৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০
চেতনার সর্বোচ্চ মিনার
তন্ময় ভট্টাচার্য
ইয়োরোপের কবি ইয়েটস গোলাপ বাগানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শঙ্খের আহ্বান শুনেছিলেন। সংকীর্ণতার শাসন ভাণ্ডারের বিরুদ্ধে এ ছিল শিকল ভাঙার বলিষ্ঠ উচ্চারণ। অর্ধেক উনিশ আর অর্ধেক বিশ শতকের মানুষ রবীন্দ্রনাথ বণিক ইংরেজ আর শাসক ইংরেজকে দেখেছিলেন। পুঁজিবাদের ক্রূরতা এবং হিংস্রতাকে দমন করে একদিন যে সমাজবাদ মাথা তুলে দাঁড়াবে, বুর্জোয়া সংস্কৃতির উদারতাকে পূর্ণতর করে সমৃদ্ধ করবে সমাজবাদী মানবিকতায় তা কবি বুঝেছিলেন। কেবলমাত্র বিশ্বাসে মত্ত হয়ে উত্তরণের মন্ত্র পাঠ করে অথবা রাজনৈতিক ফর্মুলার জোরে মানবিক শিল্পের সর্বজনীন মূল্যকে বাতিল করার চোরা গলিতে এ পথের প্রগাঢ় অনুশীলন সম্ভব না। সমাজ সমুদ্রের ঢেউয়ে নতুন তাঁর খোঁজার দুঃসাহস কবির কাম্য। শেষপর্যন্ত তিনি ঘোষণা করেছেন – "মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ"। লেনিনের পুঁজিবাদ থেকে সাম্রাজ্যবাদে উত্তরণকে রবীন্দ্রনাথ কি তাঁর মতো করে ‘ছোটো ইংরেজ’ ও ‘বড় ইংরেজ’ রূপে দেখেছিলেন? তাঁর ‘কালের যাত্রা’ নাটকের তৃতীয় সৈনিকের এই অসাধারণ কালাতিক্রমী মন্তব্যটি আজও সমভাবে প্রযোজ্য। এ কালের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে, /পিছনে থাকে বেনে। /যাকে বলে অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্ত্তি।’ যদি উদ্ধৃতির শেষাংশ বণিক ভারতসম্রাটের দিকে উদ্দিষ্ট হয় তাহলে সে কি পুঁজিবাদের রূপে ছোটো ইংরেজ। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে শাসনভার চলে যাওয়াটা সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার। রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যাদী শক্তির আধিপত্য দেখেছেন, নতুন সমাজবাদী রাশিয়াকেও নিজের চোখে দেখেছেন। আশ্চর্য হয়েছেন, চিঠিতে তাঁর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু ভারত সহ তৃতীয় দুনিয়ার বা প্রান্তিকায়িত মানুষের কান্না শুনলেও তৃতীয় বিশ্ব শব্দটার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেনি। এই শব্দটার জন্ম রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দেড় দশক পরে। কিন্তু তাঁর চিত্রা’, ‘বলাকা’, ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’, ‘অচলায়তন’, ‘রথের রশি’-র ছত্রে ছত্রে সেই দুনিয়ার বাস্তব অস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলে নতুন পথের অভিযাত্রায় তাদের শামিল করে গেছেন।
সাহিত্য সবসময়ই স্রষ্টার কল্পনা ও পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিতের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রতিফলন। প্রথমটা ভাবজগৎ হলে দ্বিতীয়টা বস্তুজগৎ। এই দুই জগতের সম্পর্ক সরলরৈখিক না। কারণ প্রত্যেক স্রষ্টাই একই সাথে ব্যক্তি মানুষ ও নৈর্ব্যক্তিক সৃজনশীলতার অধিকারী। যে কোনো সৃজনেই একটা জননীত্ব সুপ্ত থাকে। সৃষ্টি জন্মায় স্রষ্টার জননীসত্তা থেকে। প্রতিদিনের ব্যক্তি মানুষ সেই সৃষ্টিযজ্ঞের সমিধ সংগ্রহ করে চলেন অনবরত। যে রবীন্দ্রনাথ কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক লেখায় স্বচ্ছন্দে সাবলীলভাবে বিচরণ করেন, তিনি রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, ধর্ম সম্পর্কে অসামান্য বস্তুনিষ্ঠই শুধু নন, তা নিয়ে বহুদিনের রসদ যোগানোর মতো লিখতেও অগ্রসর। ‘বিশ্ব পরিচয়’-এর মতো বই যে অসাধারণ দক্ষতার ফসল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল পুঁজিবাদের সংকটকে। আর বাঙালি পাঠকের কাছে রক্তকরবী’র রূপকের কাঠিন্য ভেঙে সহজ সরল কথায় ‘সভ্যতার সংকট’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পৃথিবীর ইতিহাস আজও আধুনিকতম প্রবন্ধের তালিকা তৈরি করলে ‘সভ্যতার সংকট’ তাতে অন্যতম শীর্ষ অবস্থানেই থেকে যায়। সমাজের অচলায়তন ভাঙবার লড়াই তখন রাস্তা খুঁজছে গোটা দেশেই। সমাজকে বদলাবার স্বপ্ন মাথা তুলছে। চিন্তার সংকটপথের সমাধানে তখনও অগ্রসর বাঙালি। আর তা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও ভাবনা যে দেশের অন্যান্য বেশি জায়গা পেয়েছিল এই বাংলায় তারও অনেকটা কৃতিত্ব রাশিয়ার চিঠি-র।
‘পণ্ডিতের মূঢ়তা’, ‘ধনীর দৈন্যের অত্যাচার’ যাঁকে যন্ত্রণাদগ্ধ করে, তাঁর পক্ষেই সম্ভব ‘মূঢ়-স্নান-মূক-মুখে’ ভাষা দেওয়া। তিনিই দেখতে পারেন গভীর দূরদৃষ্টিতে ‘দানবের সাথে সংগ্রামের তরে’ ঘরে ঘরে প্রস্তুতিকে। ‘অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের ঘাটে ঘাটে /পাঞ্জাবে বোম্বাই গুজরাটে’ তিনি সন্ধান পান সেই মহামানবদের যারা আসলে এ দেশের অগণিত শ্রমজীবী মানুষ। এখানেই কি লুকিয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক প্রলেতারিয়েতের সন্ধান?
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এই শ্রমজীবী মানুষের মতোই এদেশে প্রান্তিক জীবনযাপনে বাধ্য হয় মুসলমানরা এবং মহিলারাও। তিনি সেই দেশকে হতভাগ্য বলেছিলেন যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়। আবার পৃথিবীর কোথাও নারীদের অধিকারের দাবিতে একটিও সংগঠন গড়ে উঠবার আগেই, স্বাধীনতা অর্জনের এক দশকেরও বেশি সময় আগে, ১৯৩৬-এ তিনি বলেছিলেন মানবসভ্যতার ব্যবস্থাভার, যা এতকাল পুরুষের হাতে ছিল সেখানে মেয়েদের কাজের অনিবার্যতার কথা। নির্বিচার অন্ধ রক্ষণশীলতা যে সৃষ্টিশীলতার বিরোধী এবং সেইজন্যই তা বিজ্ঞান বিরোধী, অগ্রসরমানতা বিরোধী কূপমণ্ডুকতায় পরিপূর্ণ এ কথা যিনি বলতে পারেন - তিনি আমাদের প্রাণের আরাম, মনের প্রশান্তি, চিত্তের উদারতা না আনলে, কে তা আনবে? এমন বহুমুখী বিস্ময়কর সৃষ্টি প্রতিভা এবং বিপুল ব্যাপ্তির সৃজন ভাণ্ডার আর কোথাও নেই। রবীন্দ্রনাথের সমাজ চিন্তা-চেতনা-অনুশীলন-কর্মপ্রবাহের মূল সুরটি বাধা ছিল মানুষের নিত্য প্রবহমান জীবনধারার সাথে। মানুষের প্রতিই ছিল তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা। আর তাই তিনি আমাদের লোক হিসাবেই নিজেকে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন।
লোকায়ত প্রান্তরে এই মহান কবির আদর্শকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আজ অনেক বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর সময়ে তাঁর মনীষা, সমাজ সম্পর্কিত ভাবনা, মানবমুখী চিন্তা, সংস্কারবিহীন ধর্মবোধকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ না করলে এই হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর তুফানকে এড়িয়ে সুস্থতার পথে যাত্রা করা যাবে না। পৃথিবীজুড়ে মানুষের উপর মানুষের শোষণের যে কুৎসিত, কদর্য রূপের উৎকট প্রকাশ চতুর্দিকে, যে অমানবিকতা, অগণতান্ত্রিকতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাহার, বেকারি, কর্মসংকোচন, সাম্প্রদায়িকতা বিপর্যস্ত করছে কবির ‘বিপুলা পৃথিবী’কে সেখানে ‘পুরোনো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা’র দিন শেষ। ‘লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল’-এর মাঝখান দিয়ে পথ চিরে চিরে ‘নতুন সমুদ্র তীরে’ পাড়ি দেওয়ার জন্য যে যাত্রীদল প্রয়োজন তাদের প্রস্তুত করার মধ্যেই খুঁজে পেতে হবে সুমহান মূল্যবোধে উদ্ভাসিত রবীন্দ্রনাথকে। যে সমাজে দৈত্যরা জেগে উঠেছে, যে সমাজে মানুষের প্রাণ কেবলমাত্র দৈত্যদের খেলার জিনিস সেই দানবিকতা শেষ কথা হবে কি না সে প্রশ্ন নিজেদের কাছে করার সময় আজ উপস্থিত। রাজার হাতের চাবুক আর গোঁসাইয়ের গলার মালা যেখানে একই সুতোয় তৈরি হয় সেখানে দুর্গমকে পেরোতে হলে পরাণ দিয়ে সেতু বাঁধার কাজ করতে অগ্রসর হলে রবীন্দ্রনাথ আমাদের হাত ধরবেন।
রবীন্দ্র রচনায় প্রেম-পূজা-প্রকৃতি অনাবিল সৌন্দর্যময় কাব্য সুষমা নিয়ে একাকার হয়ে মানবহৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে প্রকাশ করেছে অপূর্ব কাব্যময় ছন্দের ভাবাবেগ নিয়ে। তাঁর গানের বাণী, তাঁর সুরের মেলবন্ধন মানুষের মনের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে হাজারো অনুভবের বাজনা বাজিয়েছে। আবার একই সাথে বহমান সমাজের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল বাস্তবধর্মী সমস্ত দ্বন্দ্বকে তিনি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর রচনায়। কারণ খুঁজেছেন, প্রতিকার চেয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন, প্রতিবাদে সংগ্রামের ডাকও দিয়েছেন। মানবতার যেকোনো অপমান, জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ-সাম্প্রদায়িকতা-সঙ্কীর্ণতাময় সামাজিক বাস্তবতাকে বজ্রকঠিন দৃঢ়তায় রুখে দিতে চেয়েছেন ‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্রে’ দাঁড়ানোর আহ্বানের মধ্য দিয়ে। এই আহ্বান বরণ করেছে বাংলা। একজন মানুষ মানে যে একটা পরিক্রমা তা স্পষ্ট করেছেন জন্মসূত্রে পাওয়া অভিজাত জমিদারতন্ত্রের চিন্তা ভাবনা থেকে ক্রমান্বয়ে উপনিষদীয় উদার ও শিল্পসম্মত ঈশ্বর চেতনার পথ হাঁটতে হাঁটতে যৌবনে পাশ্চাত্যের আধুনিক মননের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তার গ্রহণযোগ্য অংশকে সাদরে আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে। ব্রাহ্মসমাজের আচার বিচার মুক্ত, পৌত্তলিকতা মুক্ত সংঘবদ্ধতা, স্বদেশ ভাবাবেগ ও তজ্জনিত গণচেতনার অবিমিশ্র ঘাতপ্রতিঘাত থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার উন্মেষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস হুহুঙ্কারজাত অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হতে হতে প্রতিদিন নিজেকে আবিষ্কার করেছেন প্রগতির প্রশস্ত উঠোনে। ‘খুদে খুদে আর্যগুলো ঘাসের মতো’ গজিয়ে উঠলে যেমন উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তেমনই শান্তিনিকেতন শ্রীনিকেতন গড়ে তুলবার ব্যাপক কর্মযজ্ঞে গাঁয়ের সাধারণ কৃষককে শামিল করেছেন, আর গোটা পৃথিবীকে আকর্ষিত করেছেন শিক্ষার এই আনন্দনিকেতনে। মানুষকে ক্রমাগত মাথা নিচু করতে করতে অসহায় হতে দেখে শিশুর মতো বিলাপ করেছেন, যা ভারতবর্ষের সত্তার সঙ্গে মেলে না - তা সজোরে বলবার মতো সাহস দেখিয়েছেন বার বার। তাই রবীন্দ্রনাথ ভারতের সবচাইতে জ্যোতির্ময় আলোক।