিন্তু ধারাবাহিক এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। যা হেগেল দর্শনে অনুপস্থিত। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় এই উপাদান রয়েছে। তবে এই উপাদান রয়েছে ভাববাদী রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনা ও ভঙ্গিতে। কালের যাত্রা’য় উচ্চ বর্ণগুলি যদি থিসিস হয়, তবে শূদ্র জনগণ অ্যান্টিথিসিস। শূদ্র জনগণের হাতের ছোঁয়ায় মহাকালের রথ চলতে থাকে এটাকে আমরা সিন্থেসিস বলতে পারি। ভাববাদী রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মধ্যে থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস হেগেলের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিজের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় না। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মার্কসের ভাবনার অনুরণন তুলেই তা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এখানেও সিন্থেসিস নতুন একটা থিসিস হিসেবে উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা কালের যাত্রা-তে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে,
তারপর কোন এক যুগে কোন এক দিনে
আসবে উল্টো রথের পালা।
তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া।


রবীন্দ্রনাথ এই পৃথিবীর বহুত্বের মাঝে নিজের সমাজের শিকড়ের সন্ধান করতে চেয়েছেন এবং শিকড় সংলগ্ন থেকেই বুকের মাঝে বিশ্ব লোকের সারা পেতে আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাবনায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাস্তবের সমস্যা দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে জীবনোত্তর সত্যে পৌঁছানোর আকুতি আছে। বাস্তব দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে নতুন বিকল্পের স্তরে পৌঁছানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা রবীন্দ্রনাথের একটি পর একটি নাটকে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পর ভবিষ্যৎ বিশ্ব যে শ্রমজীবী জনতার পথে এই সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। মার্কসবাদী না হয়েও রবীন্দ্রনাথ শ্রমজীবীদের এই এগিয়ে চলাকে তাঁর উত্তরকালের প্রায় সকল ভাবনাতেই স্বাগত জানিয়েছেন। মাঝে মাঝে সতর্কতাও উচ্চারণ করেছেন। একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং মানবতাবাদী রূপে মানুষের সামাজিক অবস্থান ও সমাজের গতিধারা উপলব্ধি করবার ক্ষেত্রে প্রকৃত মার্কসবাদীদের সাথে রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য বোধহয় খুবই কম।