E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮

কৃষিক্ষেত্র নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা

প্রভাত পট্টনায়েক


ভারতের কৃষিক্ষেত্র নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে যেগুলি দূর করা না হলে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে যে কৃষক আন্দোলন চলছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত। ধরে নেওয়া হয় যে, কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের বিষয়টি কর্পোরেট সংস্থা এবং কৃষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ধারণা ভুল কেননা কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ সমগ্র অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে, এর সাথে প্রত্যেক নাগরিক কোনো না কোনোভাবে জড়িত। এটি কোনো আলংকারিক বিবৃতি নয় এটি আক্ষরিকভাবে সত্য। তাই কৃষকরা কর্পোরেট অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছেন তা কোনো শিল্প কারখানার মতো দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। কর্পোরেট অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কৃষকরা বস্তুত পুরো সমাজের জন্য লড়ছেন এবং ভারতকে ‘‘খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের’’ অধীনস্থ করবার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম। এবার এর কারণগুলি দেখে নেওয়া যাক।

কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের অর্থ কেবলমাত্র সরাসরি কৃষকদের আয়ে ভাগ বসিয়ে অথবা কৃষকদের ফসলের দাম বাড়ার সুফল ভোগ করতে না দিয়ে কিংবা তাদের ওপর ফসলের দাম কমে যাবার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের আয়ের একটা অংশ কেড়ে নেওয়া নয়। এর ফলে জমির ব্যবহারে পরিবর্তন আসবে অর্থাৎ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে যে সমস্ত খাদ্যশস্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হয় তার বদলে উৎপন্ন করতে হবে নিরক্ষীয় অঞ্চলের খাদ্যশস্য নয় এমন সমস্ত ফসল যা প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে উৎপন্ন হয় না,বা হলেও নির্দিষ্ট মরসুমে উৎপন্ন হয়। কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের ফলে তাই অবশ্যম্ভাবীভাবেই কমবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। খাদ্যশস্যের বদলে প্রথম বিশ্বের দেশে যে শস্যগুলো উৎপাদিত হয় না সেগুলি উৎপন্ন করার দিকেই নজর দেওয়া হবে। অর্থনীতিকে এইদিকে পরিচালনা করার জন্য আরেকটি অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি এই যে, ভারতে মূলত খাদ্যশস্যের জন্য যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হয় তাকে বন্ধ করে দেওয়া। মোদি সরকার হয়তো বারেবারে বলছে যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়া হবে না; কিন্তু তারা কখনই এই কৃষি আইনকে পরিবর্তন করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়াকে আইন সিদ্ধ করতে চাইছে না। এদের এটাই উদ্দেশ্য, যাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী কৃষকদের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন আরও কম লাভজনক হতে থাকে।এর ফলে অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন কমবে কেননা চাষিরা এতটাই গরিব যে তারা এই অলাভজনক চাষের ঝুঁকি নিতে পারবে না। তাই একদিকে কর্পোরেটসংস্থাগুলি তাদের উপরে খাদ্যশস্য নয় এমন ফসল উৎপন্ন করবার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে অন্যদিকে সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রত্যাহার করে নিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে চাষিকে নিরুৎসাহ করবে।

এখন এমন প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে, কী এমন ক্ষতি হবে এভাবে যদি ভারত খাদ্যশস্য আমদানি করে এবং যে সমস্ত শস্য রপ্তানি করবে সেগুলোর অর্থ দিয়ে সেই খাদ্যশস্য আমদানির খরচ বহন করে? প্রথমত, এহেন আমদানি করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন যা কীনা সবসময় আমাদের নাও থাকতে পারে। এছাড়া মনে রাখা দরকার যে, একদিকে যেমন খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ফসলের দাম একইভাবে ওঠানামা করে না সে ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য নয় এমন ফসলের দাম কমে গেলে আমাদের হাতে খাদ্যশস্য কেনার জন্য অনেক কম বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে। অন্যদিকে ভারতের মতো বিরাট দেশ খাদ্যশস্যের আমদানি করা শুরু করলে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম এমনিতেই বেড়ে যাবে, ফলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে।

দ্বিতীয়ত, যদি খাদ্যশস্য আমদানি করবার মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার থেকেও থাকে তাহলে দেশের মানুষের এই খাদ্যশস্য কেনবার জন্য যথেষ্ট ক্রয়ক্ষমতা আছে কীনা সেটা দেখা দরকার কেন না যেসব দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যায় সেসব দেশে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই সমস্ত দেশে খাদ্যশস্যের বদলে যে সমস্ত ফসল উৎপন্ন হয় সেগুলি যথেষ্ট পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। অর্থাৎ খাদ্যশস্যের বদলে অন্যান্য শস্য উৎপাদনের দিকে জোর দিলে কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমবে। অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে এবং তাদের পক্ষে আমদানিকৃত খাদ্যশস্য কেনা সম্ভব হবে না।

এর সাথে যুক্ত হবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চোখরাঙানি। যেহেতু সেই দেশগুলি থেকেই খাদ্যশস্য আমদানি করা হবে সেহেতু সেই সব দেশের মনোমত না চললেই তারা খাদ্যশস্য রপ্তানি করা বন্ধ করে দেবে। তাই প্রথম বিশ্বের দেশগুলো থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি করা হলে তা ভবিষ্যতে আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করবে। এই সহজ সত্যটা অনুভব করেছিলেন বলেই ইন্দিরা গান্ধী সরকার সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতকে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। খাদ্যে এই স্বয়ম্ভরতা (যদিও এই স্বয়ম্ভরতার সঙ্গে কম ক্রয়ক্ষমতা যুক্ত রয়েছে) বিসর্জন দেওয়ার পথে এগোচ্ছে মোদি সরকার প্রবর্তিত তিনটি কৃষি আইন। সাম্রাজ্যবাদ অনেকদিন ধরেই এটাই চাইছে এবং মেরুদণ্ডহীন মোদি সরকার সহজেই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

চলমান কৃষক আন্দোলন এই আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কৃষিতে কর্পোরেটের অনুপ্রবেশ মেনে নেওয়া এবং কতটা অংশ কর্পোরেটের থাকবে আর কতটা কৃষকের থাকবে - এই আলোচনা অর্থহীন। এর অর্থ ভারতের যেটুকু সার্বভৌমত্ব অবশিষ্ট আছে তা সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিকিয়ে দেওয়া।এর সাথে সাথে দেশের গণবণ্টন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাবে (কেননা খাদ্যশস্য আমদানি নির্ভর হলে প্রতিবছর কতটা খাদ্যশস্য আমদানি হবে তার কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না)।

দ্বিতীয় ভ্রান্ত ধারণা এই যে, সারাদেশে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং সরকারি তরফে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অপ্রয়োজনীয়। এই যুক্তি দেওয়া হয় যে - পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ থেকে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া যে উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহ করে তা গোটা দেশে গণবণ্টন ব্যবস্থা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই গোটা দেশে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং খাদ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখার অর্থ সরকারি খাদ্য ভাণ্ডার স্ফীত করা এবং এই খাদ্য সংগ্রহ করতে ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হয় তার সুদ বাড়িয়ে তোলা যা কীনা শেষমেষ সরকারি বাজেটের ওপর প্রভাব ফেলে।এই যুক্তি অনুসারে দেশের তিনটি উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী এলাকার বাইরে খাদ্য সংগ্রহ করার অর্থ দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া; এক, সরকারি গুদামে খাদ্যের অপচয় আর দুই, খাদ্য সংগ্রহ এবং গুদামজাত করতে গিয়ে সরকারি অর্থের অপচয়। এদের বক্তব্য যে, একারণেই কৃষকদের সহায়তা এবং খাদ্যশস্য সংগ্রহের কাজটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখাই শ্রেয়।

এই যুক্তিটিও ভুল এবং ভারতীয় কৃষি সম্পর্কে এদের ভ্রান্ত ধারণা এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে খুব বেশি খাদ্য সংগ্রহ করে না এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেড়ে গেলে এর পরিমাণ বেশি বাড়বে না। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ভিত্তি মূল্য। তাই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়লে বাজারেও ফসলের দাম বাড়ে। এর ফলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায়। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার কাছে ছাড়া বাজারে কৃষক খাদ্যশস্য বিক্রি করে যাতে বাড়তি আয় করতে পারে তার জন্যই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। সরকারিভাবে খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি না করেও এটি করা সম্ভব।

কিন্তু খোলাবাজারে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি মানে তো খোলাবাজারে খাদ্যশস্যের চাহিদা কমে যাবে এবং সেক্ষেত্রে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে খাদ্য সংগ্রহের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এই ধাঁধাঁর উত্তর লুকিয়ে আছে এই তথ্যের মধ্যে যে, আমাদের দেশে উচ্চ আয়ভুক্ত শ্রেণির মানুষ যারা কীনা গণবণ্টন ব্যবস্থার আওতার বাইরে থাকেন তাদের চাহিদা খোলাবাজারে দামের উপরে নির্ভর করে না। অর্থাৎ খোলাবাজারে দাম বাড়লেই তারা কম খাদ্যশস্য কিনবেন এমনটা নয়। সে ক্ষেত্রে কম চাহিদার জন্য ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার ওপরে নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়া এবং সরকারি গুদামে খাদ্যের সঞ্চয় বৃদ্ধি পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। সারাদেশে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হলে কৃষকের নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব; আবার এর জন্য সরকারি খাদ্য সঞ্চয় তেমন কিছু বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এটা ঠিকই যে, উল্লেখিত তিনটি রাজ্যের বাইরে অন্য রাজ্যে খাদ্যশস্য সংগ্রহের প্রশ্নে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া অত্যন্ত অনীহা দেখায় এবং তার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে নিজস্ব সংস্থার সাহায্যে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে হয়। যখনই এই ধরনের সংস্থাগুলি কাজ করেছে তারা খুব বেশি যে খাদ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে তা নয় কিন্তু তারা কৃষকদের একটা নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। তাই ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার উচিত সারাদেশে তাদের কাজকে ছড়িয়ে সর্বভারতীয় চেহারা প্রদান করা।

অতএব প্রথম ধারণা, অর্থাৎ কৃষিতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ কেবলমাত্র কৃষকদের প্রভাবিত করে এবং এটি কেবলমাত্র কৃষক ও কর্পোরেট সংস্থার দ্বিপাক্ষিক বিষয় - এই ধারণা ভ্রান্ত। আর দ্বিতীয় ধারণা যে, সারাদেশে কার্যকরী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য চালু করা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী তার যথোচিত বৃদ্ধি ঘটানো সরকারের পক্ষে অসাধ্য - এই ধারণা ভ্রান্ত। এই ধারণাগুলি চলমান কৃষক আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে - তাই এগুলিকে প্রতিহত করা প্রয়োজন।


অনুবাদঃ অর্ণব ভট্টাচার্য