E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮

কমরেড বাদল শেখের হত্যা প্রমাণ করল রাজ্যে গণতন্ত্র আক্রান্ত

প্রতিবাদ ও ধিক্কার রাজ্য জুড়ে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ শোষণ মুক্তির লাল নিশান তোলার ‘অপরাধে’ শহিদ হলেন নানুরের সিপিআই(এম) কর্মী, পেশায় খেতমজুর বাদল শেখ। ১০৪ তম নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপনের প্রথম দিনেই তাঁর রক্তে ভিজল বীরভূমের লাল মাটি। নানুরের বালিগুনি গ্রামে তাঁকে পিটিয়ে খুন করলো তৃনমূলের দুষ্কৃতীরা। তাঁর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজপথে সোচ্চার বাংলা। তৃণমুলীদের আক্রমণে রক্তাক্ত ওই প্রবীণকে শুরুতে চিকিৎসার সুযোগটুকুও দেওয়া হয়নি। উলটে, গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে একটি ভ্যানে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকা বাদল শেখকে নানুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে গেলে পথ আটকায় ‘উন্নয়ন’ বাহিনী। স্বামীকে ঘরে বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখা কমরেড বাদল শেখের স্ত্রী জরিনা বিবি স্পষ্ট অভিযোগ করেছেন, ‘‘আমরা সিপিএম করি। তাই তৃণমূলীরা মেরেছে আমার স্বামীকে। গতকাল পতাকা তুলেছিল বলে। মারার পর ভ্যানে করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেয়নি।’’ গ্রামবাসী সহ স্থানীয় পার্টি কর্মীদের বক্তব্য, মমতা ব্যানার্জির সরকারের দলদাস পুলিশ শুরুতেই ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করলে চিকিৎসাটুকু পেতে পারতেন কমরেড বাদল শেখ।

এই মৃত্যুতে শিলিগুড়ি থেকে সাগর - উত্তাল রাজপথে লাল পতাকা হাতে ফুঁসছে প্রতিবাদী বিক্ষোভ মিছিলের ঢেউ। হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে রাজ্যব্যাপী এর প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান জানিয়ে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, নভেম্বর বিপ্লবের বার্ষিকীতে রক্তপতাকা তুলেছিল বলে কমরেড বাদল শেখকে খুন করা হলো। ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপন হয়। এই সময়ের মধ্যেই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কর্মসূচি চলবে রাজ্যের সর্বত্র।

রাজ্য বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু মন্তব্য করেছেন, রাজ্যে গণতন্ত্র আক্রান্ত নানুরের ঘটনাই তার প্রমাণ। কমরেড বাদল শেখ সিপিআই(এম) কর্মী ছিলেন। তাঁকে দিনের আলোয় খুন করা হয়েছে। কারণ তিনি তাঁর গ্রামে নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকীতে লাল পতাকা তুলেছিলেন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, ৭২ বছরের এই প্রবীণ সিপিআই(এম)কর্মী গত ৭ নভেম্বর বাড়ির সামনে লাল পতাকা তুলেছিলেন, যেমন গত দশ বছর ধরেই তৃণমূলের সন্ত্রাস উপেক্ষা করেই করেছেন অকুতোভয়ে। সেখানে পতাকা উত্তোলন উপলক্ষে ছিল পার্টিকর্মী, কৃষক সভার সদস্য এবং খেত মজুরদের ছোটো জমায়েত। তৃণমূলের দুষ্কৃতীরাজকে উপেক্ষা করে জমায়েত থেকে উচ্চারিত নভেম্বর বিপ্লবের স্লোগান কুয়াশা আর হাল্কা শীতের সকালে উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছিল বালিগুনি গ্রামে। ওই সাত তারিখেই ছিল কৃষকসভার অঞ্চল সন্মেলন। সন্মেলনে আসা সহকর্মীদের জন্য নিজেই রান্না করেছিলেন তিনি। মেয়ের বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়েই সিপিআই(এম)’র একনিষ্ঠ কর্মী বাদল শেখের পরিবার। গ্রামে কাজের অভাব থাকলেও কোনও হুমকি, লোভ তাঁকে সরাতে পারেনি পার্টি থেকে। লাল ঝান্ডার মিছিলে তিনি থাকতেন সামনের দিকেই। তৃণমূলীদের দপদপানিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই গলার শির ফুলিয়েই স্লোগান দিতেন তিনি।

খেত মজুর বাদল শেখের এই স্পর্ধা সহ্য হয়নি ত্রাণ চুরি আর লুটে অভ্যস্ত তৃণমূলীদের। পরের দিনই ৮ নভেম্বর সকাল দশটা নাগাদ বালিগুনি বাসস্ট্যান্ডে বাদল শেখকে পতাকা তোলার কৈফিয়ত চেয়ে ঘিরে ধরে এবং নির্মমভাবে মারধর করতে শুরু করে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই যুঝতে না পেরে এলোপাতাড়ি মারধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ৭২ বছরের প্রবীণ। তবু থামেনি ‘অনুপ্রাণিত’ বীরপুঙ্গবরা।

সেদিন শুধু বাদল শেখই নন। রেহাই পান নি আরও দুই পার্টি কর্মী। নিশিকান্ত থান্ডার এবং শেখ পিটারের উপরও চলে আক্রমণ। তৃণমূলী হামলা থেকে কোনোক্রমে রেহাই পাওয়া শেখ পিটার বলেন তার পরের ঘটনা, ‘‘বাইরে থেকেও হামলা করতে লোকজন এনেছিল তৃণমূল। জখম বাদল শেখের বাড়ি থেকে বারবার আমাদের কাছে ফোন আসতে থাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাতেও বাধা দেয় ওরা। আমি গাঁয়ের তৃণমূল নেতাকে ফোন করি। সে বলে, বাড়িতেই থাক। কিচ্ছু হয়নি। ঠিক হয়ে যাবে।’’ অভিযোগ, তৃণমূলীরা চিকিৎসা করাতে বাধা দিলে পুলিশকে ফোন করা হলে পুলিশ প্রথমে সাড়া দেয়নি, হস্তক্ষেপ করে অনেক পরে। এরপরই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় বাদল শেখের বিধ্বস্ত দেহ। প্রথমে নানুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে ‘দায়িত্ব’ নেয়নি নানুর হাসপাতাল। নানুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেন। ততক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাদল শেখ।

ঘটনার খবর পেয়ে বোলপুর হাসপাতালে যান নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক, সিপিআই(এম) নেত্রী শ্যামলী প্রধান। তিনি বলেন, “বাদল শেখের পরিবারের মুখ থেকে সবটা শুনেছি। পুলিশের কাছে দাবি করছি, অবিলম্বে যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তদন্ত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”

শহিদ বাদল শেখের দেহ গ্রামে নিয়ে আসা হলে সেখানে অসংখ্য মানুষ চোখের জলে বিদায় জানান তাকে স্লোগান ওঠে দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের কোন সন্ত্রাসের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে পুলিশকে। বীরভূম জেলা সহ রাজ্যজুড়ে সংগঠিত হয়ে চলেছে অসংখ্য ধিক্কার মিছিল। অসংখ্য পথসভা সংগঠিত হয়েছে এই হত্যার প্রতিবাদে। বাদল শেখের শাহাদাত বৃথা যাবেনা। তৃণমূলী হায়নার আনাগোনা রুখতে পাড়ায় পাড়ায় তৈয়ার বাদল শেখের সহযোদ্ধারা। খুনি তৃণমূলকে ধিক্কার জানিয়ে এই শপথ নিয়েছেন পার্টি কর্মীরা। এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে বিভিন্ন সংগঠন। সেভ ডেমোক্র্যাসি পশ্চিমবঙ্গের তরফে সংগঠনের সভাপতি অশোক কুমার গাঙ্গুলি অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি ও বাদল শেখের পরিবারের নিরাপত্তা দাবি করেছেন।

সেভ ডেমোক্র্যাসির এক প্রতিনিধি দল ১২ নভেম্বর নানুর যাচ্ছেন কমরেড বাদল শেখের হত্যার বিচারের দাবি জানাতে।