৫৯ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১৩ আগস্ট, ২০২১ / ২৭ শ্রাবণ, ১৪২৮
দেশহিতৈষী’র ৫৯ বছরে পদার্পণ - আমাদের অঙ্গীকার
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়
আর কয়েকদিন পর ১৬ আগস্ট 'দেশহিতৈষী' ৫৯ বছরে পদার্পণ করবে। ১৯৬৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শগত সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এবং জাতীয় জীবনের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষায় এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে 'দেশহিতৈষী' প্রকাশিত হয়েছিল। শতসহস্র ঝড়-ঝঞ্ঝা, আক্রমণ, শ্রেণি সঙ্ঘাত, কঠিন-কঠোর মতাদর্শগত সংগ্রাম, রাজ্যে তিন দশককালের বেশি বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থিতি সহ রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা প্রবাহকে সাক্ষী রেখে দেশহিতৈষী ৫৮ বছর পেরিয়ে এলো। দেশহিতৈষী’র লড়াই-মগ্ন সভ্য সচেতন পাঠক সমাজের সক্রিয় সহযোগ এবং সমর্থন ব্যতীত এই সাফল্য সম্ভব ছিল না। তাঁদের জানাই কুর্নিশ এবং অভিনন্দন।
২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোভিড-১৯ মহামারীর অচিন্তনীয় ভয়াবহতা আমাদের সমাজজীবন এবং দৈনন্দিন কর্মজীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে প্রচণ্ড ব্যাহত করেছে। 'দেশহিতৈষী'ও এই প্রভাব থেকে আড়ালে থাকতে পারেনি। গণপরিবহণ বিপর্যস্ত থাকায় এই সময়কালে দু’দফায় 'দেশহিতৈষী' পত্রিকা মুদ্রিত আকারে আমরা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ওই সময়কালে 'দেশহিতৈষী'র বৈদ্যুতিন সংস্করণ আমরা প্রকাশ করতে পেরেছি এবং তার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক নতুন নতুন পাঠকের কাছেও পৌঁছতে পেরেছি। বর্তমানে মুদ্রিত এবং বৈদ্যুতিন - দু’ভাবেই 'দেশহিতৈষী' প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
১৯৬৩ সালে প্রকাশকালে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ (কাকাবাবু) তাঁর শুভেচ্ছাবার্তায় পথ নির্দেশ করে লিখেছিলেনঃ ‘‘দেশহিতৈষী যেন সত্যই মেহনতী মানুষের মুখপত্র হয় এবং ধনিক-বণিক-জমিদারি সরকারের লেজুড় না হয়, সেদিকে আপনারা সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন।’’ কাকাবাবুর নির্দেশিত পথে সংগ্রামের আঁকাবাঁকা, কাঁটা বিছানো পথ ধরেই 'দেশহিতৈষী' লক্ষ্যাভিমুখে স্থির থাকার কর্তব্য পালন করে চলেছে।
কমরেড লেনিনের শিক্ষা হলো, পার্টির মুখপত্র কেবল মতাদর্শের দিক থেকে পার্টিকে সংহত করবে তা নয়, স্থানীয় সংগঠনগুলিকে সাংগঠনিকভাবে পার্টির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করবে। পার্টির মুখপত্র যৌথ সংগঠকের কাজ করবে। লেনিনের এই শিক্ষা তখনই কার্যকর হতে পারবে যখন আমরা পর্টির সর্বস্তরে সব কর্মীদের মধ্যে পার্টির মুখপত্রকে পৌঁছে দিতে পারবো। পার্টির সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবে পত্রিকা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; দেশহিতৈষীও সাধ্যমতো সেই ভূমিকা পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। বর্তমানে শ্রমিক-কৃষক সহ সবক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ নয়া-উদারবাদী নীতি এবং হিন্দুত্ববাদী বর্বর সাম্প্রদায়িকতার বহুমুখী আক্রমণবিদ্ধ। জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্র এই দুই দোসরের আক্রমণে বিধ্বস্ত। সংবিধান পদদলিত, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংসের পথে। উদারনীতিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদ একে অপরের পরিপূরক এবং সহযোগী হয়ে কর্পোরেট লগ্নিপুঁজির শোষণ ও অবাধ মুনাফাকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। রাষ্ট্রের জনগণের অমূল্য সম্পদরাজি কতিপয় কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে বুর্জোয়া-সামন্ত শ্রেণির স্বার্থে তুলে দেওয়া হচ্ছে। দেশ বিক্রির অভিযান চলছে। অপরদিকে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র থেকে ক্রমবঞ্চিত হয়ে চলেছে।
নয়া-উদারবাদ এবং হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির এই যৌথ আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক সহ শ্রমজীবী মানুষের লড়াই প্রসারিত ও শক্তিশালী হচ্ছে। দেশের কৃষি এবং খাদ্যনিরাপত্তা ধ্বংসকারী তিনটি কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের কৃষকদের মরণপণ সংগ্রাম ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে। দিকে দিকে শ্রমিকদের সংগ্রাম তীব্র গতিলাভ করছে। ৯ আগস্ট দেশব্যাপী ভারত বাঁচাও আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর শামিল হয়ে শাসকশ্রেণি ও সাম্প্রদায়িক কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সমুদ্র-গর্জন তুলেছে। লড়াই জারি আছে। এই লড়াইয়ের বার্তা 'দেশহিতৈষী'র পাতায় পাতায় মূর্ত করে তোলার সাধ্যমতো চেষ্টাও জারি থাকছে।
আমাদের রাজ্যে একটি একনায়কতন্ত্রী দলের স্বেচ্ছাচারী শাসনে জনজীবন আরও বিপর্যস্ত, আরও সমস্যাসঙ্কুল হয়ে পড়েছে। দুর্নীতির রাজত্বে নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, আইনের শাসন উধাও হয়ে গেছে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সুযোগে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজ্যের বেহাল অবস্থাকে পুঁজি করে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই লড়াই আরও কঠোর, আরও তীব্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিবাদী বামপন্থী শক্তিকে আরও সংহত, আরও পরিশীলিত, আরও প্রসারিত এবং দুর্বার করার যে উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা চলেছে, সেই প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগের সহযোগী ভূমিকায় 'দেশহিতৈষী' সাধ্যমতো থাকবে।
শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস প্রবাহিত হয় উত্থান-পতন, জয়-পরাজয়ের পথ ধরে, সেই ধারায় গণতান্ত্রিক শক্তির, সমাজতান্ত্রিক শক্তির বিজয় অবশ্যম্ভাবী। শ্রেণিসংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গ শীর্ষে সেই জয় আসবে। বর্তমান অবস্থায় সেই দিন সুদূর মনে হতে পারে, কিন্তু কালের যাত্রায় সেদিন আসবেই। সেই যাত্রাপথের সঙ্গী থাকবে 'দেশহিতৈষী'। ৫৯ বছরে পা রেখে সেটাই আমাদের অঙ্গীকার।
১১ আগস্ট, ২০২১