৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮
সিপিআই(এম) মণিপুর রাজ্য ১৯তম সম্মেলন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রে এবং মণিপুরে বিজেপি'র স্বৈরতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক জমানাকে পরাস্ত করো, শক্তিশালী বাম এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রসারিত করো গণলাইন সম্পন্ন সিপিআই(এম)। ৩০ অক্টোবর ইম্ফলে সিপিআই(এম) মণিপুর রাজ্য ১৯তম সম্মেলনের উদ্বোধন করে এ কথা বলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুপ্রকাশ তালুকদার।
সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্ব রক্ত পতাকা উত্তোলন এবং শহিদ বেদিতে ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ১৯তম রাজ্য সম্মেলনের পতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা সাইখম যুগল। ইম্ফলের লাঙপক্লাকপাম হলে এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১৩ জন মহিলা সহ মোট ৫৪ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। ইম্ফল শহরে সম্মেলনস্থলের অধিবেশন সংলগ্ন এলাকাকে একটি সুসজ্জিত গ্রামের রূপ দেওয়া হয়।
উদ্বোধনী পর্বে সুপ্রকাশ তালুকদার বলেন, বিজেপি সরকার হলো বিত্তবান এবং ধনী কর্পোরেটদের তোষণকারী এবং শ্রমিক-কৃষক বিরোধী। লাগাতার পেট্রোপণ্যের দাম বাড়া সত্ত্বেও কেন্দ্র এবং রাজ্যের দুই বিজেপি পরিচালিত সরকার নীরব। এই সরকার গরিব মানুষকে অবদমিত করে রেখে পরপর খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের মানুষ যখন অনাহারে অনটনে রয়েছেন তখন এই সরকার একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ এমনকি নবরত্নের বেশকিছু সেক্টরও বেচে দিচ্ছে কর্পোরেটদের কাছে। তিনি অভিযোগ করেন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির উন্নয়নের পরিকল্পনাকে পেছনে রেখে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে জনবিরোধী নীতি নিয়ে চলেছে তা রাজ্যগুলির বেকার যুবকদের বাড়তে থাকা সংখ্যা থেকেই স্পষ্ট। প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে তিনি বিজেপি এবং তার সহযোগী দলগুলিকে পরাস্ত করে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে বিরোধী শক্তি রূপায়ণের আহ্বান জানান। হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত রূপায়ণের প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিচ্ছিন্ন করার এবং জনবিরোধী আর্থিক নীতি সমূহকে পাল্টে জনস্বার্থবাহী নীতিসমূহ গ্রহণ করতে বাধ্য করতে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়টি উল্লেখ করেন। ২০২২-এ মনিপুরের আসন্ন ১২ তম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করতে আগত প্রতিনিধিদের দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য মানুষকে সংগঠিত করার পদক্ষেপ করতে বলেন।
উদ্বোধনী পর্বের পর সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো’র সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, এই সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন জাতি এক সংকটময় মুহূর্তের সম্মুখীন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর দেশের মানুষ এবং সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আমাদের দেশ কখনই এরকম বড়ো চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েনি। অর্থনীতিতে অসাম্য এবং বেকারত্বের হার এরচেয়ে তলানিতে কখনও যায়নি। ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে ভাষাগতভাবে জনগোষ্ঠীগতভাবে এবং সামাজিক জাতের ভিত্তিতে এই পর্যায়ের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আগে কখনও ঘটেনি। অর্থনীতির এই ভরাডুবির ফলে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠলে তাকে সামগ্রিকভাবে প্রতিরোধ এবং দমন করার জন্য সংসদীয় ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করা হলো। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে পার্লামেন্ট বহির্ভূতভাবে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে এ পর্যন্ত মোদি সরকার মোট ৬৯ টি আইন পাশ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে তিনটি কালা কৃষি আইন এবং দানবীয় শ্রম কোড। মতবিরোধ ঘটলেই এই সরকার ইউএপিএ, দেশদ্রোহিতার আইন এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইন চাপিয়ে দিচ্ছে প্রতিবাদী বিরোধীদের ওপর। কর্পোরেটদের স্বার্থ দেখার জন্য তাদের অর্থ জোগানোর জন্য এবং পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষিত করবার জন্য দেশের সম্পদ তাদের হাতে তুলে দিতে এই সরকার গড়ে তুলেছে একটি দুষ্টচক্র। বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা এবং কর্তৃপক্ষের অবদমন করা হচ্ছে প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে।
তিনি অভিযোগ করেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেনাবেচাকে বিজেপি উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে। এইভাবে জনাদেশ লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর ফলে প্রান্তিক অংশের মানুষের মধ্যেকার দ্বন্দ্বে উদ্ভূত পরিস্থিতির বিপদ আরও ঘনীভূত হচ্ছে এবং আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে খেটে খাওয়া মানুষের ব্যাপকতম ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক কার্যকলাপ গড়ে তুলে প্রাণবন্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে। এটাই হোক সম্মেলনের শপথ।
প্রেসিডিয়াম গঠনের পর শোক প্রস্তাব পেশ করা হয়। রাজ্য সম্পাদক ক্ষেত্রীমায়ুম শান্তা খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রস্তাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণসহ রাজ্য এবং দেশের আর্থিক পরিস্থিতি, মণিপুরে অগণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, মহামারী এবং আগামী দিনে পার্টির স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়।
১৯তম সম্মেলন থেকে কুড়িটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। তাঁর মধ্যে রয়েছে পেট্রোলিয়াম দ্রব্যের এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মণিপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খোলা, মহামারীকালে গরিব পরিবারগুলোকে মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা করে দেবার দাবি, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন, মণিপুরের একতা এবং অখণ্ডতা রক্ষা, মহিলাদের ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ, বামপন্থী এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির জোট গঠন, ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি বিষয়।
রিপোর্টের ওপর আলোচনা করেন ১০ জন প্রতিনিধি। জবাবি ভাষণ দেন সম্পাদক ক্ষেত্রীমায়ুম শান্তা। এরপর সর্বসম্মতিতে রিপোর্ট গৃহীত হয়। সম্মেলন থেকে ১৪ সদস্যের নতুন রাজ্য কমিটি গঠিত হয়। রাজ্য কমিটি ৫ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করে। রাজ্য সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন ক্ষেত্রীমায়ুম শান্তা।