৫৯ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১৩ আগস্ট, ২০২১ / ২৭ শ্রাবণ, ১৪২৮
১৫ আগস্টের শপথ
সুপ্রতীপ রায়
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। সাত দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি গৃহীত হয় স্বাধীন দেশের সংবিধান। খুব সঠিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক আদর্শ যুক্ত করা হয়েছিল। আমাদের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করা। ভাঙেনি আমাদের দেশের ভূখণ্ড।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট যখন আমরা ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন করব তখন যে প্রশ্নগুলি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর সামনে উঠে আসছে সেগুলি হলো - (১) ধর্মনিরপেক্ষ ভারত থাকবে তো? (২) দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করা যাবে তো? (৩) গণতান্ত্রিক অধিকার শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হবে তো? (৪) ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ফ্যাসিস্ত ভারতে পরিণত হবে না তো? দেশের সরকারে বিজেপি, আরএসএস’র রাজনৈতিক মুখ। সে কারণেই এই আশঙ্কাগুলি দেশপ্রেমিকদের মনে উঁকি মারছে।
আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু দেশপ্রেমিক দেশবাসী ১৯৩০ সালেই ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছ্নে, ‘১৯৩০-র ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস আসিল। বিদ্যুৎ চমকের মতো আমরা দেশের আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখিতে পাইলাম। সর্বত্র জনতা নিস্তব্ধ গাম্ভীর্যপূর্ণ, স্বাধীনতার শপথবাক্য উচ্চারণ করিতেছে, সে এক মহান দৃশ্য। সেখানে কোনও বক্তৃতা নাই, অনুরোধ উপরোধ নাই।’ আরএসএস ২৬ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা তোলেনি।
কিন্তু ইংরেজ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল ১৫ আগস্ট ১৯৪৭। লর্ড মাউন্টব্যাটন ওই দিনটি বেছেছিলেন কারণ ওই দিনটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জাপানিদের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির দিন। ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রির একটু আগে থেকেই রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশন দিয়ে। মূল বক্তা ছিলেন তিনজন - চৌধুরী খালিকুজ্জামান, ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ও জওহরলাল নেহরু।
রাজধানীর উৎসব অনুষ্ঠানে মহাত্মাগান্ধী অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মহাত্মাজি অনশনের মধ্যে দিয়ে দিনটি কাটিয়েছিলেন। স্বাধীনতা দিবসের দু’সপ্তাহ আগে তিনি দিল্লি ত্যাগ করেছিলেন। কারণ দাঙ্গায় দেশ ক্ষতবিক্ষত। এ অবস্থায় মহাত্মা গান্ধী নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেননি। দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলিতে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কলকাতা। কিন্তু ১৫ আগস্ট কলকাতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে আনন্দের অবিশ্বাস্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। হিন্দুরা যেমন বিভিন্ন এলাকা জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজিয়েছিলেন, মুসলমানরাও তেমনি তাদের বাড়ি আর দোকান ভারতীয় পতাকা দিয়ে সাজিয়েছিলেন। খোলা গাড়ি আর লরিতে চেপে দলে দলে হিন্দু মুসলিম ‘জয়হিন্দ’ স্লোগান দিতে দিতে রাস্তা পরিক্রমা করেছেন। ‘উভয় সম্প্রদায়ের লোক কাতারে কাতারে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তারা বন্ধুত্বপূর্ণ ও উৎফুল্লভাবে তৎক্ষণাৎ সেই স্লোগানে সাড়া দিচ্ছে।’ (The Statesman, 16 August, 1947)। মহাত্মাজি বেলেঘাটার রাসবাগানের প্রার্থনা সভায় কিছুটা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আন্তরিক, নিছক সাময়িক আবেগ নয়’। গান্ধীজির অনুমান সবটা মেলেনি। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি চক্রান্ত চালিয়ে যেতেই থাকে।
আরএসএস’র শিবিরেও মহাত্মাগান্ধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি আরএসএস’র সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এর শক্তিকে ভারতের পক্ষে বা বিপক্ষে দু’দিকেই কাজে লাগানো সম্ভব। সঙ্ঘের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বাঁচিয়ে তোলার যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার মধ্যে কোনো সত্যি আছে কিনা তিনি জানেন না। সুষম আচরণ করে, সেসব অভিযোগ যে ভিত্তিহীন তা দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সঙ্ঘেরই’। (To members of RSS, Harijan, 28/09/1947) যদিও দিল্লি ও গোটা দেশে যে সব দাঙ্গা হয়েছিল তার পিছনে আরএসএস’র ভূমিকা ছিল।
ভারত যদি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র না হতো তাহলে দেশ টিকত না। খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যেতো। আরএসএস ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের বিপরীতে। আমাদের দেশ বহু ধর্ম, বহু জাতি-বর্ণ সমন্বিত একটি দেশ। আমাদের সংবিধানে বলা আছে - ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সব নাগরিকই রাষ্ট্রের কাছে সমান নিরাপত্তা পাবার অধিকারী।
কিন্তু আরএসএস এর বিরুদ্ধে। সঙ্ঘের ‘সরসঙ্ঘচালক’ এম এস গোলওয়ালকর বলেছেন, ‘‘হিন্দুস্তানের অ-হিন্দু মানুষদের দু’টোর মধ্যে একটা পথ বেছে নিতে হবে। হয় তাঁরা হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাকে মেনে নেবেন, হিন্দু ধর্ম শিক্ষা করবেন, হিন্দুকে মর্যাদা দেবেন ও শ্রদ্ধা করবেন, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গরবকীর্তন ছাড়া অন্য কোনো ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেন না... এক কথায় তাঁদের বিদেশি হয়ে থাকা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় তাঁরা এদেশে থেকে যেতে পারেন, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে হিন্দু জাতির অধীন হয়ে। কোনো কিছুর ওপর কোনো দাবি থাকবে না তাঁদের, থাকবে না কোনো বিশেষ অধিকার। কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না - এমনকি নাগরিক অধিকারও না’’ (Golwalkar, ‘We or Our Nation Defined’)
১৯৪৭-র ৭ ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে আরএসএস’র সমাবেশে এম এস গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য হলো হিন্দু সমাজের সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। এই আদর্শ সামনে রেখে আরএসএস কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চলবে, কোনো ব্যক্তি, কারও কর্তৃত্বই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’’ (Hindustan Times, 08/12/1947)
স্বাধীনতার পরের দিনগুলিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর আক্রমণ চলতে থাকল। গান্ধীজি ১৩ জানুয়ারি ’৪৮ অনশনে বসেছিলেন। ১৮ জানুয়ারি এক প্রতিনিধি দল মহাত্মাজির কাছে এক যুক্ত বিবৃতি নিয়ে হাজির হলেন। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘আমরা মুসলমানদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্ম বিশ্বাস রক্ষা করব। দিল্লিতে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তা আর ঘটবে না’। (Tendulkar, Mahatma Vol-8)। মহাত্মা গান্ধী অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু বিবৃতিতে যে কথা বলা হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী শক্তি তা পালন করেনি।
২০ জানুয়ারি মদনলাল নামে এক যুবক বিড়লা ভবনে প্রার্থনা সভা চলাকালীন গান্ধীজিকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিল। যদিও মহাত্মাজি সে যাত্রায় বেঁচে যান। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি আরএসএস’র সক্রিয় সদস্য নাথুরাম গডসে মহাত্মাজিকে গুলি করে হত্যা করে। মৃত্যুদণ্ডের আগে নাথুরাম যে বক্তৃতা দিয়েছিল তাতে উল্লেখ ছিল - মহাত্মা যেভাবে একটানা, নিরবচ্ছিন্নভাবে মুসলমানদের তোয়াজ করে চলেছিলেন সেটাই তার মূল প্ররোচনা। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এই শেষ মুসলিম অনুকূল অনশনটির মধ্যদিয়ে তা তুঙ্গ স্পর্শ করে। এরফলে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে গান্ধীর অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করে দেওয়া উচিত।’ (Robort Payne, The life and Death of Mahatma Gandhi); গান্ধী হত্যাকারীর উত্তরসুরিরা এখন দেশ চালাচ্ছে। বিপদে দেশের স্বাধীনতা।
ভারত নামক দেশটি টিকে আছে কেন? কারণ আমাদের সংবিধানে বহুত্ববাদকে স্বীকার করা হয়েছে। ‘ভারত বহুত্ববাদী, যা গণতন্ত্র, আইনি শাসন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা, সামাজিক এবং (সাংস্কৃতিক) বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার পক্ষে অসামান্য জায়গা। ...আমার এতটুকু আপত্তি নেই, যদি ভারতবর্ষকে প্রতিবার নতুন করে আবিষ্কার করার জন্য দশবার আমাকে জন্ম নিতে হয়।’ (রবার্ট ব্ল্যাকউইল, আমেরিকার বিদায়ী রাষ্ট্রদূত, ২০০৩)। ধর্মীয় বহুত্ববাদ, ভাষার বহুত্ব ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হয়েছে। যা ভারতের ঐক্যকে আরও সুসংহত করে তুলেছে। ভারতের বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু, কিন্তু ভারত ‘হিন্দু’ রাষ্ট্র নয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করা হয়নি।
ভারত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এক অনন্য নিদর্শন। এই বৈচিত্র্যের স্বীকৃতিই আধুনিক জাতির বন্ধনকে মজবুত করেছে। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যেও এই বৈচিত্র্যের কথা বলা আছে। ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এম সি চাগলার সুপারিশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়। এই সঙ্গীত সমস্ত প্রদেশ, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলন কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ পথের দিক নির্দেশ করেছে।
বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিবেচনা করে জাতীয় নেতারা সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতকে এক রাখতে গেলে এই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিতেই হবে। ফলে, ‘‘জাতীয় নেতৃত্ব এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুললেন যা জাতীয় সংহতির অনুকূল। এই কাঠামোর একেবারে অন্তঃস্থলে ছিল গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার-ভিত্তিক এক রাষ্ট্র সমাজের উদ্বোধন। সদ্য মুক্ত ও বিকাশমান দেশগুলোর ক্ষেত্রে গণতন্ত্র আর জাতীয় সংহতি বেমানান, এবং ভারতের মতো এত বৈচিত্র্যযুক্ত একটি দেশকে ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন এক স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো - এই যুক্তি বর্জন করা হলো। বরং এই কথা বলা হলো যে, ভারত এত বৈচিত্র্য যুক্ত দেশ বলেই একে ধরে রাখতে হলে বল প্রয়োগ কিংবা স্বৈরতন্ত্রের বদলে চাই গণতন্ত্র। নেহরু বারবার দেশবাসীকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন যে, ভারতে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিপর্যয় ঘটলে তা অবধারিতভাবেই বিশৃঙ্খলা ও হিংসা ডেকে আনবে’। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারতকে ঐক্যসূত্রে বেঁধে রাখবার একমাত্র পথ হলো গণতান্ত্রিক কাঠামো, যে কাঠামোয় বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কণ্ঠ নিজেদের ব্যক্ত করবার পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুযোগ পাবে’’ (ভারতবর্ষঃ স্বাধীনতার পরে (১৯৪৭-২০০০) - বিপানচন্দ্র, মৃদুলা মুখার্জি, আদিত্য মুখার্জি, পৃঃ ১০২-১০৩)।
ভারত একটি বহুত্ববাদী সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নিহিত রয়েছে তার বহুত্ববাদে। আরএসএস এই বহুত্ববাদ মানে না। তাই ওদের স্লোগান ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান’। এই স্লোগানই বলে দেয় আরএসএস কি চায়? ওরা চায় একটি ধর্মকে সকলের উপর চাপিয়ে দিতে। ওদের দর্শনে গণতন্ত্রের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। ফলে বিজেপি সরকারে থাকলে দেশ কি ঐক্যবদ্ধ থাকবে? ১৫ আগস্টে এই ভাবনা উঁকি মারছে।
সঙ্ঘ পরিবার ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে বিকৃত ধারণা হাজির করে। যা দেশকে এক রাখার পক্ষে বিপজ্জনক। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ অভিন্ন ভাষা, ধর্ম বা জনজাতি পরিচয়ের উপর গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই প্রথম এই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে উঠেছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার সর্বোচ্চরূপ গ্রহণ করেছিল ইংরেজকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করবার দাবির মধ্য দিয়ে। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের যে সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-বর্ণের সম্পর্ক ছিল না।
আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিল এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়, সে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। গোলওয়ালকরের নেতৃত্বে আরএসএস এবং সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা ৪২’র ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিল। আন্দোলন চলাকালীন ভারতীয় জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীরা যখন পদত্যাগ করেছেন তখন সাভারকর মহাসভায় সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন - তারা যেন আইনসভায়, স্বায়ত্ব শাসিত সংস্থাগুলিতে ও সেনাবাহিনীতে নিজের নিজের পদ আঁকড়ে থাকেন ও সরকারি কর্তব্য করে চলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও এই নির্দেশ পালন করেছিলেন।
স্বাধীনতার সময় থেকেই হিন্দু মহাসভা, আরএসএস হিন্দু পরিচিতিকে ঘিরে এক বিকল্প গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সঙ্ঘ পরিবারের মতাদর্শ কি? ওদের মতাদর্শ সম্পর্কে ধারণা মেলে ডি আর গয়ালের - ‘Rashtriya Swayam Sevak Sang’ (পৃঃ ১৭-১৮) বই থেকে গয়াল সঙ্ঘ পরিবার কথিত ‘হিন্দুত্বের’ যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নরূপ -
‘‘হিন্দুরা স্মরণাতীত কাল থেকে ভারতে বাস করে আসছে। হিন্দুরাই হলো নেশন, কেননা যাবতীয় সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং জীবনধারা একমাত্র তাদেরই অবদান। অ-হিন্দুরা হয় হানাদার না হয় অতিথি। চিরাচরিত হিন্দু রীতিনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি গ্রহণ না করলে তাদের কখনও সমান বলে গণ্য করা যেতে পারে না। যা কিছু হিন্দু তার প্রতি শত্রুতা করে এসেছে অ-হিন্দুরা, বিশেষত মুসলিম আর খ্রিস্টানরা, সুতরাং তাদের বিপজ্জনক বলে গণ্য করতে হবে। এই দেশের স্বাধীনতা আর প্রগতি বলতে বোঝায় হিন্দুদের স্বাধীনতা ও প্রগতি। ভারতের ইতিহাস হলো ওইসব বহির্শক্তির হাত থেকে হিন্দুদের ধর্ম আর সংস্কৃতিকে রক্ষার ও সংরক্ষণের জন্য হিন্দুদের সংগ্রামের ইতিহাস। বিপদ এখনও কাটেনি এজন্য যে, ক্ষমতা যাদের হাতে রয়েছে তারা মনে করে না যে, এই নেশন একটি হিন্দু নেশন। যারা বলে যে জাতীয় ঐক্য হলো এই দেশে বসবাসকারী সকল লোকের ঐক্য তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সে কথা বলে, তাদের উদ্দেশ্য হলো সংখ্যালঘু ভোট আদায় করা; সুতরাং এরা বিশ্বাসঘাতক। আজকে যা একান্ত প্রয়োজন তা হলো হিন্দুদের ঐক্য ও সংহতি, কেননা হিন্দুরা চারপাশে শত্রু-পরিবৃত হয়ে রয়েছে। ব্যাপক প্রত্যাঘাত হানবার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে হিন্দুদের, আক্রমণই প্রতিরক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা। ঐক্যের অভাবই হিন্দুদের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ, তাই সঙ্ঘ পরিবারের জন্ম হয়েছে সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবার বিধি নির্দিষ্ট ব্রত নিয়ে।’’
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদী আরএসএস’র প্রতিনিধি হিসাবে যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা যে কোনো দেশপ্রেমিক মানুষকেই উদ্বেগের মধ্যে রাখে। এসময়ে আক্রান্ত গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষতা। সংসদকে গুরুত্বহীন করা হচ্ছে। একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন আরএসএস সব নাগরিকের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে। গোলওয়ালকরের ‘We or Our Nationhood Defined’ বইয়ে নাগরিকত্ব সম্পর্কে সঙ্ঘ পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি মেলে। ওখানে বলা আছে সব নাগরিক ভোটাধিকার পাবে না। আরএসএস ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বাতিল করে ‘মনুর সংবিধান’ প্রবর্তন করতে চায়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে ফ্যাসিস্ত হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। স্বাধীন ভারতের সামনে এর থেকে বড়ো বিপদ আর কি হতে পারে?
দেশপ্রেমিক ভারতবাসী, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সামনে বড়ো বিপদ আরএসএস। এই বিপদের ইঙ্গিত মিলেছিল ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে নেহেরুর বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেনঃ ‘আমাদের কাছে একথা বলবার সপক্ষে প্রচুর সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যে, আরএসএস সংগঠনের চরিত্রটি হলো গোপন সেনা দলের মতো, যা সুনিশ্চিতভাবেই কট্টর নাৎসি লাইন নিয়ে এগোচ্ছে, এমনকি নাৎসিদের সাংগঠনিক কৌশলগুলি পর্যন্ত তারা অনুসরণ করে চলেছে।’ দেশের সরকারে বিজেপি। স্বভাবতই আরএসএস তার লক্ষ্যকে সফল করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
১৯০ বছরের লড়াইয়ের শেষে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার লড়াইয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ১৫ আগস্ট আমরা এই বীর শহিদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহিদদের কি চোখে দেখে? এ প্রসঙ্গে “Bunch of Thoughts”-এ লেখা হয়েছেঃ ‘‘এই সমস্ত ব্যক্তিদের আমাদের সমাজে আদর্শ হিসাবে হাজির করা উচিত নয়। আমরা তাদের জীবন বলিদানকে মানুষ কামনা করতে পারে এরকম কোনো সর্বোত্তম মহত্ত্ব হিসেবে দেখি না। কারণ, শেষ পর্যন্ত তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে এবং এই ব্যর্থতাই দেখিয়ে দেয় তাদের মধ্যে একটা বড়ো রকমের ভুল রয়েছে।’’
১৫ আগস্ট শপথ নেওয়ার দিন। শপথ নিতে হবে - স্বাধীনতা আন্দোলনের সুমহান ঐতিহ্য, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভারতকে রক্ষা করবই। আর এটি সম্ভব আরএসএস এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে সেই লড়াইয়ে ব্যাপক মানুষকে যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্যকে আরও প্রসারিত করতে হবে।