E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০

মার্কসবাদ ও ধর্ম

সোমনাথ ভট্টাচার্য


ধর্ম নিয়ে মার্কসের বক্তব্য কী, এ প্রশ্ন করলে অধিকাংশ মানুষ এক কথায় বলবেন, মার্কস বলেছেন ধর্ম হলো ‘আফিম’। কথাটা কি সত্য?

হ্যাঁ, কথাটা সত্য কিন্তু খণ্ডিত সত্য। মার্কস অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে ধর্মকে যে ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, যে মরমী মন নিয়ে এর নিহিত সত্যকে উদ্ঘাটন করেছেন, তা সত্যিই অভাবনীয়। ১৮৪৪ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে লিখিত Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Law-র মুখবন্ধে মার্কসের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। সেখানে তিনি বললেন, ‘‘ধর্ম হলো নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, একইভাবে আত্মাবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হলো জনগণের জন্য আফিম।’’

এবার পুরো বাক্যটার দিকে নজর দিলে সহজেই বোঝা যায়, ওই অল্প বয়সেও কী গভীর প্রজ্ঞা নিয়ে মার্কস ধর্মের মর্মবস্তুকে উপলব্ধি করেছিলেন।

আমরা কি জানি না দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষ তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় অসুস্থ সন্তানকে যখন ওষুধ কিনে দিতে পারছেন না তখন তিনি ঈশ্বর কিংবা আল্লাহর উদ্দেশে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেনঃ আমার সন্তানকে তুমি রক্ষা করো। আর এভাবেই তো হৃদয়হীনের হৃদয় আর আত্মাহীনের আত্মা হয়ে ওঠে ধর্ম।

তাহলে ধর্ম আফিম কেন? কারণ মানুষের সামনে সে এক অলীক পৃথিবী নির্মাণ করে। শোষিত মানুষ ধর্মের নামে কিছুটা প্রশান্তি লাভ করে। চরম অত্যাচারিত মানুষ অত্যাচারে ন্যুব্জ হতে হতে ভাবে এ তার পূর্বজন্মের পাপের ফল। এ জন্মে এই কষ্ট ভোগ করলে মৃত্যুর পর অনন্ত স্বর্গবাস। যেন বেহেস্তের পরীরা তার অপেক্ষায় দিন গুনছে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবই মায়ার ছলনা। বাস্তব তার নাগাল পায় না। আফিম বা কোনো নেশার বস্তু যেমন মানুষকে মোহজালে আবিষ্ট করে মিথ্যাকে সত্য বলে ভাবায়; অলীক কল্পনার জাল বিস্তার করে; ঠিক সেভাবেই ধর্ম মানুষকে কল্পলোকে পৌঁছে দেয়। তখন সে ভুলে যায় দেবমন্দিরের চরণামৃত বা পীরের থানের মাটিতে সন্তানের অসুখ সারে না, তার জন্য চাই ওষুধ।

আর তাকে এই ভাবনার দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে তার দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক শোষণ। যদিও আর্থিকভাবে সম্পন্ন মানুষও একই ভাবনার শরিক হয় কিন্তু গরিবের ক্ষেত্রে আর্থিক সংকট তার কল্পলোকের বাসিন্দা হওয়ার পথকে সুগম করে। তাই মার্কস বোঝালেন, মানুষের কল্পলোকের এই মায়াময় সুখ হিসেবে ধর্মকে লোপ করাটা হলো মানুষের প্রকৃত সুখের দাবি করা।

এ থেকে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান যে, মার্কসের চোখে ধর্ম কী বলতে গিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ‘আফিম’ শব্দটি তুলে নিলে সমগ্র বিচারধারাতেই বড়োসড়ো ভুল হয়ে যায়। ধর্ম সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পূর্বোক্ত নিবন্ধেই মার্কস বললেন, ‘‘ধর্মীয় ক্লেশ হলো একাধারে বাস্তব দুঃখ কষ্টের বহিঃপ্রকাশ এবং একইসঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও বটে। তাই ধর্মের সমালোচনা হলো ধর্ম যার জ্যোতির্মণ্ডল সেই অশ্রু উপত্যকার সমালোচনা।’’

যখন ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে খুন করে, ধর্মের দোহাই দিয়ে উঁচু জাত নিচু জাতের বৈষম্য ঘটায়, আমার প্রাণাধিক প্রিয় দেশকে খণ্ডিত করে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার করা নব-নব সত্যকে অস্বীকার করে তা কি ‘অশ্রু উপত্যকা’ নয়? আর সেই অশ্রু উপত্যকায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় গরিব মানুষ। নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত মানুষ। এরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি, এদের যন্ত্রণাও সবচেয়ে বেশি। এই মানুষগুলোর যন্ত্রণা লাঘব করতেই শোষণহীন সমাজ গড়ার ডাক দিয়েছিল মার্কসবাদ। মার্কস এঙ্গেলসের মতবাদ।

রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম সমস্ত কিছুর প্রাণকেন্দ্রে যে মানুষ আর তার সমাজ সেটা মার্কস আমাদের সবসময় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাই তিনি বললেন, সামাজিক পরিস্থিতির থেকেই মানুষের চেতনা নির্ধারিত হয়, এর উল্টোটা কখনো হয় না। বললেন, ‘‘মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে নির্ধারণ করে না বরং উল্টোটাই হয়। অর্থাৎ মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নির্ধারণ করে।’’ এখান থেকেই তাঁর অনুসিদ্ধান্ত, ‘‘অধার্মিক সমালোচনার মূল বক্তব্য হলো মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করে, ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করে না।’’

অর্থাৎ মনুষ্য চেতনার যে কোনো অভিব্যক্তির মতো ধর্মও হলো সমাজ অস্তিত্বের ফসল; তার যুক্তি অথবা কারণ নয়। মার্কসের এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা বুঝতে পারি, ধর্ম নিজে কোনো সত্তা নয় এবং ইতিহাসের চালিকাশক্তির বাইরে তার স্বাধীন কোনো অস্তিত্বও নেই।

হ্যাঁ, একথা ঠিক ধর্মের গুরুত্ব ও তার ভূমিকাকে গভীর অনুসন্ধানী মন নিয়ে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি মার্কস তার কঠোর সমালোচনাও করেছেন। কারণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম বারবার শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার হয়েছে। গরিব মানুষের উপর অত্যাচার করার জন্য শাসকের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা দেখেছি যুগে যুগে অত্যাচারীরা ধর্মের নামে অত্যাচার করেছে। রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ও মৌলবাদীরা ধর্মের নামে মানুষের ওপর নিপীড়নের বোঝা চাপিয়েছে।

গীতায় বলা হলো, ‘‘কর্মেণ্য অধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন।’’ অর্থাৎ কর্ম করাতেই তোমার অধিকার, ফলের আশা করো না। সরাসরি খেটে খাওয়া মানুষকে ঠকানোর নিদান। ব্রাহ্মণ্যবাদ সেই কাজটি দাপিয়ে করে গেছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের মোজেস ঈশ্বরের নামে দাস মালিকদের নির্মমভাবে ক্রীতদাসদের ওপর অত্যাচার করার অধিকার দেন। যিশুর জন্মের আগে স্পার্টাকাসের কাহিনি সেই ঘটনার সাক্ষ্য দেয়। আজও ইসলামের নামে দেশে দেশে অন্ধকার আর কুসংস্কার নামিয়ে আনা হচ্ছে। নারীর শরীর আপাদমস্তক ঢেকে দেওয়া হচ্ছে কালো বোরখায়। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাঁদের শিক্ষার অধিকার। আবার মনুবাদের নাম করে বলা হচ্ছে নারীর কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। সে বাল্যে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। পৃথিবীতে শান্তির ললিত বাণী শোনানো বুদ্ধের অনুগামীরা মায়ানমারে নির্বিচারে অত্যাচার করছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। এই প্রত্যেকটি উদাহরণ ধর্মের নামে মানুষের ওপর অত্যাচার করার সাক্ষ্য বহন করে। আর পৃথিবীর সমস্ত ধর্মই বিজ্ঞানমনস্কতাকে উপেক্ষা করে।

মেহনতি মানুষ তার ভবিষ্যৎকে জয় করার সংগ্রামে বারংবার পিছিয়ে পড়ে ধর্ম, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের হাতছানিতে। তাই সেখান থেকে তাকে টেনে তোলার পথটাই দেখিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। তিনি অতীতের অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে আসার পথ খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন অবিরত। তাই ‘অন্ দ্য জিউইস কোয়েশ্চেন’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘‘এতদিন ইতিহাসকে কুসংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এখন সময় এসেছে কুসংস্কারকে ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার।’’ বলা বাহুল্য, এ কথা সবাই জানেন কুসংস্কার ধর্মের উৎপত্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

তবে ধর্ম কি শুধুই প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছে? কক্ষনো নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। মেহনতি মানুষের কথা বলা, সম্প্রীতির প্রশ্ন তুলে ধরা, মুক্তিযোদ্ধাদের দিশা দেখানোর লক্ষ্যে ধর্ম সহায়ক হয়েছে।

হিন্দুধর্ম শিখিয়েছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ অর্থাৎ পৃথিবীর সকল মানুষকেই নিজের আত্মীয় মনে করো। ওল্ড টেস্টামেন্টের যুগের আক্রান্ত, অত্যাচারিত মানুষগুলোর বংশধরদের নিউ টেস্টামেন্টের যুগে এসে যিশু আশ্রয় দিয়েছিলেন। হজরত মহম্মদ ৬২২ সালে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের সময় দাবি তুলেছিলেন, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি মিটিয়ে দিতে হবে। বুদ্ধ বললেন, ইহকাল পরকালের চিন্তা ছাড়ো, এই জন্মটাকে অর্থবহ করে তুলতে সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম প্রভৃতি অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করো।

এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ধর্মের নামে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কিছু কিছু মানুষ। মার্টিন লুথার কিংয়ের লড়াইয়েও খ্রিস্টধর্মের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদী মূল্যায়ন কখনোই একপেশে নয়, সবসময় দ্বন্দ্বাত্মক।

হের ডুরিং আওয়াজ তুলেছিলেন, রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস। অ্যান্টি ডুরিংয়ে জোরাল যুক্তি দিয়ে তিনি বললেন, মানুষের জাগতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। তাই যতদিন মানুষের ধর্মচিন্তার জাগতিক কারণগুলো বর্তমান থাকবে ততদিন জোর করে ধর্মকে বিলুপ্ত করা যাবে না। শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিস্তারের মধ্য দিয়ে ধর্মের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে সম্ভব? এঙ্গেলসের উত্তর, ‘‘সমাজ যখন সমস্ত উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিজে অধিগ্রহণ করে নিজেকে মুক্ত করবে, তখন মানুষের অস্তিত্ব বিরহ দূর হবে। সেই সঙ্গে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাবে।’’

কমরেড লেনিন এই আলোচনায় অংশ নিয়ে সমাজতন্ত্র ও ধর্ম রচনায় বললেন, ‘‘ধর্ম আধ্যাত্মিক পীড়নের অন্যতম প্রকার বিশেষ। চিরকাল অন্যের জন্য খাটুনি, অভাব ও নিঃসঙ্গতায় পীড়িত জনগণের ওপর সর্বত্রই তা চেপে বসে। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির সংগ্রামের অক্ষমতা থেকেই অনিবার্যভাবে উদ্ভূত হয় মৃত্যু পরবর্তী উত্তম জীবনের প্রত্যয়। ঈশ্বর শয়তান অলৌকিকত্ব ইত্যাদিতে বিশ্বাস। যারা সারাজীবন খাটে আর অভাবে নিমজ্জিত থাকে ধর্ম তাদের নম্রতা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষাদান করে স্বর্গীয় পুরস্কারের সান্ত্বনা দেয়। আর যারা অন্যের শ্রম শোষণ করে, আত্মসাৎ করে ধর্ম তাদের পার্থিব জীবনে বদান্যতা অনুশীলনের নির্দেশ দেয়।’’

ধর্মের দ্বারা স্বর্গপ্রাপ্তির প্রলোভন সম্পর্কে লেনিন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করলেন, ‘‘পরলোকে স্বর্গ সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রলেতারিয়েতের মতৈক্য অপেক্ষা পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নির্যাতিত শ্রেণির এই সত্যকার বৈপ্লবিক সংগ্রামের ঐক্য আমাদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।’’ নিঃসন্দেহে লেনিনই এ কথা বলবার সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মানুষ যিনি সত্যিই নভেম্বর বিপ্লবকে সফল করে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, রুশ দেশে মেহনতি মানুষের স্বর্গ রচনা করেছিলেন।

লেনিন শেখালেন, ‘‘ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে ঘোষণা করা উচিত। ...যেকোনো ধর্মে বিশ্বাস করা বা কোনো ধর্মই না মানায় সকলেই থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধর্মবিশ্বাসের জন্য নাগরিকদের অধিকারে কোনপ্রকার বৈষম্য কোনোক্রমেই সহ্য করা হবে না।’’

লেনিন বললেন, পার্টি কর্মসূচিতে নাস্তিক্যবাদের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে মেহনতি মানুষের প্রবেশপথে কখনই বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। যদিও পার্টির সদস্যদের ধর্মের মোহ মুক্ত করার ব্যাপারে তিনি সবিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদী কর্মসূচি রূপায়ণের কাজে যদি ধর্মীয় সংস্কার পেছন থেকে পা টেনে ধরে তবে এগিয়ে চলা খুবই মুশকিল। তাই একইসঙ্গে সেই সংগ্রামও জারি রাখতে হবে।

ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদীদের পৃথক পৃথকভাবে দুটি কথা মনে রাখতে হয়। প্রথমত, পৃথিবীতে ধর্মপ্রাণ মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক। তারা ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই সমাজে যে কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে এই অংশের মানুষকে বাদ দিয়ে সে কাজ কখনোই হতে পারে না। তাই এই সব ধর্মপ্রাণ মানুষকে সমাজবদলের বন্ধু হিসেবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কারের গাড্ডায় গিয়ে না পড়েন। এইসব মানুষকে যত্ন নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বোঝাতে হবে, তার পবিত্র ধর্মবিশ্বাসকে নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ীরা জুয়া খেলছে। তাই তাদের থেকে সাবধান। তারা তোমার ধর্মবিশ্বাসকে কলুষিত করে। ধর্মের গায়ে দাঙ্গার আগুন আর মানুষ খুনের রক্ত লাগায়। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করে। গরিবের রুটি রুজির লড়াইকে দুর্বল করে। মানুষের কাছে এ কথাগুলি সঠিকভাবে নিয়ে যেতে পারলে মানুষই তার বন্ধু এবং শত্রুকে চিহ্নিত করে প্রগতির পথে হেঁটে নতুন ইতিহাস রচনায় ব্রতী হবেন।

দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের কয়েকটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। ধর্ম যেহেতু বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত তাই সেখানে যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের গুরুত্ব খুব কম। ‘‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’’ - এটা যেখানে ভিত্তি সেখানে বিজ্ঞানমনস্কতার স্থান হতে পারে না। মার্কসবাদের একটি মৌলিক কথা গলো, ‘‘Doubt Everything’’ অর্থাৎ সবকিছুকে যাচাই করে দ্যাখো। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানচিন্তা রহিত, যুক্তিতর্ক বিবর্জিত ধর্মীয় ভাবনা অবশ্যই পশ্চাৎপদ ধারণা, এমনকী প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা। তাই এই ধারণা থেকে মুক্ত হতে না পারলে কমিউনিস্ট হবার কাজে, শোষনহীন সমাজ গড়ার কাজে আমরা অনেকটা পিছিয়ে পড়ব।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা উল্লেখ্য। ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি, সৌভ্রাত্র, ঔদার্যের হাজার কথা থাকলেও তার মধ্যে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলে বিভাজনের ধারা। হিন্দুধর্মের শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলল, ‘‘শৃণন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা।’’ অর্থাৎ শোনো পৃথিবীর মানুষ অমৃতের পুত্র কন্যারা। এবার আপনি পুরীর মন্দিরে যান। সেখানে প্রবেশদ্বারে লেখা আছে, অহিন্দুদের প্রবেশ নাস্তি। যে ধর্ম বিশ্ববাসীকে অমৃতের সন্তান বলে সম্বোধন করার ঔদার্য দেখাল সেই ধর্মই অহিন্দুদের তার মন্দির গৃহে প্রবেশের অনুমতি দিল না!

একইভাবে অমুসলিমরা হজ করতে পারেন না, অখ্রিস্টানরা ভ্যাটিকানে উপাসনা করতে পারেন না।

মার্কসবাদের বিশ্ববীক্ষায় এই সত্যগুলো আমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। তাই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আতস কাঁচের তলায় ফেলেই আমাদের ধর্ম সম্পর্কে সুস্পষ্ট, সত্যনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ, বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন করতে হবে সম্পূর্ণ নির্মোহ দৃষ্টিতে।

এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষকে আমাদের বুকে টেনে নেবার শিক্ষা দেয়। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মানবতার শত্রু হিসেবে চিনতে শেখায়। আর দু’চোখে সত্যের দীপ জ্বালিয়ে আঁধারের রাত পেরিয়ে যাবার দিশা দেখায়।