৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০
মুক্ত করো ভয়
সৃজন ভট্টাচার্য
শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগ চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারকে রীতিমতো চিঠি লিখে আবদার করেছিলেন, ভারত ভাগ যদি নাও হয়, বাংলা ভাগের ব্যাপারটা ব্যর্থ হতে দেবেন না দয়া করে।
রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে রাখিবন্ধন করেছিলেন। মিছিল করেছিলেন।
অমিত শাহ বা নরেন্দ্র মোদি যখন টেলিপ্রম্পটার দেখে রবীন্দ্রনাথকে পাকড়াও করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন, পাশ থেকে কানে কানে কেউ এ কথা বলেন না তাঁদের কোনোদিন?
* * * *
১৯২৫। মুসোলিনির ইতালিতে সবেমাত্র দু’জন প্রতিবাদী সাংবাদিককে নিধন করা হয়েছে। ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি অফ মিলান-এর আমন্ত্রণে সেদেশে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। আলাপ হলো কার্লো ফর্মিচি ও গিসেপ্পো তুচ্চি নামের দুই অধ্যাপকের সাথে। ১৯২৬-এ মুসোলিনির বার্তাবাহক হয়ে তাঁরা এলেন শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী গঠনের কাজে সাহায্য করবেন, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোমে ফের ইতালি সরকারের অতিথি হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন তাঁরা। আমাদের দেশে যেমন অপকম্মো ঢাকার জন্য একটা জয় গোস্বামী বা অনুপম খেরকে কাজে লাগে স্বৈরাচারী শাসকদের, খুনজখমের অভিযোগে জর্জরিত মুসোলিনিরও তেমনই দরকার ছিল রবিঠাকুরের সার্টিফিকেট। রবীন্দ্রনাথ দরাজ হস্তে দিলেনও সে শংসাপত্র। Saint from the East, বিশ্বমানবতার প্রতীক রবীন্দ্রনাথ শেষমেষ ফ্যাসিবাদের সমর্থক হয়ে গেলেন? স্তম্ভিত বিলাপের রোল উঠল বিশ্বজুড়ে। সে সময়ের ইয়োরোপের আর এক বরেণ্য বুদ্ধিজীবী রমাঁ রলাঁ যোগাযোগ করলেন বিশ্বকবির সাথে, জানালেন, মুসোলিনি ঠিক ততটুকুই দেখিয়েছে যতটা সে দেখাতে চেয়েছে। তার বাইরে ফ্যাসিবাদের চেহারা নৃশংস, নির্মম, নির্লজ্জ, নগ্ন। কবি শুনলেন, বুঝলেন। ক’দিন পর ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় দীর্ঘ এক চিঠি লিখে জানালেন, তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। তিনি ফ্যাসিবাদকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রত্যাখ্যান করছেন।
ঠিক ৩ বছর পর, ১৯২৯। আজকে গুগলে ‘গ্রেটেস্ট ডিক্টেটরস অফ অলটাইম’ সার্চ করলে মুসোলিনি-হিটলারদের পাশাপাশি আরো যে লোকটার নাম ভাসিয়ে তোলে সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানদানন্দনরা, সেই জোসেফ স্তালিনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে পা রাখলেন রবিঠাকুর। লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবের পর সে দেশের বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। ‘রাশিয়ার চিঠি’ জানাচ্ছে, স্তালিনের দেশে না এলে রবীন্দ্রনাথের এ জন্মের মতো তীর্থদর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। একেবারে মূলে প্রভেদ। কেন? বিশ্বকবি লিখছেন, ‘‘এখানে এসে সব চেয়ে যেটা আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে, এই ধন-গরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভূষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে, এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনি আনন্দিত হয়েছি। মানুষে মানুষে ব্যবহার কী আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে।’’
সমালোচনা ছিল। ছাঁচে ফেলা মানুষ নিয়ে। সে সমালোচনার সারবত্তা সোভিয়েত পতনের সময়ে প্রমাণিতও হয়েছে অনেকাংশে। তথাপি, সোভিয়েতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের টান কমেনি শেষদিন অবধি। ১৯৪১-এর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কাছে মৃত্যুপথযাত্রী রবিঠাকুর জানতে চাইছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে মানবতার সম্মুখসমর তখন। পি সি মহলানবিশ জানালেন, ফ্যাসিস্টরা এগোচ্ছে, তবে - লালফৌজ প্রতিরোধ শুরু করেছে। দু’চোখে আলোর ঝিলিক নিয়ে মরণাপন্ন বিশ্বকবির উত্তর, পারবে, ওরাই পারবে।
তোজোর নানকিং আক্রমণের পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।’ ফ্যাসিবাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার ৩ বছরের মাথায় যাবতীয় অপপ্রচারের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে ভালোবেসে বরণ করেছিলেন সমাজতন্ত্রকে। যারা ইতিহাসের অবসান ঘোষণা করেছিল, যারা লেনিনকে ‘গুডবাই’ বলে দিয়েছিল, যারা বাম বিদায়ের আনন্দে শুধু ময়দানের কৃষ্ণচূড়া ছাড়া আর কোত্থাও লাল খুঁজে পাচ্ছিল না - তাদের আরেকবার মনে করানো প্রয়োজন, লালঝান্ডার পাশে রবীন্দ্রনাথ আছেন। উলটোদিকে? খুব বড়োজোর কঙ্গনা রানাওয়াত।
* * * *
প্রলেতারিয়েতের বাংলা করেছিলেন, আত্মশ্রমবঞ্চিত শ্রেণি। ‘লাঙল’ পত্রিকার জন্য লিখেছিলেন - ‘প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।’ মূলত সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৌজন্যেই তাঁর বাড়ি ছিল কমিউনিস্ট কর্মীদের যোগাযোগের আস্তানা। আবদুল হালিম, মুজফ্ফর আহ্মদ, কাজী নজরুল ইসলাম, সরোজ মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ লাহিড়ী, আনাগোনা ছিল অনেকেরই। সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির কাজে দেখা করতে গিয়েছিলেন জ্যোতি বসুও। রবীন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট ছিলেন না। তবে, তিনি সঠিক সময়ে সঠিক পক্ষ নিতে দ্বিধাবোধ করেননি। ‘লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার’-এর ভারতীয় চ্যাপটারের সভাপতি ছিলেন। যে দৃঢ়তায় জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর ত্যাগ করেছিলেন ব্রিটিশের নাইটহুড, সে প্রত্যয়েই লিখেছিলেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’
আজকের ভারতে চোখ ফেললে একঝলকে যে সংকটের চিত্র উঠে আসে, তা সম্বন্ধে বিশ্বকবির অভিমত কী হতো, তা সহজেই অনুমেয়। ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে তাঁর দেওয়া ভাষণ থেকেঃ ‘‘হিন্দু মুসলমানের আত্মীয়তায় এত বিরোধ কেন? শস্যের সমান ভাগ নিয়ে দর কষাকষি - অন্নের ভাগ কমে গেছে - তাই মারামারি। যে দিন হিন্দু মুসলমান উভয়ে সমান ভোগ করবে, তখন দরদ হবে, আনন্দ নিকেতনে তখন উভয়ের অমৃত উভয়ের পাতে পড়বে। যে দিন প্রাচুর্য হবে, সেদিন বিরোধ ঘুচে যাবে।... একত্র সৃষ্টি দ্বারা - দেশকে সৃষ্টি করতে হবে।’’ অর্থনৈতিক অসাম্য যে সাধারণ জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ সহজে বপন করে ফেলার অন্যতম প্রাক্শর্ত, তা বিলক্ষণ জানতেন রবীন্দ্রনাথ। যখন ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’ ঘোষণা করছে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি তাকে ধিক্কার জানিয়ে বলছেন, এ হলো আসল সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর ছল।
হয়তো সে কারণেই, ভাগের রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘একত্র সৃষ্টি দ্বারা দেশকে সৃষ্টি করা’র উদাহরণরূপে দেখতে পেয়েছিলেন সোভিয়েতকে।
বিজেপি ২৫ বৈশাখের ছুটি বাতিল করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী। ডারউইন, মার্কস থেকে রবীন্দ্রনাথ - প্রগতির পথিকেরা আরএসএস-এর সিলেবাস থেকে বাদ পড়বেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের। আমাদের মানে, শুধু লালঝান্ডার না। আমরা, যারা যা কিছু মানবিক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, শুভবোধসম্পন্ন - তার পক্ষে। ওয়ারশ-র কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে হিটলারের হাতে খুন হতে চলা শিশুদের নিয়ে ‘ডাকঘর’ মঞ্চস্থ করানো হয়েছিল, মৃত্যুর মুখোমুখি জীবনের উদ্যাপনকে প্রস্তুত করতে। এ হেন রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার মোহন ভাগবতদের নয়। জীর্ণ পুরাতন ভাসিয়ে দিয়ে ভাঙনের জয়গান গাইতে পারে যারা, তাদের। আজ তাই, রবীন্দ্রনাথকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সময়। মালা পরানো ফোটোফ্রেম থেকে বার করে, ট্র্যাফিক সিগন্যালের গান থেকে বার করে, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এখন ফের মিছিলে হাঁটার সময়। জীবনানন্দকে ধার করলে বলতে হয়, রবিঠাকুর আমাদের - তিমিরবিনাশী আলোকবর্তিকা।
* * * *
আমরা এখনো ন্যূনতম সংশয়ে ফিরি ‘রক্তকরবী’ আর ‘তাসের দেশ’র কাছে। উত্তর দিকের জানালা খুলে অচলায়তন ভাঙার লড়াইতে জুড়ে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মে দিনে ভাসতে থাকে মনে, শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে, ওরা কাজ করে। রবীন্দ্রনাথ, আমাদের প্রাত্যহিকতায়, জীবনবোধে।
আমরা তাঁর কাছে আশ্রয় নিই, কাছে টানি। বিতর্ক করি তাঁর সাথে, কিন্তু, তাঁকে ছেড়ে যাই না।
‘‘এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।’’
সুকান্তর কথাই আমাদের কথা।
* * * *
খানিক হালকা চালে শেষ করা যাক। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন। মফস্সলে বামফ্রন্ট প্রার্থীর প্রচারে সভা করতে গিয়েছি। তখনও সভা শুরু হয়নি, মাইকে বাজছে বামেদের চিরাচরিত গানগুলি, ‘‘পথে এবার নামো সাথী’’ বা ‘‘কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে’’। এসএফআই-এর ছেলেমেয়েরা বায়না ধরল, ‘টুম্পা সোনা’ আর ‘লুঙ্গি ডান্স’-এর সুরে যে দু’টো প্যারোডি ব্যাপক হিট হয়েছে, সে দুটো চালাতে হবে। অতঃপর এসব ক্ষেত্রে যা হয়, নানা মুনির নানা মত, এবং কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য - তা নিয়ে তর্কবিতর্ক অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠা। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে চা খেতে-খেতে গল্প করছিলাম স্থানীয় পার্টিনেতার সাথে। বয়সে প্রৌঢ় ভদ্রলোক খানিক দেখলেন, তারপর মুচকি হেসে ছাত্রদের বললেন, ‘‘তোরা নতুন গান চাস, তাই তো? আমাদের পরিচিত ধাঁচের বাইরের কিছু, অথচ সাম্যের কথা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথাগুলোই ফুটিয়ে তুলবে, এমন কিছু, তাই তো?’’ ছাত্ররা সমস্বরে বলল, ‘‘হ্যাঁ।’’ ভদ্রলোক বললেন, ‘‘ইউটিউবে সার্চ কর, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ দ্যাখ তো কেমন লাগে।’’ প্রবলেম সলভড। মুহূর্তে।
শেষ বয়সের রচনা ‘সভ্যতার সংকট’-এর শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।’’
আমরা সেই সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় নিশান সাজাই।