৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮
সোচ্চার চিন্তা
নেভা পিদিমের পোড়া তেল এবং আরও কিছু কথা...
পল্লব সেনগুপ্ত
খবরের কাগজের ভিতরের একটা পাতার এক কোণে খুব সংক্ষেপে লেখা একটা অবহেলিত সংবাদের দিকে আপনাদের ক’জনের নজর পড়েছে জানিনে। খবরটা পড়ে কিন্তু আমার শৈশবকালের একটা খুব কষ্টের স্মৃতি ফিরে এলোঃ সেটা পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী ক্ষুধার্ত, অসহায় বাংলার দুঃখ, যন্ত্রণাভোগের রাক্ষসি বেলা; যখন নিরন্ন, ক্ষুধার্ত মানুষের ঢল নেমেছিল কলকাতা মহানগরীর বুকে এবং খুব কমসম করে-ধরা হিসেবেই অন্তত এক লাখ মানুষ - নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু নির্বিশেষে পথের ওপরে মারা গিয়েছিল সরকারের উদাসীনতায় এবং কিছু সংখ্যক অসৎ বিত্তবানের অর্থলোলুপতার কারণে। ...ওই বয়সে এতকিছু অবশ্য বুঝতাম না অবশ্যই। তবে এটুকু মনে আছে যে, রোজ দুপুরে মা-জ্যেঠিমা-ঠাকুমারা যখন খেতে বসতেন - তখন কারা যেন এসে ‘‘মা একটু ফ্যান দে, মা দুটো মুড়ি দে মা’’ বলে কাঁদত আমাদের কালিঘাট রোডের বাসাবাড়ির নাছদুয়ারের কাছে এসে। মা কিংবা জ্যেঠিমা, অথবা বাড়ির আরও কেউ (অবশ্যই মেয়েদেরই কেউ - কারণ পুরুষদের আর ছোটোদের তার বেশ কিছু আগেই দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে যেতো) গিয়ে নিজের পাতের না-খাওয়া ভাতগুলো তাদেরকে ধরে দিয়ে আসতেন। আর তারা (এক-একদিন এক একটা দল) সেই ক’টা ভাতই প্রায় কাড়াকাড়ি করে খেত।
এটা শুধু আমাদের সেই পটুয়াপাড়ার দৃশ্য নয়। পরে বড়ো হয়েছি যখন, জেনেছি যে এই ভীষণ কু-নাট্যটি অভিনীত হতো শহরের হাজার-হাজার মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পল্লিতে - যার কুশীলব ছিল লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু। নিরন্ন, বিপন্ন, মৃত্যুর আতঙ্কে ডুবতে-ডুবতেও বাঁচতে-চাওয়া মানুষ।
এসব ঘটনার বিবরণ সমসাময়িক সংবাদপত্রে খুঁজে দেখলে পাওয়া যাবে। আর পাওয়া যাবে সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যে, নাটকে, কবিতায়। চিত্তপ্রসাদের, সোমনাথ হোড়ের, জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবিতে। লাখের ওপর মানুষ ফুটপাতে পড়ে মরেছে। বিনা অন্নে, বিনা ওষুধে, বিনা সাহায্যে। কিন্তু একটা খাবারের দোকানও লুট হয়নি, একটা বিয়ে বাড়ির ভুরিভোজের আসরেও ঝাঁপিয়ে পড়ে কেড়েকুড়ে খায়নি কেউ! ফুটপাথে বসে নেড়ি কুকুরদের সঙ্গে মারপিট করে ফেলে-দেওয়া বাসিপচা বিয়ে বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাদ্যগুলো খেয়েছে। এবং মরেছে।
।। দুই।।
যাক সেসব কথা। আজকে হঠাৎ এই প্রায় আট-দশক পরে সেইসব কথাগুলো স্মৃতির সমাধি খুঁড়ে বার হয়ে এলো কেন, এবারে বলি। না, এই খবরের কাগজের একটেরেয় ঠাঁই-পাওয়া খবরটা ধনীর বাড়ির উৎসবের উচ্ছিষ্ট ভোজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ির বিবরণী নয়। তবে, নির্মম-বাস্তব এই অতি-সত্যি ঘটনাটা সেই উৎসব শেষে ধনীগৃহের ফেলে দেওয়া বাসি-পচা খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি করার ইতিহাস কথারই সমগোত্রীয় বটে!
একটু খুলেই বলি বরং সবটা। গত ৪ নভেম্বর দেশজুড়ে দেওয়ালি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোটি কোটি টাকার বাজি পুড়েছে, অগণিত প্রদীপ জ্বলেছে, আনন্দের হররা ছুটেছে। যদিও ঠিক সেই সময়েই পেট্রোল ‘১০০+’ টাকা লিটার, ডিজেল ‘৯০+’, সরষের তেল ‘২০০’ ছুঁই-ছুঁই এবং আটা-চাল-আলু-বেগুন-কুমড়ো দেশজুড়েই অগ্নি নয় - দাবানলমূল্য! তো, এই অঘোষিত ‘রাক্ষসি বেলা’ (শব্দটা আরও একবার ব্যবহার করলাম, মাপ করবেন আপনারা) এবং ঘোষিত ‘অচ্ছে দিন’-এর এই যে সময়টা - হুল্লোড়ের হট্টচট্টর মধ্যেও সেই সময়টাতেই দেশের মানুষ হন্যে হয়ে বাঁচবার নিরুপায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সেই রকমেরই একটা করুণ এবং মর্মান্তিক হতাশ-লজ্জার ছবি তুলেছেন উত্তর প্রদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সূর্যপ্রতাপ সিং - যিনি কর্মজীবনে ছিলেন ওই রাজ্যেরই একজন অবর-মধ্যবর্গের আমলা। জানিনে, এই ছবি সাধারণ্যে প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ যোগীরাজের বাহন মত্তষণ্ড এবং কণ্ঠভূষণ হিংস্র সর্পের দল ইতিমধ্যেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কি-না!
যা-ই হোক, ঘটনাটা কী বলি এবারে। ওই দেওয়ালি উপলক্ষ্যেই উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকারের এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ মদতে ‘পুণ্যধাম’(!) অযোধ্যার (রামের জন্মভূমি বলে কথা!) পাশের সরষূ নদীর দুই পাড়ে - বেশি না, মাত্তর দশ লক্ষ ঢাউস মাপের মাটির পিদিমে প্রয়োজন মাফিক সরষের তেল ঢেলে সেগুলো জ্বালানো হয়েছিল। আহা, ‘‘রামজি-লছমনজি-ভরতজি ঔর শতয়নজিনে উনলোগোঁকো বচ্পনমে ইস সর্যু নদীকে পাশ কিতনে খেলকুদ কিয়া - ওভিতো ইয়াদমে রাখনা চাহিয়ে ইস দিবালিকে, মৌকে মে!’’ সুতরাং, রামানুচরবৃন্দ (না-না, কোনও তির্যক বিদ্রূপ করিনি ভাই, সাদাসাপটা রামভক্তদেরকেই বোঝাতে চেয়েছি!) যোগীবরের ‘‘আশীর্বচন লে কর্ বড়ি ধুমধামসে সবহি দিয়া জ্বলা দিয়া!’’ আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো রামজন্মভূমির আকাশবাতাস!
কিন্তু সমস্যাটা হলো পরদিন। বরং বলি, ওই দেওয়ালিরই শেষ রাতে যখন প্রায় সব প্রদীপই নিভু-নিভু, কোথা থেকে খবর পেয়ে হাজার কয়েক গরিব মানুষ - মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি, এসে জুটলেন হাতে বড়োসড়ো একটি করে ডাব্বা নিয়ে। তারপরে? ...তারপরে উৎসব-মোচ্ছবের পরিশেষে ওই দশ লক্ষ প্রদীপের মধ্যে যেটুকু, যতটুকু করে পোড়া তেল পড়ে ছিল - তাই কাড়াকাড়ি করে ওঁরা ডাব্বায় ভরতে লাগলেন। হোকগে পোড়া, কড়ুয়া (সরষে) তেল তো বটে! ক’দিন তো গরিবের রসুই ওতেই হবে। ২০০ টাকা লিটারের তেল কিনে খাবার পয়সা কোথায় নোট-বন্দী-পরবর্তী, লকডাউন-পরবর্তী ‘অচ্ছে দিনে’? মানে, গরিব মানুষের? তাই পোড়া কড়ুয়াই সই!
।। তিন।।
সূর্যপ্রতাপ সিং ওই পোড়া তেল সংগ্রহের ভিডিয়ো তুলেই ক্ষান্ত হননি! সেই ছবি একটি টিভি চ্যানেলকে দিয়েছেনও। এবং তারপরে ঘটনাটার ছবি ভাইরাল হয় মিডিয়ায়। কিন্তু ওই একবারই, তারপরেই নিউজ রিলটি - সাংবাদিকতার পরিভাষায় ‘কিলড’ অর্থাৎ নিহত হয়! এবং বিজেপি’র সরকারি বিজ্ঞাপনজীবী পত্রিকাগুলিও বেমালুম চেপে যায়! শুধুমাত্র দু-একটি পত্রিকা একটু বেহিসেবি হয়েই খবরটা নিংড়ে শুকনো পাতি লেবুর রসের মতো পরিবেশন করে ফেলে এখন প্রমাদ গুনছে।
ঘটনাচক্রে টিভি-তে খবরটা ওই একবার দেখানোর সময়েই এই অভাজনের চোখে পড়ে যায়। এবং পরের দিন একটা টিএমসি-পন্থী দৈনিকপত্রেও এককোণে খবরটা দেখি। স্বভাবতই, খবরটা দেখেই আমার শৈশব স্মৃতির মর্মন্তুদ পুনরাবির্ভাব ঘটলো। ...একটু খোঁজাপাতা করে সূর্যপ্রতাপ বাবুর ভিডিয়ো-সংশ্লিষ্ট বক্তব্যটাও পাওয়া গেল। উনি হিসেব দিয়েছেন, দশ লক্ষ প্রদীপের জন্য যে পরিমাণ সরষের তেল খরচ করেছে ইউপি সরকার এবং অযোধ্যার স্থানীয় প্রশাসন - তার মোট ওজন প্রায় তিরিশ হাজার লিটার। উনি একটা সাদামাটা হিসেবে বলেছেন যে, ওই পরিমাণ তেলের বাজার দর এখন যা (প্রায় ২০০ টাকা লিটার) - সেই পরিমাণ টাকা বস্তুতপক্ষে স্রেফ ধর্মের নামে, উৎসবের নামে স্রেফ পুড়িয়ে নষ্ট করা হলো। আধ লিটার করেও যদি না-পোড়া তেল দেওয়ালি উপলক্ষ্যেই যদি সরকারি উদ্যোগে পরিবার পিছু দেওয়া হতো, তা হলে তো ষাট হাজারটা ফ্যামিলির উপকার হতো! এখন ওই পোড়া তেল - যা বিষাক্ত হয়ে, খাওয়ার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত - তাই দিয়ে রাঁধা খাবার খেয়ে কত হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বেন - আরও খারাপও কিছু হতে পারে অবশ্যই। তার দায় কে নেবে? যোগী সরকার? অযোধ্যা প্রশাসন? ...আর পোড়া তেল নিয়ে যখন কাড়াকাড়ি চলছিল, তখন অযোধ্যার পুলিস কী করছিলো? নিশ্চয়ই ওই তেল নাকে দিয়ে ঘুমোচ্ছিল না? তারা ঠেকায়নি কেন?
এই পোড়া-তেলে অন্নব্যঞ্জন রাঁধার ব্যাপারটাকে প্রতীকী বলেও ধার্য করা যায়। মোদি-রাজত্বে জনগণের জন্যে যা বরাদ্দ হয়ে চলেছে, তা তো সর্ব অর্থেই পোড়া-তেলের ব্যঞ্জনতুল্য! মরণবিষ!! ...ধর্মের বিভাজন - বিষ; জাতীয় সম্পত্তি একের পর এক বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া - বিষ; নোটবন্দী - বিষ; জিএসটি - বিষ; সংখ্যালঘু এবং দলিত নিপীড়ন - বিষ; জিডিপি-র তলানি ছোঁয়া - বিষ; সব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঘেঁটে ফেলা - বিষ; ইতিহাস এবং বিজ্ঞানকে তছনছিয়ে প্রচার করা - বিষ; কোভিড মহামারী নিয়ে ব্যর্থতা - বিষ; ধনীদের আরও ধনী করে তোলা, গরিবকে আরও গরিব করা - বিষ... ইত্যাদি, ইত্যাদি।
।। চার ।।
যে প্রসঙ্গ ধরে লেখাটা শুরু করেছিলাম, তার সূত্র ধরেই আরও একটু কথা বলে নিই। যে সময়টার কথা বলেছি তখনকার অন্ধকার দিনগুলো যেন আবার হাতছানি দিচ্ছে এই ‘‘অচ্ছে দিনের’’ ধোঁকার টাটির আবডালে। অবশ্য তখন ওই দুঃসময়টা মূলত প্রাক্-স্বাধীনতা আমলের অখণ্ডিত বাংলার বুকেই নেমে এসেছিল। আর এখন সমাসন্ন-প্রায় দুঃসময় সারা ভারতকেই খামচে ধরেছে। বাংলার বুকে লক্ষাধিক মানুষ না-খেয়ে মরেছিল, তখন বাংলার লোকসংখ্যা কোটি খানেকের মতো ছিল। অর্থাৎ, ইসপাহানি, সুরাবর্দি, মুসলিম লিগের অপশাসন, হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের উদ্ভ্রান্ত রাজনীতি এবং সর্বোপরি বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের প্রশ্রয় - সবটা মিলিয়েই পঞ্চাশের মন্বন্তর অমন করাল হয়ে উঠেছিল। বিপন্ন মানুষের সেবায় সীমাবদ্ধ সামর্থ্য সম্পন্ন কমিউনিস্টরাই শুধু আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
আবারও দেশে নিরন্নতা, গণবুভুক্ষা হু-হু করে বাড়ছে। আর তা বাড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকাচ্যুত হয়ে পড়ায়। এবং সেটা ঘটেছে জনস্বার্থ বিরোধী এবং ধনী তোষণকারী, বিদেশি শক্তির অনুগ্রহ ভিক্ষুক এই বিজেপি সরকারের অপশাসনের কালে।
যে-মন্বন্তর প্রায় আট দশক আগের একটা শিশুর মনে এমনই ভয়াল বীভৎসার প্রগাঢ় ছাপ ফেলেছিল যে, সেটা সে এই এতগুলো বছর পরেও ভোলেনি। ভুলতে পারেনি। সেই রকমেরই ভয়াল মন্বন্তর কি আসছে আবার? শুধু একটা অঞ্চলেই নয় ১৯৪৩-এর মতো। সম্ভাব্য সেই মন্বন্তরের বলি হবে সারা ভারতই। কত মানুষের মৃত্যু হবে তাতে? কে তা বলতে পারে! ১৩৫ কোটি মানুষের দেশে তার সংখ্যাটা কত হবে? কেউ বলতে পারেন? ভাবতেও কি পারেন? ১০ লক্ষ নিভন্ত প্রদীপ আর তাদের পোড়া তেল হয়তো সেই মারণপর্বেরই পূর্ব সঙ্কেত!