৫৯ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১২ নভেম্বর, ২০২১ / ২৫ কার্ত্তিক, ১৪২৮
পরিবেশ আলোচনা
বহরমপুরে ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি রক্ষায় লড়াই
তপন মিশ্র
অনশনমঞ্চ থেকে পুলিশ আটক করছে এক বৃদ্ধ আন্দোলনকারীকে।
জলাভূমি রক্ষার দাবিতে গত ২৭ অক্টোবর বহরমপুর শহরে অনশনে-বসা পরিবেশ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বহরমপুরে অক্টোবর ২৭ থেকে ২৯ - এই তিনদিনের রিলে অনশনের কর্মসূচি এবং তার জন্য প্রশাসনের অনুমতি সংগঠকদের কাছে আগে থেকেই ছিল। তা সত্ত্বেও অতিমারীকে অজুহাত করে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের সুযোগ নিয়ে অনশন আন্দোলনের প্রথম দিনেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে অনশন আন্দোলনে থাকা অনেক প্রবীণ মানুষসহ পরিবেশ কর্মীদের।
রাজ্য সরকার ২০১১-১২ সালে একটি স্লোগান বেশ প্রচারে এনেছিল। এখন আর সেই স্লোগান খুব একটা চোখে পড়ে না। স্লোগানটি হলোঃ ‘জল ধরো - জল ভরো’। যদি জলাভূমি না থাকে তাহলে জল ধরে জল ভরবেন কোথায়? জলাভূমি না থাকলে মাটির নিচের জলস্তর শুকিয়ে ব্যবহারযোগ্য জলের টান পড়তে বাধ্য। প্রশাসনের নাকের ডগায় বুজিয়ে-ফেলা জলাভূমি রক্ষার আন্দোলনকে প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে থামিয়ে দিয়ে যে বার্তা সরকার দিল তা সর্বতোভাবেই জল সংরক্ষণ ভাবনার বিরোধী।
জলাভূমি কমছে। খবরটা আজ আর নতুন নয়। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, বিনষ্ট হচ্ছে মৎস্যসহ জলজ উদ্ভিদের উৎস। বর্ষার জল সংরক্ষণের জায়গা কমছে, মাটির নিচের জলস্তর নেমে যাচ্ছে হু-হু করে। এর পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। সেইজন্য সাধারণ মানুষকে বার বার অবহিত করার যে প্রয়াস নেওয়া দরকার তাতে সরকারের ঘাটতি আছে। সরকার নির্বিকার। এমনকী চাষবাসের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা সেচ ও প্রাত্যহিক কাজকর্ম নিয়ে যতটা আগ্রহী, জলাভূমি এবং তার সংরক্ষণ নিয়ে ততটা ভাবিত নন। এর কারণ - জলাভূমি কাকে বলে এবং পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তাঁদের নেই। সেই ধারণা তৈরি করার জন্যই মুর্শিদাবাদ জলাভূমি রক্ষা কমিটি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করে।
মুর্শিদাবাদের যে জলাধারগুলির অস্তিত্ব আজ সংকটে তার মধ্যে বহরমপুর শহরের কাছে রয়েছে দুটি ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি - চালতিয়া বিল এবং বিষ্ণুপুর বিল। এই দুটি বিলের ওপরই প্রথম আঘাত নেমে আসে। যদিও আরও প্রায় ৪১টি বিলের অস্তিত্ব আজ বিপদের মুখোমুখি।
চালতিয়া ও বিষ্ণুপুর বিলের সংকট
চালতিয়া বিলের আর একটি নাম ভাকুড়ি বিল। বিলটির অপরাধ হলো এই যে, এটির অবস্থান জনাকীর্ণ বহরমপুর শহরের কাছে। বিলটির ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা গবেষণামূলক অনুসন্ধান করেছেন মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা সূর্যেন্দু দে। তাঁর মতে বিলটি গঙ্গার এক পরিত্যক্ত অংশ। গঙ্গা একসময়ে এখান দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং ইংরেজির ‘ইউ’ (‘U’) আকৃতি হওয়ার পর তার গতিপথ পরিবর্তন করে। একে অশ্বক্ষুরাকৃতি জলাধারও বলা হয়। গঙ্গার দু’পাশে এমন বেশ কয়েকটি জলাধার আছে যেগুলির বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব অনেক বেশি। এই বিলটি আগে একটি নালার মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং একটি স্লুইস গেটও ছিল যা দিয়ে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
জল নিকাশির ক্ষেত্রে চালতিয়া বিলের গুরুত্ব অপরিসীম। সুবিশাল এই চালতিয়া বিলের এলাকা প্রায় ৩৫ একর। এর কতটা গায়ের জোরে জমি মাফিয়ারা ইতিমধ্যে দখল করে রেখেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া শক্ত। একদিকে জলাভূমি ভরাট এবং অন্যদিকে সরকারি তথ্য সংরক্ষণের ঘাটতি এই সম্পর্কে মানুষকে অন্ধকারে রেখেছে। সরকারি আমলারা মনে করেন, এই বিল যেন তাঁদের সম্পত্তি এবং সে ব্যাপারে মানুষকে জানানোর দায়িত্ব তাঁদের নয়। এই ক’দিন আগেও চালতিয়া বিল থেকে প্রতিদিন তিন কুইন্টাল মাছ বাজারে পাঠানো হতো। প্রায় ৩০০ মৎস্যজীবী পরিবারের জীবনজীবিকা এই বিলের সঙ্গে যুক্ত। একাধিকবার এই বিল ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। গত ২৩ অক্টোবর সর্বসমক্ষে ফের এই বিলের একাংশ ভরাটের অভিযোগে ওঠে। ট্রাক্টরে করে মাটি এনে বিলের একাংশে তা ফেলে ভরাট করা হয়।
একসময়ে ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নালা বিলের অতিরিক্ত জল বাইরে বহন করে নিয়ে যেত। সেই নালার অনেকটাই এখন দখল হয়ে গেছে। আশেপাশের বিভিন্ন দোকান এবং বাড়ির বর্জ্য এসে পড়ে এই বিলে। ২০১৫-১৬ সালে বিলটির জল এতটাই দূষিত হয়ে যায় যে, মাছ সহ সমস্ত জলজ প্রাণী মারা যায়। এখানকার মৎস্যজীবীরা তাই বিলের কচুরিপানা যাতে নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন। কচুরিপানা একদিকে যেমন অনেকটা দূষক শোষণ করে তেমনই মাছ ইত্যাদির খাদ্য ও আশ্রয়ও। বিলের এই দূষণই রোধ করতে সরব হয়েছে জলাভূমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। এঁদের সঙ্গে প্রতিবাদে যোগ দেন স্থানীয় ভাকুড়ি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা।
বিষ্ণুপুর বিলের এলাকা প্রায় ৮৩ একর। বহরমপুর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের এই জলাশয়টি বহরমপুর ব্লকের মধ্যে অবস্থিত। এই বিল থেকে কম করে প্রতিদিন ৫/৬ কুইন্টাল মাছ বাজারজাত হয়। এর উত্তর পুর্বে কাটিগঙ্গা। সূর্যেন্দুবাবুর মতে, এটিও গঙ্গার একটি পরিত্যক্ত জলাধার। দুই দশক আগে পর্যন্তও এই বিলে গঙ্গার জল ঢুকত। ফলে এটার একটা প্রাকৃতিক জলাধারের চরিত্র ছিল। বহরমপুর শহরের নিকাশিনালার জলও এই বিলে পড়ে। ২০১২-১৩ সালে অত্যধিক দূষণের ফলে বিলের সমস্ত মাছ এবং জলজ প্রাণী মারা যায়। পরে পাঙ্গাশ মাছ চাষ শুরু হয়।
এখানেও একইভাবে জলাভূমিদখল চক্র সক্রিয়। এখনই বিলের এক বড়ো অংশ দখল হয়ে গেছে। দোকানপাট, নার্সিং হোম, বহুতল আবাসন ইত্যাদি গড়ে উঠেছে বিলের জমি দখল করে। বিলের জলের গুণগত মান অনেকটাই খারাপ। জলে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ অনেকটাই বেশি।
এ এক অবিচ্ছিন্ন লড়াই
মুর্শিদাবাদ জেলার ৪১টি ছোটো বড়ো জলাধারের সংকোচনের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করছে জলাভূমি রক্ষা কমিটি। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সহ আরও কয়েকটি সংগঠন, সংস্কৃতি জগতের মানুষ, বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তি যুক্ত হয়ে ২০১৭ সালে গড়ে ওঠে এই সংগঠন। লাগাতারভাবে জলাভূমি দখলের প্রতিবাদে চলে আন্দোলন। এবারে এই আন্দোলন ভাঙার খেলায় নেমেছে সরকার। এর প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে বিজ্ঞান এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। আশার বিষয় যে, এই আন্দোলনের ফলে বেশ কিছু জলাভূমি রক্ষা করাও সম্ভব হয়েছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহম্মদ মাহামাদুর রহমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রায় তিন বছর গবেষণার পর মুর্শিদাবাদ জেলার ভৌম জলের আর্সেনিক দূষণের একটি মানচিত্র তৈরি করেন (Murshidabad-one of the nine groundwater arsenic-affected districts of West Bengal, India. Part I: magnitude of contamination and population at risk,Clin Toxicol (Phila),2005)। তাঁদের মতে এই জেলা রাজ্যের আর্সেনিক-প্রবণ ৯টি জেলার মধ্যে একটি। প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের বসবাস এই জেলায়। জেলার ভৌম জল কম-বেশি দুষিত হওয়ায় মাটির উপরের জলের উপর এখন নির্ভর করাই বেশি জরুরি। এব্যাপারেও প্রকৃতির কোনো কার্পণ্য নেই। মুর্শিদাবাদ জেলায় বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় প্রায় ১৩৭ সেন্টিমিটার। রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের তুলনায় অনেকটাই বেশি। ওই অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত ৯০-১২০ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। সেই বিচারে গঙ্গা পাড়ের এই জেলা একটু স্বস্তিতে। তবে মাটির উপরের জলাভূমি যে আর্সেনিক দূষণে দুষ্ট হবে না এমনটা নয়। তাই স্বাভাবিকভাবে মাটির নিচে জল সংরক্ষণও জরুরি হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক জল নিকাশি ব্যবস্থায় এক বড়ো ভূমিকা পালন করে জলাভূমিগুলি। জলাভূমিগুলির বায়ুমণ্ডলের কার্বন (গ্রিনহাউস গ্যাস) শোষণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। এর একটা বিশেষ কারণ হলো, এই সমস্ত পুরনো জলাধারগুলিতে ভাসমান এককোষী উদ্ভিদ যে সালোকসংশ্লেষ করে তার পরিমাণ কোনো অরণ্যের তুলনায় কম নয়। তাছাড়া রয়েছে ভাসমান অনেক গাছপালা। জলজীবী প্রাণীদের এটাই খাদ্যের মূল উৎস।
কেবল জলাভূমির সংরক্ষণই সমস্যার সমাধান নয়। জলাভূমির অববাহিকা সংরক্ষিত না হলে জলাভূমি পুষ্ট হবে না, বরং দিনে দিনে রুগ্ন হয়ে যাবে। ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক জলাভূমি সংরক্ষণের কিছু আইন তৈরি করে। যেমন, ওয়েটল্যান্ডস (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কনজারভেশন) রুলস,২০১০। এই আইনে জলাভূমির সঙ্গে যুক্ত মানুষের অধিকার এবং যৌথ উদ্যোগকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। জলাভূমির সঙ্গে যুক্ত মানুষ যেমন মৎস্যজীবীদের পারম্পরিক অধিকার রক্ষার বিষয়টিও এই আইনে ভাবাই হয়নি। যদি কেউ জলাভূমি সংরক্ষণের আইন অমান্য করে তাহলে কী কী শাস্তির ব্যবস্থা হবে তার কোনো উল্লেখ এই আইনে নেই। এছাড়াও শহরের নিকাশি নালা বয়ে আনছে যে যে দুষিত পদার্থ সেগুলির নির্দয়ভাবে জলাভূমিগুলিতে ফেলার যে প্রক্রিয়া সারা দেশে চলছে তার কোনো সুরাহার কথা এই আইনে রাখা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে জলাভূমি সংরক্ষণের আইন থাকলেও, যে বিশেষ জলাভূমির কথা এখানে আলোচিত হলো সেগুলির ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগের কোনো প্রয়াস সরকারের নেই।
একারণে যে দাবিগুলি মুর্শিদাবাদ জেলার জলাভূমি রক্ষা কমিটি তুলে ধরেছে সেগুলি হলো - প্রথমত, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় জলাভূমি দখলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিলগুলির সংস্কার এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে যে গবেষকরা এবিষয়ে কাজ করছেন তাঁদের সাহায্য নিতে হবে। তৃতীয়ত, বিলগুলিতে নিকাশি নালা দিয়ে যে জল পড়ে তার শোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, বিলগুলির বহির্গমন নালার সংস্কার করতে হবে যাতে এগুলি বদ্ধ না হয়ে যায়।
এ সমস্যা কেবল মুর্শিদাবাদ বা বহরমপুরের নয় এসমস্যা সারা বাংলার। সরকার প্রতিবাদীদের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব পোষণ না করে যদি স্থানীয় মানুষদের নিয়ে বিল রক্ষা সমিতি ইত্যাদি তৈরি করে, তাদের হাতে জলাভূমিগুলির সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়, তাহলে সম্যসার অনেকটা সমাধান সম্ভব হতো।