৫৯ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১৩ আগস্ট, ২০২১ / ২৭ শ্রাবণ, ১৪২৮
গায়ের জোরে সংসদ অধিবেশন দু’দিন আগেই মুলতবি ঘোষণা
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ নির্দিষ্ট সময়ের দু’দিন আগেই সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি হয়ে গেল। এবারের বাদল অধিবেশন সংসদের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়ের নজির রাখল। দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে চলছে এক কালা অধ্যায়। লোকসভা, রাজ্যসভা- সংসদের দু’কক্ষেই চলছে সংসদীয় পরিকাঠামোর নেতিবাচক ব্যবহার করে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ভ্যাকসিন বণ্টনে অপদার্থতা, বন্যা বিপর্যয়, সংসদের দোরগোড়ায় যন্তরমন্তরে কৃষক সংসদের অবস্থান থেকে পেগাসাস বিতর্ক নিয়ে দেশজুড়ে এমনিতেই প্রবল চাপে আরএসএস-বিজেপি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা- জোরালো হচ্ছে মোদী-শাহের পদত্যাগের দাবি। এই পরিস্থিতিতে চলতি বাদল অধিবেশনে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করার আরও এক চরম নজির তৈরি হচ্ছে। সংসদকে পাশ কাটিয়ে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করার পাশাপাশি চলছে আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই মরজিমাফিক একাধিক জনবিরোধী ও দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বিল পাশ করানোর মতো চরম স্বৈরাচারী কার্যকলাপ। ১৯ জুলাই শুরু হওয়া এই অধিবেশনে শুরু থেকেই সংসদের ভেতরে-বাইরে বিরোধীরা লাগাতার সোচ্চার প্রতিবাদ করলেও ভ্রূক্ষেপ করছে না আম্বানি-আদানি সহ কর্পোরেট পুঁজির আজ্ঞাবহ এই সরকার। আলোচনার দাবিতে বিরোধীদের স্লোগানে কোণঠাসা সরকার দফায় দফায় অধিবেশন সাময়িক মুলতবি করে দিয়েছে। ১৩ আগস্ট পর্যন্ত এই অধিবেশনের মেয়াদ ছিল।
দুই কক্ষ মিলিয়ে বাদল অধিবেশন প্রায় ১৯ দিনের। এই অধিবেশন শুরুর আগে দু’কক্ষ মিলিয়ে ৩৮টি বিল বকেয়া ছিল, যার মধ্যে ১৭ টি উত্থাপিত হবার এবং ৯টি বিল আলোচনা সাপেক্ষে পাশ হবার কথা ছিল। ১০ আগস্ট পর্যন্ত মোট ২১টি বিল সংসদে পাশ হয়েছে। শুরু হবার পরই ফোনে আড়িপাতা কাণ্ড নিয়ে আলোচনার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সংসদের দুই কক্ষ। কংগ্রেস, সিপিআই(এম), সিপিআই, আরজেডি, ডিএমকে সহ বিরোধীরা একজোটে কেন্দ্রকে আক্রমণ করে। উভয় কক্ষেই বিরোধীদের বেশকিছু সদস্য এ নিয়ে আলোচনার জন্য মুলতুবি প্রস্তাব আনেন তবে লোকসভার অধ্যক্ষ ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তার সবক’টি খারিজ করে দিয়েছেন। বিরোধীদের সমর্থনে অন্যান্য অনগ্রসর অংশের (ওবিসি) জন্য সংরক্ষণ বিলে (১২৭তম সংবিধান সংশোধনী বিল) পাশ হয়। একজোট হয়ে তারা সংরক্ষণ বিলে সমর্থন দিলেও নির্দিষ্ট ইস্যুতে আলোচনার দাবি জানানোর পথ থেকে তারা সরেনি। যদিও প্রবল হট্টগোলের মধ্যে আলোচনা থামিয়ে পাশ হয়ে গেছে অন্যান্য বিলগুলি। লোকসভায় হট্টগোলের মধ্যেই সামান্য আলোচনার পর একই কৌশলে পাশ করানো হয়েছে তিনটি বিল। বিরোধীদের সম্মিলিত প্রতিবাদের মধ্যেই পাশ হয়েছে বিমা সংশোধনী বিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে সংশোধনী বিল বিরোধীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে পাশ করিয়ে নিলো মোদী সরকার। ধ্বনি ভোটেই বিল পাশ করিয়ে নেয় সরকার। ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও’র কাছ থেকে সরকার পেগাসাস স্পাইওয়্যার কিনেছে কিনা তার জবাব যথাযথ হয়নি বলে রাজ্যসভায় তুমুল হইচই হয়। ২২ জুলাই রাজ্যসভায় বিবৃতি দিয়ে পেগাসাস প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বিষ্ণোই যা বলেছেন তাতে আসল জবাব নেই।
রাজ্যসভায় লিখিত প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছিল পেট্রোল-ডিজেলে কর চাপানোর জন্য বিপুল হারে দাম বেড়েছে। কর কিছু কমিয়ে দাম কমানোর কোনো উদ্যোগ কি নিচ্ছে কেন্দ্র? উত্তরে দাম কমানো হবে না বোঝাতে সরকারি বিনিয়োগ ও উন্নয়নের অজুহাত টেনেছে কেন্দ্র। মন্ত্রী লিখিত জবাবে বলেছেন, পেট্রোল এবং ডিজেলের থেকে সংগৃহীত অর্থ দেশে পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ এবং নানা উন্নয়নের যে পরিকল্পনা হয়েছে তাতে খরচ করা হচ্ছে।
যদিও সমীক্ষা জানাচ্ছে সরকারি বিনিয়োগ নিয়ে তার ঠিক উল্টো তথ্য। সরকারি বিনিয়োগ সবচেয়ে কমেছে উৎপাদন শিল্পে শেষ ত্রৈমাসিক জানুয়ারি-মার্চ ২০২১-এ তা কমে হয়েছিল ২০৯৩ কোটি টাকা, প্রথম ত্রৈমাসিকে এপ্রিল-জুন ২০২১ তা কমে হয়েছে ৪৮১ কোটি টাকা। কমেছে ৭২ শতাংশ হারে। একইভাবে পরিকাঠামো নির্মাণ-এর সরকারি বিনিয়োগ ছিল এক লক্ষ ৩৩ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা, তা কমে হয়েছে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। কমেছে ৪৮ শতাংশ হারে। পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে ৮০০০ প্রকল্প বকেয়া রয়েছে, এতে বিনিয়োগ প্রয়োজন ১৫৩.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা।
আবার কনস্টিটিউশন (আদিবাসী) অর্ডার সংশোধনী বিল তাড়াহুড়ো করে সামান্য আলোচনায় পাশ করানো নিয়ে সংসদে প্রতিবাদ জানান বিরোধীরা। বিরোধী সাংসদদের বক্তব্য, সামান্য আলোচনা করে বিল পাশ হচ্ছে। অনেকেই পুরো কথা শেষ করতে পারছেন না। তার আগেই বন্ধ করা হচ্ছে আলোচনা। প্রতি বিল পিছু ১০ মিনিটের বেশি আলোচনা হচ্ছে না কোনো বিলে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, হট্টগোলের মধ্যে কোনো আলোচনা ছাড়া যেভাবে বিল পাশ হচ্ছে তা গণতন্ত্র হত্যার শামিল। এভাবে যে সব সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে তা হলো ন্যাশনাল কমিশন ফর হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন, ন্যাশনাল কমিশন ইন্ডিয়ান সিস্টেম অফ মেডিসিন বিল সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিল।
একইভাবে রাজ্যসভায় তাড়াহুড়ো করে হই হট্টগোলে ট্রাইব্যুনাল রিফর্ম বিল পাশ সহ বিলোপ ঘটানো হলো ন’টি অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনালের। অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনাল বিলের মধ্যে রয়েছে ফিলম সার্টিফিকেশন অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনাল, জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন প্রোটেকশন অফ ভ্যারাইটি, ন্যাশনাল হাইওয়ে (ল্যান্ড অ্যান্ড ট্রাফিক) অ্যাক্ট ইত্যাদির।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে ৩ কৃষি আইন সহ চার দফা দাবিতে মোট ১১ দফা বৈঠক হয় কৃষকদের। কেন্দ্র প্রতিশ্রুতি দেয় বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী বিল পেশ হবেনা। অথচ সংসদের চলতি অধিবেশনে এই বিল নিয়ে আসার তোড়জোড় চলছে। তবে এই বিল পাশ না করানোর জন্য কৃষক সংসদের পক্ষ থেকে হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রকে।
বিরোধীরা মোট দু’দফায় সরকারের সংসদকে ঘিরে অগণতান্ত্রিক কাজের বিরুদ্ধে পরামর্শ করতে আলোচনায় বসেন। ৩ আগস্ট দিল্লিতে ১৭টি বিরোধী দলের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে কংগ্রেস নেতা এবং সাংসদ রাহুল গান্ধী বলেছেন, বিরোধীরা যত বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে ততো তাদের দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হবে বিজেপি-আরএসএস।
এর আগে ২৮ জুলাই ১৪টি বিরোধী দল বৈঠকে বসে রণকৌশল স্থির করেছে। রাজ্যসভার কংগ্রেস দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের কক্ষে চৌদ্দটি বিরোধীদল বৈঠকে বসে। কংগ্রেস, ডিএমকে, এনসিপি, সিপিআই(এম), সিপিআই, শিবসেনা, আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি, ন্যাশনাল কনফারেন্স, আম আদমি পার্টি, আইইউএম, আরএসপি, কেরালা কংগ্রেস(মনি), ভিসিকে এই বৈঠকে ছিল। তবে বিরোধীদের এই সম্মিলিত উদ্যোগ এড়িয়ে গেছে তৃণমূল।
সামনেই উত্তরপ্রদেশ সহ একাধিক রাজ্যে নির্বাচন। সদ্য পেরনো নির্বাচনগুলিতে একাধিক বিপর্যয়ের পর হিন্দুত্বের বড়ি পাহাড়প্রমাণ সমস্যা-সমালোচনা সামলাতে এখন সর্বরোগহর কিনা তা নিয়ে ধন্দে বিজেপি।কৃষক এবং শ্রমিকদের লাগাতার অবস্থান-আন্দোলনের চাপের পাশাপাশি অতিমারী সামলাতে বিপুল ব্যর্থতা, ফেলপড়া অর্থনীতির জেরে ব্যাপক বেকারি, পেগাসাস কাণ্ডে ‘রাষ্ট্র নজরদারী করছে’ এমন তকমা লেগে যাওয়ায় বেকায়দায় মোদী-শাহ। তাই সংসদে জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা-সমালোচনা এড়াতে বহিষ্কার, মাইক বন্ধ করার মতো যাবতীয় অগণতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়েছে এই সরকার। এই পরিস্থিতিতে অপশাসনে নাজেহাল মানুষ মোদী-শাহের সমালোচনায় মুখর পথে ঘাটে।