৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮
‘কুসংস্কারাচ্ছন্নতা বাড়ুক’ ভাবনার বিপ্রতীপে
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
প্রবল প্রতাপশালী রাষ্ট্রের মদতে মানুষের মনে কুসংস্কার নির্ভরতা বাড়ানোর উদ্যোগ চলছে। তার বিপ্রতীপে মরণপণ লড়তে গেলে বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠনের বা বিজ্ঞানভিত্তিক সংগঠনের মাথায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন বনে যাওয়া কেউ বসে আছেন কিনা সেটা দেখে নেওয়া খুব জরুরি কাজ। বক্তৃতায় আগুনখেকো অথচ আগাপাশতলা কূপমণ্ডূক কেউ কেউ দলীয় পদের উত্তাপে বিজ্ঞান আন্দোলনেও নেপথ্য বা প্রকাশ্য কর্ণধার হয়ে উঠেছেন কিনা দেখে নেওয়ার আদর্শ সময় এখন। একটা অভিজ্ঞতা বলা যাক। দলের সভা করতে করতে একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। উপস্থিত সকলেই দ্রুততার সাথে ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দিয়ে গায়ের জামা-কাপড় খুলে দিলেন। দেখা গেল তাবিজ-কবজ শিকড়-বাকড় পলা নীলা গোমেদ ভরতি কোমর আর বাহুবন্ধনীতে। বিশেষ পরিস্থিতিতে চেনা গেল মুখোশের আড়ালে থাকা আসল মানুষটাকে। বাস্তবে তো কোনো যন্ত্র নেই যেটার সাহায্যে মুখের আর মনের আড়ালে রাখা মানুষটিকে আলাদা করে নেওয়া যাবে। তবে যত্ন, আগ্রহ, আন্তরিকতা, প্রয়োজনবোধ, বস্তুনিষ্ঠ মন থাকলে মানুষকে একটা স্তর পর্যন্ত বোঝা যায়। মাছের মাথা আগে পচে - সেই আপ্তবাক্য মাথায় রেখেই মঞ্চে বসে যাঁরা বিজ্ঞানের কথা বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা বলেন, বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে ঝড় তোলেন তাদের সততা সম্পর্কে মানুষকে সন্দেহমুক্ত করা দরকার। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে লড়াইয়ের ময়দানে সংহত করতে গেলে এটা করতেই হবে। মানুষের কাছে লড়াইয়ের ময়দানে নামার আহ্বান জানানোর আগে নিজেদেরকে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেবার উপযুক্ত করে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। কারণ মানুষ হাজার চোখে মঞ্চের মানুষগুলোকে দেখে।
কুসংস্কার ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ সবাইকে নানারকম ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ঠেলে দেয়। বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব থেকে মানুষের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস হয়, মনের দুর্বলতা বেড়ে যায়, প্রশ্ন করার মানসিকতা লোপ পায়, স্বাভাবিক যুক্তিপ্রবণতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুসংস্কারে আক্রান্ত পরিবারের শিশুরা মুক্ত চিন্তা মুক্ত মন নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না। মানুষের মনে গেঁথে থাকা বিশ্বাসগুলো আসলে অনেকটাই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইট-এর মতো কাজ করে। এদের আক্রমণে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার অনেক উদাহরণ আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ যেন প্রাণঘাতী না হয়ে ওঠে, সেটা যেন প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখে মানুষ। চিন্তার বিষয় একটাই, সৃষ্টিশীলতার স্থান যেন দখল করে না নেয় কুসংস্কার, মূর্খতা, কূপমণ্ডূকতা, আর অজ্ঞানতা। ফতোয়াবাজরা যেন সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু না করে। বিশ্বাস-নির্ভর ধর্মীয় উগ্রতা খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসের একটা প্রভাব সবসময়ই সমাজে বিদ্যমান ছিল। সব বিশ্বাস খারাপ নয়, কিন্তু অনেক বিশ্বাস হয়ত অনেক সময় জন্ম দেয় ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ যা অনেকসময় ‘এগিয়ে যাওয়া’ কে বাধা দেয়, এমনকী সভ্যতাকে ধ্বংস করে। ল্যানসেট ফ্লুক নামের প্যারাসাইটের প্রভাবে পিঁপড়ের মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয় - তখন পিঁপড়ে কেবল চোখ বন্ধ করে পাথরের গাছে ওঠা নামা করে। গোরু বা ছাগল ঘাসের সাথে পিঁপড়েগুলোকে খেয়ে নিলে ওই প্যারাসাইটগুলোর সুবিধা হয় নিরাপদে বংশবৃদ্ধি করতে। অনেক বিশ্বাস আর কুসংস্কারও ঠিক এইরকমই মানুষের ক্ষেত্রে এক একটা প্যারাসাইট হয়ে ওঠে। এই বিশ্বাসের ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারায় শত সহস্র মানুষ কখনো নাইন-ইলেভেনে, কখনো বাবরি মসজিদ ধ্বংসে, কখনো বা তাজ হোটেলে গোলাগুলিতে, কখনো আফগানিস্তানে, কখনো ইরাক, কখনো পাকিস্তানে বা কখনো বাংলাদেশে। মোদ্দা কথা তলিয়ে না ভেবে চোখ বুজে বিশ্বাসের এই মানসিকতা সমাজকে পঙ্গু করে দেয়। অধ্যাপক কানাজাওয়া বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন, ‘‘বিশ্বাস ব্যাপারটা একসময় টিকে থাকার ক্ষেত্রে বড়ো নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল... যেকোনো সময় ধার্মিকদের সংখ্যা নাস্তিকদের চেয়ে সাধারণত বেশি... নাস্তিকতা, যুক্তি বা বিজ্ঞানমনস্কতা, লিবারেলিজম প্রভৃতি উপাদানগুলো বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটে মানব সমাজের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন’’ (অভিজিৎ রায়, রায়হান আবীরঃ অবিশ্বাসের দর্শন, ২০১২, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃঃ ২১৭)। বিশ্বাস শুধু মানসিকভাবেই ব্যক্তিকে পঙ্গু এবং ভাইরাস আক্রান্ত করে ফেলে না, পাশাপাশি এর সার্বিক প্রভাব পড়ে একটি দেশের অর্থনীতিতেও।
যুগে যুগে খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু সহ সব ধর্মের মানুষ মৌলবাদীদের হাতে নিগৃহীত, নির্যাতিত কিংবা নিহত হয়েছে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশের কারণে। যেমন, ষোড়শ শতকে সুইৎজারল্যান্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্র এবং ভেষজ বিদ্যার অধ্যাপক ফিলিপ্রাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করেছিলেন - মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনো পাপের ফল কিংবা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ হলো জীবাণু। ওষুধ প্রয়োগে জীবানু নাশ করতে পারলেই রোগ ভালো হয়ে যাবে। এই ঘোষণার জন্যে ধর্মান্ধ বিচারকরা তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। দেশ থেকে পালিয়ে তাঁকে নিজের জীবন বাঁচাতে হয়েছিল।
ইতিহাস কিন্তু এই সাক্ষ্য দেয় যে, মনে জমে থাকা অসংখ্য কুসংস্কারের কালো নিকষ আঁধার দূর করে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে বিজ্ঞান। কোভিড পরিস্থিতিতেও নিশ্চয়ই মানুষের এই উপলব্ধি এসেছে, থালা বাটি গ্লাস বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে কোভিড দূর করা যায়নি। কোভিডের বিরুদ্ধে যতটুকু রুখে দাঁড়ানো গেছে আজ পর্যন্ত, সবটাই বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আবিষ্কৃত টিকা ব্যবহার করে ও অন্যান্য বিজ্ঞানসম্মত বিধিনিষেধ মেনে। সব ধরনের কুসংস্কার, অপবিশ্বাস ও অপযুক্তিকে প্রতিরোধ করতে আমাদের বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতেই হবে বিনা দ্বিধায়। ভুলে গেলে চলবে না ‘‘বিজ্ঞানের অবদান কি কেবল বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি বানিয়ে মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনা?... আসলে বিজ্ঞানের একটি মহান কাজ হচ্ছে প্রকৃতিকে বোঝা, প্রাকৃতিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা - বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য এখানেই...’’ (তদেব, পৃঃ ১৬)। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখা ‘মিলিত মৃত্যু’ কবিতার কয়েকটি লাইন আজকের দিনে বড়ো প্রাসঙ্গিক মনে হয় - “ বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়/ বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।/ বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।/ অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়/ অনায়াসে সম্মতি দিও না।/ কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,/ তারা আর কিছুই করেনা,/ তারা আত্মবিনাশের পথ/ পরিষ্কার করে।...” তাই মন জোগাতে নয়, মন জাগাতেও কিছু কথা বলা দরকার, কিছু কথা লেখার দরকার।