৬০ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১২ মে, ২০২৩ / ২৮ বৈশাখ, ১৪৩০
মার্কসবাদের বিকাশ এবং ভি আই লেনিন
অর্ণব ভট্টাচার্য
মার্কসবাদের সার্থক ও সৃষ্টিশীল বিকাশের ক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন ভি আই লেনিন। স্তালিনের মতে, ‘‘সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারার বিপ্লবের যুগে লেনিনবাদই হলো মার্কসবাদ”। অবশ্য এ মেয়ার, ই উইলসন, ই বসেনস্কি’র মতো একশ্রেণির তাত্ত্বিক মার্কসবাদ ও লেনিনবাদকে পরস্পর বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতে মার্কস ছিলেন মূলত একজন তাত্ত্বিক আর লেনিনের প্রধান নজর ছিল প্রয়োগের দিকে, আর সে কাজ করতে গিয়ে তিনি নাকি যেকোনো পন্থা অনুসরণ করতে দ্বিধা করেননি অর্থাৎ লেনিন মার্কসবাদের নানা বিকৃতি ঘটিয়েছেন। লেনিনের কর্মধারার বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা করলেই লেনিনবাদের তাৎপর্য এবং এহেন বিরূপ সমালোচনার অসারতা অনুধাবন করা সম্ভব।
ঊনবিংশ শতকে রাশিয়ায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিকশিত হচ্ছিল পুঁজিবাদ। তীব্রতর হচ্ছিল শোষণ, বাড়ছিল জন-অসন্তোষ। এই সময় জার বিরোধী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা রাশিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং গুপ্ত সমিতিগুলির তৎপরতা ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। নিহত হন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। লেনিনের বড়দা এই হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেও লেনিনের পথ ছিল ভিন্ন। মার্কসীয় মতবাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ লেনিন শ্রেণিসংগ্রামের পথেই শোষণ ও বঞ্চনাকে উৎখাত করবার শিক্ষা আত্মস্থ করেছিলেন। এই সময় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর দল যারা নিজেদের ‘নারদনিক’ নামে পরিচয় দিত তারা মনে করতেন যে, কৃষকদের দ্বারাই বিপ্লব সম্পন্ন করা যাবে। ১৮৯৪ সালে তরুণ লেনিন এই ভ্রান্ত মতবাদকে খণ্ডন করবার জন্য লিখলেন, ‘‘জনগণের বন্ধু’ কারা আর তারা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করে’’। লেনিন একাধারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্রমিকশ্রেণির বৈপ্লবিক নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা ও বিপ্লবী শ্রমিকদের সাথে কৃষকদের মৈত্রীর গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হাজির করলেন। লেনিন বোঝালেন যে, রাশিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে হবে এবং এজন্য প্রয়োজন মার্কসবাদের আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠন। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কালে লেনিন বলশেভিকদের ‘জমি জাতীয়করণে’র স্লোগান পরিবর্তন করে ‘শান্তি, রুটি, জমি’র স্লোগান উত্থাপন করেন, কেননা দরিদ্র কৃষকদের প্রাথমিক চাহিদা ছিল জমির মালিকানা লাভ ও সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের অবসান। রাশিয়ায় বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উত্তরণের ক্ষেত্রে কৃষক সম্প্রদায় সর্বহারার মজুতবাহিনী হিসেবে বৈপ্লবিক রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করে।
মার্কসবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে লেনিনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান, বিপ্লবী পার্টির কাঠামো ও চরিত্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করা। মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আলোচনা করলেও এই ভাবনাকে বিকশিত করে সুসংহত রূপ দেন লেনিন। ‘‘ইসক্রা’’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদকীয়তে এবং পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে লেখা ‘কী করিতে হইবে’ বইতে আরও বিস্তারিতভাবে বিপ্লবকে সাফল্যমণ্ডিত করার প্রথম ও প্রধান শর্ত হিসেবে শ্রমিকশ্রেণির একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তোলার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়। ১৯০৩ সালে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন বলেন যে, শ্রমিকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত নিছক অর্থনীতিবাদে রূপ পায় যেমন হয়েছিল ব্রিটেনের চার্টিস্ট আন্দোলনে। এই অর্থনৈতিক সংগ্রামকে রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপ দিতে হলে এমন এক বিপ্লবী পার্টি তৈরি করতে হবে যা মার্কসবাদে দীক্ষিত পেশাদার বিপ্লবীদের দ্বারা পরিচালিত হবে। মার্তভের নেতৃত্বাধীন একদল চেয়েছিলেন পার্টি হোক ঢিলেঢালা। যারা পার্টিকে চাঁদা দেবে ও পার্টি নীতি সমর্থন করবে, তারাই হবে পার্টি সদস্য। এই মতকে খারিজ করে লেনিন বলেন, পার্টি সভ্য সেই হতে পারবে যে পার্টি কর্মসূচি মানে, পার্টিকে চাঁদা দেয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো একটি পার্টি সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার কাজে অংশ নেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা লেনিনের মতবাদের পক্ষে ছিলেন, যারা বলশেভিক নামে পরিচিত হন, আর বিরুদ্ধবাদীরা মেনশেভিক। পার্টির অভ্যন্তরে উদারবাদ ও সুবিধাবাদের বিপদের দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে লেনিন লেখেন ‘এক কদম আগে, দু কদম পিছে’ নামে তাঁর অতি পরিচিত বইটি। এখানে তিনি বললেন, “পার্টি প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম সাফল্যের সঙ্গে শুধু তখনই পরিচালনা করতে পারে যখন তার সমস্ত সভ্য একক বাহিনীতে ঐক্যবদ্ধ, একই সংকল্প, কর্ম ও শৃঙ্খলায় সংহত, যখন তা বৈপ্লবিক তত্ত্বে সশস্ত্র।” এখানে লেনিন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার তত্ত্ব হাজির করেন এবং পার্টি সদস্যদের সক্রিয়তা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সমালোচনার অধিকার ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। মার্কসবাদের বিকাশ ও সর্বহারার শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসে কমিউনিস্ট পার্টির লেনিনীয় ধারণার এক ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে।
মার্কসবাদী হিসেবে লেনিনের অনন্য ভূমিকার কথা আলোচনা করতে হলে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দর্শনের জগতে প্রত্যক্ষ বিচারবাদের বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের কথা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। ১৯০৫ সালের বিপ্লবী প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর যখন রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জার প্রশাসন বিপ্লবীদের ওপর ভয়ঙ্কর শারীরিক নির্যাতন নামিয়ে এনেছে, তখন বস্তুবাদের উপর মতাদর্শগত আক্রমণ সংঘটিত করে অস্ট্রিয় পদার্থবিজ্ঞানী ই মাখ এবং আর আভেনারিয়ুসের প্রত্যক্ষ বিচারবাদ তত্ত্বের অনুসারী একদল রুশ তাত্ত্বিক। এরা বস্তুবাদী চিন্তাধারাকে নস্যাৎ করে ভাববাদের পুনরুজ্জীবনে প্রয়াসী হন। শারীরিক ও বৌদ্ধিক দুই স্তরের আক্রমণকে প্রতিহত না করতে পারলে যে শ্রমিকশ্রেণির লড়াইকে কোনোমতেই টিকিয়ে রাখা যাবে না তা অনুভব করেছিলেন কমরেড লেনিন। তাই ১৯০৮ সালে তিনি লিখলেন ‘বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদ’। প্রত্যক্ষ বিচারবাদীদের মতে বস্তুজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয় সংবেদন বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দ্বারা। এই সংবেদনের অনুভূতি হচ্ছে প্রধান যার মাধ্যমে বস্তুজগৎকে চেনা যায়। এই মানসিক অনুভবের বাইরে বস্তুজগতের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে যেহেতু এই মানসিক অনুভব আপেক্ষিক তাই বস্তুজগৎ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনও সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, যখন বস্তুজগৎ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয় তখন তাকে পরিবর্তন করার প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। অথচ মার্কসবাদীরা এই শোষণনির্ভর ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করবার জন্যই নিয়োজিত। লেনিন বললেন যে, সংবেদন বা অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উৎস ঠিকই, কিন্তু বস্তুজগৎ চেতনা নিরপেক্ষ। মানুষের চেতনায় বস্তুজগতের প্রতিফলন ঘটে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন যে, মানুষের সৃষ্টির আগেই বহু কোটি বছর ধরে পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল এবং তা মানুষের চেতনা-নিরপেক্ষভাবেই ছিল।লেনিনের এই ‘প্রতিবিম্ব তত্ত্ব’ বস্তুজগৎকে চেতনার উৎস হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। বস্তুজগৎকে মনগড়া ধারণা দিয়ে নয়, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে তাকে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। মার্কসবাদের ছাত্র হিসেবে লেনিন দর্শনের জগতে এভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক হস্তক্ষেপ করেছিলেন তা বিপ্লবী কর্মীদের ভাববাদের নবরূপে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে এবং বিপ্লবী চেতনার উন্মেষের পথ প্রশস্ত করে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে রসদ জোগায়।
মার্কসবাদকে বিকশিত করবার ক্ষেত্রে লেনিনের সর্বোত্তম অবদান সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত তত্ত্ব। ধনতন্ত্রের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব ও সংকটের যে মূল কারণগুলি মার্কস ‘পুঁজি’ গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেছিলেন তার সার্থক প্রয়োগ ও বিকাশ ঘটান লেনিন। ১৮৯৯ সালে লেনিন রচনা করেন ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে রাশিয়ায় ধনতন্ত্রই যে প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল তা দেখান লেনিন। ১৯১৬ সালে ‘সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ গ্রন্থে তিনি একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ এবং পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদের উত্তরণের বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেন। লেনিন দেখালেন যে, শিল্পপুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি একত্রিত হয়ে লগ্নিপুঁজির উদ্ভব ঘটেছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির চেয়ে পুঁজি রপ্তানি মুখ্য হয়ে ওঠে। সেই সময় একচেটিয়া পুঁজি বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে বিকশিত হচ্ছিল। স্বভাবতই বিশ্বের বাজার দখল করার জন্য একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের দ্বন্দ্ব জাতিরাষ্ট্রের পারস্পরিক সংঘাতের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী পর্বে যুদ্ধকে তাই অনিবার্য হিসেবে আখ্যা দেন লেনিন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যখন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকভুক্ত অধিকাংশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল তখন লেনিন দৃঢ়ভাবে এই মত ব্যক্ত করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পর্বকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্বে রূপান্তরিত করা সম্ভব। তিনি দেখালেন যে, সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পুঁজিবাদের যাবতীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব এমনভাবে তীব্র হয়ে ওঠে যে, তা পুঁজিবাদের ভিতকে দুর্বল করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তোলে। পুঁজিবাদের অসম বিকাশের দরুন জাতিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক একচেটিয়া পুঁজির অন্তর্দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার কোনো না কোনো দেশকে বেশিমাত্রায় দুর্বল করে। লেনিন বললেন যে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মুনাফা অর্জন ও শোষণের শৃংখলে নিজেদের যুক্ত করে রেখেছে। এই শৃংখলের দুর্বলতম গ্রন্থিতে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে বেশি সংকটাপন্ন পুঁজিবাদী দেশে যদি আঘাত করা যায় তাহলে এক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। লেনিন রাশিয়ায় এই তত্ত্বের সার্থক রূপায়ণ ঘটালেন।
শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রসঙ্গে সর্বহারার একনায়কত্বের যে ধারণা তুলে ধরেন মার্কস তার সৃজনশীল বিকাশ ঘটান লেনিন। তার লেখা ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’, ‘সর্বহারার বিপ্লব ও দলত্যাগী কাউৎস্কি’, ‘সর্বহারার একনায়কত্বের অর্থনীতি ও রাজনীতি’ ইত্যাদি লেখায় লেনিন দেখালেন যে, শোষকদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা বিনষ্ট করবার জন্য এবং বিপ্লবকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য শ্রমিকশ্রেণির হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকা দরকার। সর্বহারার একনায়কত্ব আসলে শোষিতশ্রেণি যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করবে। পার্টির সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও শ্রমিকশ্রেণির ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সোভিয়েতগুলির সক্রিয় ভূমিকার ওপর জোর দেন লেনিন যাতে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বিকশিত হয়।
রণনীতির সাথে রণকৌশলের সমন্বয় ঘটনার প্রশ্নে লেনিন ছিলেন অতুলনীয়। মার্কসবাদ যে কোনো আপ্তবাক্য নয় কর্মক্ষেত্রে দিক নির্দেশক, তা তিনি মানতেন বলেই বিপ্লবকে রক্ষা করবার জন্য রাশিয়ায় সাময়িকভাবে অর্থনীতির কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি দিয়ে ‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’ চালু করতে দ্বিধা করেননি। লেনিনের বিপ্লবী জীবন মার্কসীয় তত্ত্বের সৃষ্টিশীল প্রয়োগের এমন নানা নজির বহন করে।
মার্কস-এঙ্গেলস উপনিবেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের মুক্তির সংগ্রামের প্রশ্নে যে রূপরেখা হাজির করেছিলেন তাকে বিকশিত করে সার্থক রূপদান করেন লেনিন। ১৯১৪ সালে তাঁর লেখা ‘জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’ জাতিদম্ভ ও ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথকে প্রশস্ত করে। ১৯১৯ সালে প্রাচ্যের কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির মহাসম্মেলন এবং ১৯২০ সালে বাকুতে কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসে উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রণকৌশল সংক্রান্ত দলিল পেশ করেন লেনিন। নিপীড়িত জাতিসমূহের সংগ্রামকে সর্বহারার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সাথে সাথে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে, এই দেশগুলিতে বিপ্লবের স্তর বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক। তিনি একদিকে উপনিবেশের বুর্জোয়াদের দ্বারা পরিচালিত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ, অন্যদিকে শ্রমিক-কৃষকের শ্রেণিঐক্য গড়ে তুলে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে বিপ্লবী রূপ দেওয়ার প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। উপনিবেশগুলির অর্থনীতিতে প্রাক্-পুঁজিবাদী সম্পর্কের প্রাধান্য এবং এই দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা করে তিনি সময়োপযোগী তত্ত্ব হাজির করেন। উপনিবেশগুলির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস লেনিনীয় তত্ত্বের সারবত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বর্তমান বিশ্বে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নানাভাবে মতাদর্শগত আক্রমণের শিকার। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল সূত্রগুলি অভ্রান্ত। শোষণের কাঠামোকে চূর্ণ করে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগ্রামকে সফল করবার জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক শিক্ষা অনুশীলন করা ও তার সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটানো তাই অত্যন্ত জরুরি।