E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮

মুম্বাই হাই-এর পরিচালনভার বেসরকারি হাতে গেলে দেশে সংকট বাড়বে

শংকর মুখার্জি


দেশের হাইড্রোকার্বন ক্ষেত্রের সর্ববৃহৎ কোম্পানি অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন (ওএনজিসি)-এর খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডারও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে মোদি সরকার। গত ২৮ অক্টোবর পেট্রোলিয়ম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব অমর নাথ ওএনজিসি’ র চেয়ারম্যান এবং এমডি সুভাষ কুমারকে এক তিন পাতার চিঠি পাঠিয়েছে। ওই চিঠিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই ইচ্ছার কথা প্রকাশ পেয়েছে। চিঠিতে পেট্রোলিয়ম মন্ত্রক ওএনজিসি’কে বলেছেঃ দেশের সর্ববৃহৎ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ক্ষেত্র মুম্বাই হাই এবং বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোর’র ৬০ শতাংশ অংশীদারিত্ব ও পরিচালনাভার কোনো বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে। প্রসঙ্গত, সুভাষ কুমারকে লেখা এটা অমর নাথের দ্বিতীয় চিঠি। প্রথম চিঠিটি তিনি লেখেন গত ১ এপ্রিল, ওইদিনই সুভাষ কুমার ওএনজিসি’র চেয়ারম্যান ও এমডি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। সেই চিঠিতেও বেসরকারিকরণের কথাই বলা হয়েছিল। দেওয়া হয় ওএনজিসি’র জন্য ‘সাত দফা অ্যাকশন প্ল্যান’। যার মধ্যে প্রধান ছিল রত্না-আর সিরিজ, কেজি বেসিন গ্যাস ফিল্ড এবং অন্যান্য পরিকাঠামোর পরিচালনভার দেশি-বিদেশি করপোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পরামর্শ।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ওএনজিসি ‘মহারত্ন’ কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত হয়। সংস্থার মালিকানাধীনে দেশে যতগুলি খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র আছে তার মধ্যে বৃহত্তম হলো মুম্বাই হাই এবং বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোর। ওএনজিসি’র উৎপাদিত খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৬৬ শতাংশই আসে মুম্বাই হাই এবং বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোর থেকে। এই দুই সম্পদ যদি ওএনজিসি’র থেকে চলে যায় তাহলে তাদের কাছে ছোটো ছোটো তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রগুলিই শুধু অবশিষ্ট থাকবে। যেটা ওএনজিসি’র ভবিষ্যতের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই এক অশনি সংকেত।

পেট্রোলিয়ম মন্ত্রকের বক্তব্য হলোঃ তেল ও গ্যাসের এই দুই ক্ষেত্র থেকে যতটা উৎপাদন হওয়া সম্ভব তা করতে পারছে না ওএনজিসি। হয়তো বা এর কিছু সত্যতা আছে। গত তিন বছরের ওএনজিসি’র তেল ও গ্যাস উৎপাদনে চোখ বোলালেই তার একটা ইঙ্গিত মেলে। ২০১৮-১৯ বছরে ওএনজিসি ২১.১ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল এবং ২৪.৬৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করেছিল। এর পরের দু’বছরে উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ বছরে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন হয়েছে যথাক্রমে ২০.৬ মিলিয়ন টন এবং ২০.২ মিলিয়ন টন। একইভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনও ওই দু’বছরে ক্রমান্বয়ে কমে হয়েছে যথাক্রমে ২৩.৭৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার এবং ২১.৮৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। মুম্বাই হাই এবং বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোর সর্ববৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র এবং এর ওপরই ওএনজিসি’র বাৎসরিক উৎপাদন অনেকটাই নির্ভর করে। তাই ওপরের তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই দু’জায়গায় গত দু’বছরে উৎপাদন কম হয়েছে, যার অবশ্যাম্ভাবী প্রভাব কোম্পানির মোট উৎপাদনে পড়েছে।

উৎপাদন কম হওয়ার সমাধান বেসরকারিকরণে মিলবে - কেন্দ্রীয় সরকারের এই যুক্তি ধোপে টেকে না। উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে পরিচালনাগত কিংবা কারিগরি-প্রযুক্তিগত কোনো ত্রুটি আছে কীনা তা অবশ্যই অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। থাকলে দ্রুত তা কাটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। দায়িত্ব পালনে অবহেলা থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই উৎপাদন কম হওয়ার সমস্যার মূলে পৌঁছনো যাবে। তার সমাধানের রাস্তাও মিলবে। কেননা ওএনজিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে এসেছে। এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বেসরকারিকরণ করলেই উৎপাদন বেড়ে যাবে - আসলে এসব কেন্দ্রীয় সরকারের অপযুক্তি।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নিয়ে মোদি সরকারের নীতি আমাদের অজানা নয়। এনডিএ ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেছিল, স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের কয়েকটা সংস্থা ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সরকার রাখবে না। নীতি আয়োগ তার তালিকাও ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করে ফেলেছে। সেই অনুযায়ী কিছু সংস্থার সরকারের হাতে থাকা সমস্ত শেয়ার তারা বেচে দেবে এবং সরকারের হাতে থাকা কিছু সংস্থার ৫১ শতাংশ শেয়ার বেচে দেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতেই ওএনজিসি নিয়ে এরকম পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্র।

সরকার তার নীতি অনুযায়ী ইতিমধ্যে দেশের হাইড্রোকার্বন ক্ষেত্রের অন্যতম প্রধান কোম্পানি এইচপিসিএল’র ৫১ শতাংশ শেয়ার বেচে দিয়েছে। তবে সে শেয়ার ওএনজিসি’ই কিনেছিল। সেইজন্য এইচপিসিএল’র মালিকানা এখনো কোনো বেসরকারি সংস্থার হাতে যায়নি। অন্যদিকে আরেক তেল কোম্পানি বিপিসিএল’র বেসরকারিকরণের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনেকদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। বর্তমানে তার রূপায়ণের প্রক্রিয়াও অনেকদূর এগিয়েছে।

ওএনজিসি’র সম্পদ ধাপে ধাপে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের পুরনো। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে পেট্রোলিয়ম মন্ত্রক ১৫টা তেল ও গ্যাস উৎপাদন ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে বেসরকারি সংস্থার কাছে তুলে দেওয়ার জন্য। এই উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির সম্মিলিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ৭৯১.২ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল এবং ৩৩৩.৪৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস। ওএনজিসি’র তীব্র বিরোধিতা ফলে তখন এ কাজে সফল হয় নি কেন্দ্রীয় সরকার। এর একবছর পর ঠিক একই উদ্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার আবার ১৪৯ টি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে। ঠিক হয়, শুধু বড়ো উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি ওএনজিসি নিজে পরিচালনা করবে। এখন মুম্বাই হাই এবং বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোরের মতো বড়ো ক্ষেত্রগুলির দিকেও সরকারের কুনজর পড়েছে।

ওএনজিসি নিয়ে মোদি সরকারের দ্বিতীয় পরিকল্পনাটার সিদ্ধান্ত হয় ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রীসভার বৈঠকে। সিদ্ধান্তটা ছিল, ওএনজিসি’র ৬৪ টা প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণ করা হবে। এর জন্য যে টেন্ডার ডাকা হয়, তাতে মধ্যমরকমের সাড়া মেলে। এর মধ্যে ৪৯ টি খনিকে এই শর্তে দেওয়া হয় যে, আগামী তিন বছর এর কাজকর্ম কঠোরভাবে নজরজারিতে রখবে ওএনজিসি। কেন্দ্রীয় সরকার এই সব পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নেওয়ার পর গত ছ’মাসে এই দুই চিঠি ওএনজিসি’কে দিয়েছে।

ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগ তৎকালীন বোম্বে হাই-তে খনিজ তেলের ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়। সমুদ্রের মধ্যে কূপ খননে সক্ষম ‘সাগর সম্রাট’ নামে এক জাহাজ বোম্বে থেকে ১৬০ কিমি দূরে খননের কাজ শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বোম্বে হাই থেকে তেল উত্তোলন শুরু হয়।সম্পূর্ণ স্বনির্ভরতা অর্জিত না হলেও এরপর থেকে ভারতের শক্তিক্ষেত্রের ক্যানভাসটা আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করে। এই বোম্বে হাই-এর নামই পরে হয় মুম্বাই হাই। মুম্বাই হাই-তে খনিজ তেলের প্রমাণিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ১৬৫৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ১২ লক্ষ টনের বেশি। আর বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোরের উৎপাদন শুরু হয় ১৯৮৮ সালে।

ভারতে যা অপরিশোধিত তেল উৎপাদন হয় তা দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। দেশের চাহিদার ৮৪ শতাংশ তেল ও ৪৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এরজন্য ২০১৯-২০ বছরে ১০১.৪ বিলিয়ন ডলার এবং২০১৮-১৯ বছরে ১১১.৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। স্বাধীনতার পরও দেশের তেল পরিশোধন ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করত বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলি। দেশের স্বার্থে এদের ভূমিকা প্রায়শই নেতিবাচক থাকত। এই বিদেশি সংস্থাগুলিকে জাতীয়করণের দাবিতে কলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনগণ আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল বামপন্থীরা। এই আন্দোলনের ফলেই গত শতকের সত্তরের দশকে বিদেশি তেল কোম্পানি ক্যালটেক্স, ইএসএসও, বারমা সেল জাতীয়করণ হয়। যদিও এর আগেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট ওএনজিসি তৈরি হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, দেশে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চয় আবিষ্কার করা। এর ১০ বছরের মধ্যেই ১৯৫৮ সালে কাম্বেতে, ১৯৬০ সালে গুজরাটে এবং ১৯৬৩ সালে অসমে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে দেশের খনিজ তেল উৎপাদনের ৭১ শতাংশ করে ওএনজিসি।

মুম্বাই হাই এবং বেসিন ও স্যাটেলাইট অফসোর বেসরকারিকরণ হলে দেশের যে সামান্য খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চয় রয়েছে তাও দেশি-বিদেশি করপোরেটদের খপ্পরে চলে যাবে। হাইড্রোকার্বন ক্ষেত্রে গত সাড়ে ছয় দশকে ভারতে যতটুকু স্বনির্ভরতা অর্জন হয়েছে তাও হাতছাড়া হবে। বিদেশি বহুজাতিকদের মালিকানায় দেশের তেল সম্পদ চলে গেলে সরকারের নিয়ন্ত্রণও তার ওপর অার থাকবে না। গত শতকের ষাটের ও সত্তরের দশকের মতো বিদেশি কোম্পানিগুলি দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে যে কাজ করবে না সে নিশ্চয়তাই বা কে দেবে!

দেশের রাজস্ব তহবিলে ওএনজিসি’র অবদান বিরাট। ২০২০-২১ বছরে ওএনজিসি’র নেট লাভ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। মোট ব্যবসার পরিমাণ ৬৮ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। প্রতিবছর ডিভিডেন্ড ও অন্যন্য কর বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের রাজস্ব তহবিলে জমা করে তারা। ওএনজিসি’র বেসরকারিকরণ হলে ভারতের তেল সংকট আরও বাড়বে শুধু নয়, রাজস্ব সংগ্রহ হ্রাস পাবে, বিদেশি মুদ্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। ভারত আরও বেশি বেশি করে আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ফলে দেশের বাজারে পেট্রোল, ডিজেল,এলপিজি এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আরও লাগামছাড়া হবে।