E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮

পেট্রোপণ্যে অন্তঃশুল্ক কমানো হলেও চড়া দাম অব্যাহত

অন্তঃশুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজ্যে উপনির্বাচনে প্রবল ধাক্কা খেয়ে পেট্রোপণ্যে সামান্য অন্তঃশুল্ক কমানোর কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। ৩ নভেম্বর কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয় পেট্রোলে লিটার প্রতি ৫ টাকা এবং ডিজেলে লিটার প্রতি ১০ টাকা কেন্দ্রীয় শুল্ক হ্রাস করা হলো। পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া দাম বাড়িয়ে লিটার প্রতি মাত্র ৫ ও ১০ টাকা ছাড়ের এই ঘোষণাকে ‘দীপাবলির উপহার’ বলে বাগাড়ম্বর করেছে কেন্দ্রের সরকার। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্র রাজ্যগুলিকেও তাদের ভ্যাট কমানোর পরামর্শ দিয়েছিল। সেই মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি ভ্যাট কমা‍‌নোর কথা ঘোষণা করলেও বেশিরভাগ রাজ্যেই এখনো পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ১০০ টাকার উপরেই রয়ে গেছে। কেন্দ্রের এই কর কমানোর প্রচার যতটা হয়েছে, সে পরিমাণে রেহাই কী মিলেছে? পেট্রোল ও ডিজেলে কর ছাড়ের কেন্দ্রীয় ঘোষণার পরও চড়া দাম থাকায় এই প্রশ্ন উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কেন্দ্রের চাপানো অন্তঃশুল্ক প্রত্যাহারের দাবি‍‌ ফের জানিয়ে বলেছেন, মানুষকে লুট করা হচ্ছে। অসহনীয় বোঝা চাপানো হচ্ছে জনতার ওপর। কোভিড এবং অর্থনৈতিক মন্দার জোড়া বিপদের মুখেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, শুধু এ বছরেই পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ২৮ টাকা ও ডিজেলের দাম ২৬ টাকা বেড়েছে গত ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রায় এক বছরে পেট্রোলের দাম বেড়েছে ৭৬ বার এবং ডিজেলের দাম ৭৩ বার। উল্লেখ করা যেতে পারে, পেট্রোপণ্যের দামের এক বড়ো অংশই আসলে কেন্দ্র ও রাজ্যের শুল্ক। এর মধ্যে কেন্দ্রের শুল্কই সবচেয়ে বেশি। ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পেট্রোলের শুল্ক লিটারে ৯.৪৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩২.৯০ টাকা হয়েছে। ডিজেলে ৩.৫৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮.৩৫ টাকা। মহামারীর বছরে ২০২০ সালে মার্চ ও মে মাসে দু’বার অন্তঃশুল্ক বাড়িয়েছে কেন্দ্র। তার ফলে পেট্রোলে শুল্ক বেড়েছে ১৩ টাকা, ডিজেলে ১৬ টাকা। শতাংশের হিসেবে পেট্রোলে তখনই শুল্ক বাড়ে ৬৫ শতাংশ, ডিজেলে ৭৯ শতাংশ। তারই সামান্য শুল্ক কমানোর কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। ৩ নভেম্বর কেন্দ্র পেট্রোপণ্যের অন্তঃশুল্ক কমানোর পরও পেট্রোলে ২৮ টাকা এবং ডিজেলে ১৯ টাকা শুল্ক রয়ে যায়।

এদিন যে শুল্ক কমানো হয় তা শুধু অক্টোবর মাসের মূল্যবৃদ্ধির সমান। অক্টোবরের শেষে মাত্র এক মাসে পেট্রোলের দাম বেড়েছে লিটারে ৮.১৫ টাকা এবং ডিজেলে লিটার পিছু ৯.৪৫ টাকা। তাও পেট্রোলের ক্ষেত্রে হ্রাস এবং বৃদ্ধি তুল্যমূল্য হয়নি।

সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, যখন পেট্রোপণ্য বিনিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল, তখন জানানো হয়েছিল শুল্কের হার হবে শূন্য। কিন্তু এখন শুধু এবছরেই ৩.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্র আদায় করেছে পেট্রোপণ্য থেকে। শুল্ক হ্রাস নয়, পেট্রোপণ্যে অন্তঃশুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।

পেট্রোল-ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক বসিয়ে চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে রেকর্ড কর আদায় করেছে কেন্দ্র। করোনা মহামারীর আগে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রথম ছ’মাসে পেট্রোপণ্য শুল্ক বাবদ যে টাকা আদায় হয়েছিল, তার থে‍‌কে ৭৯ শতাংশ বেশি টাকা আদায় হয়েছে গত ছয় মাসে। কেন্দ্রের কন্ট্রোলার জেনারেল অব অ্যাকাউন্টস (সিজিএ) সূত্রে জানা যায়, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম দুই ত্রৈমাসিক (এপ্রিল-‍‌সেপ্টেম্বর) বা ছ’মাসে পেট্রোপণ্যে উৎপাদন শুল্ক বাবদ কেন্দ্র আদায় করেছে ১.৭১ লক্ষ কোটি টাকা। সেখানে দেশে মহামারীর শুরুর আগে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ২০১৯-২০ সালের প্রথম ছ’মাসে শুল্ক বাবদ আয় হয়েছিল ৯৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। প্রথম মহামারীর বছরে ২০২০-২১ সালে উৎপাদন শুল্ক বাবদ কেন্দ্রের আয় হয়েছে ৩.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা। মহামারীর অগে স্বাভাবিক সময়ে ২০১৯-২০ সালে সেই আয় ছিল ২.৩৯ লক্ষ কোটি টাকা। এক বছরে এই শুল্ক বাবদ আয় বেড়েছে ১.৫০ লক্ষ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, দেশে পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু হওয়ার পরেও তার বাইরে রয়েছে পেট্রোল, ডিজেল, বিমানের জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস। করের সীমা বেঁধে রাখার স্বার্থে পেট্রোপণ্যকে ‍‌জিএসটি’র আওতায় রাখা হয়নি।

এদিকে কেন্দ্রের ঘোষণার পর ভ্যাট ছাঁটাইয়ের ঘোষণা করে আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, কর্ণাটক, গোয়া, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ ও বিহার সহ বারোটি বিজেপি-শাসিত রাজ্য। ভ্যাট ছাড় দেয় সিকিম, ওডিশাও। পেট্রোল-ডিজেলে লিটার প্রতি ৭ টাকা করে কমিয়েছে আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, কর্ণাটক, গুজরাট ও গোয়া। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী শুধু পেট্রোলে দু’টাকা ভ্যাট কমানোর কথা ঘোষণা করেন। হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও ভ্যাট কমানোর কথা বলেন। হরিয়ানা ঘোষণা করে পেট্রোল-ডিজেল লিটারে ১২ টাকা কম হবে। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী পেট্রোলে রাজ্য ছাড় দিচ্ছে ৭ টাকা আর ডিজেলে মাত্র ২ টাকা। বিজেপি-শাসিত বিহারও পেট্রোল-ডিজেল লিটার প্রতি ৩ টাকা ভ্যাট কমানোর কথা ঘোষণা করেছে।

এ‍‌দিকে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে ভ্যাট ছাঁটাইয়ের এমন ঘোষণার পর বিজেপি বিরোধীদের সমালোচনা করেছে তাদের পরিচালিত সরকারগুলি ভ্যাট কমানোর উদ্যোগ না নেবার জন্য।

বিরোধীরা অবশ্য এই শুল্ক হ্রাসকে মোদির জুমলাবাজি বলেই উল্লেখ করেছে। কারণ শুধু অক্টোবর মাসেই পেট্রোলে লিটার প্রতি ৮.১৫ টাকা এবং ডিজেলের দাম ৯.৪৫ টাকা বাড়িয়ে ৩ নভেম্বর কেন্দ্র যথাক্রমে ৫ ও ১০ টাকা কমিয়ে দেওয়ায় বিজেপি এটাকে ‘দীপাবলির উপহার’ বলে হইচই করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য এই কর কমানোকে চোখে ধুলো‍‌ দেওয়া বলেই মন্তব্য করেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে মূল্যযুক্ত কর বা ‘ভ্যাট’ যথেষ্ট চড়া। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের দশ বছরে পেট্রোপণ্য থেকে রাজস্ব আদায় ২৬০০ কোটি টাকা থেকে বেড়েছে ৭৯৯৬ কোটি টাকা হয়েছে।‍‌ দেখা গেছে, গত সাত বছরে যে সময় নরেন্দ্র মোদী পরিচালিত বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসীন, সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পেট্রোপণ্যের বিক্রি ৩১ শতাংশ কমেছে। কিন্তু করের হার বাড়ায় রাজস্ব আদায় ৪২ শতাংশ বেড়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পেট্রোল এবং ডিজেলের দামে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দেবার পর বেশি বিপাকে পড়েছে জনতা। বিনিয়ন্ত্রণের ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে দাম বাড়লেই সরাসরি খুচরো বাজারে বাড়ছে দাম। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করাচ্ছেন, লকডাউনের সময়ে বিশ্বজুড়ে চাহিদার অভাবে অপরিশোধিত তেলের দাম কমে গেলেও দেশের বাজারে কিন্তু পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমেনি।

এদিকে পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, ভোজ্য তেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে রাজ্য বামফ্রন্টের ডাকে ৮ নভেম্বর থেকে রাজ্যের সর্বত্র প্রচার-আন্দোলন চলছে। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।