৫৯ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১৩ আগস্ট, ২০২১ / ২৭ শ্রাবণ, ১৪২৮
এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস
শংকর মুখার্জি
স্বাধীন ভারতের ছবিটা কিরকম হবে তার একটা রূপরেখা তৈরি হয় কংগ্রেসের করাচী অধিবেশনে। ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত এটি ছিল কংগ্রেসের পঁয়তাল্লিশতম অধিবেশন। এসম্পর্কিত যে প্রস্তাবটি অধিবেশনে গৃহীত হয় তার শিরোনাম ছিলঃ ‘রেজোলিউশন ওন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ইকোনমিক পলিসি’ অর্থাৎ মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক নীতি প্রসঙ্গে প্রস্তাব। এর ঠিক আগে, ১৯২৯ সালে লাহোরে চুয়াল্লিশতম অধিবেশনে কংগ্রেস সম্পূর্ণ স্বাধীনতা - ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর প্রস্তাব নেয়। ’৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি সারা দেশে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। সব মিলিয়ে এসময় একটা মুক্ত ভারতের স্বপ্ন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মানসপটে হাজির হয়েছিল। যদিও এর প্রায় আট বছর আগে ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কয়েকজন কমিউনিস্ট পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব আনে, কিন্তু গান্ধীজির বিরোধিতায় তা সাকার লাভ করেনি। ওই শতকের গোড়ায় বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীরা ১৯০২ সালে অনুশীলন সমিতি গড়ে তোলে। একদম শুরুর দিকেই এই সমিতিও এক ইশ্তেহারে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানায়। আর মহান অক্টোবর বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে ওঠা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভগৎ সিংদের হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন মনে করত, একমাত্র সমাজতন্ত্রেই জনগণ প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পারে। তাই তারা সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার মধ্যে লড়াইকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। যদিও সেইসময়ে এরা ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বিপ্লবের স্তর নির্ণয়ের মতো তাত্ত্বিক বিষয় নির্ধারণে একেবারেই পারদর্শী হয়ে উঠতে পারেনি। তবুও পাঞ্জাবের গদর বীরেরা এবং দেশের বিভিন্ন অংশের সশস্ত্র বিপ্লববাদীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের এই কমিউনিস্ট ধারার প্রতি আকর্ষিত হন এবং এতে যোগদান করেন। ত্রিশের দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চড়াই-উৎরাই দুর্বলতা-সফলতা প্রভৃতি বিষয় বিচারে রেখেও বলা যায় করাচী প্রস্তাব একটা উৎসাহ তৈরি করেছিল।
১৯৪৬-৫০ সময়পর্বে দেশের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় সংবিধান পরিষদের সদস্যরা ২৬ জানুয়ারির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ১৯৫০ সালের ওইদিন থেকেই সংবিধান কার্যকর হবে। ঠিক একইভাবে করাচী প্রস্তাবে যে আর্থ-সামাজিক সংস্থানের বিধান ছিল সংবিধান প্রণেতারা সংবিধান রচনায় সেগুলি মর্যাদার সাথে স্থান দিয়েছেন। সংবিধানের চতুর্থ অংশে নির্দেশাত্মক নীতিসমূহে এই বিষয়গুলি বিবৃত হয়েছে। আর আজ যখন আমরা স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদযাপন করছি, তখন খুবই পরিতাপের সাথে এটা উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, বর্তমানে এদেশে মানবাধিকারের ওই বিষয়গুলি যা সংবিধানে স্থান পেয়েছিল তা আর মর্যাদার সাথে বিবেচিত হচ্ছে না। আর্থিক নীতিবলি, যা শুধু করাচী প্রস্তাবেই বিবৃত হয়নি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনটি প্রধান ধারাই এগুলির রূপায়ণের ব্যাপারে প্রতিশ্রুত ছিল তাও সেকেলের ভাবনা হিসেবে বর্তমানে চিহ্নিত হয়েছে।
করাচী প্রস্তাব কি বিধান দিয়েছিল সেইদিকে আলোকপাত করা খুবই জরুরি। সমিতি গড়ার, সমবেত হওয়ার, বাকস্বাধীনতা, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকলের নির্বাচিত হওয়ার, ব্যক্তির নিজের পছন্দ অনুযায়ী ধর্মাচরণ, মুক্ত সংবাদমাধ্যমের মতো মৌলিক অধিকার দেওয়া ছিল করাচী প্রস্তাবে। আর বলা ছিল, চাকরি সহ সরকারি ব্যবস্থায় ধর্ম-জাত-বর্ণ ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য থাকবে না, থাকবে সকলের সমান অধিকার। আর রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ব্যাপারে গান্ধীবাদী এবং কমিউনিস্টরা একেবারেই আপসহীন ছিলেন। সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে ধর্মের প্রতি ঝোঁক থাকলেও পরে তাঁরা তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলেন। তবে তাঁরা কেউ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। আর গদর বিপ্লবীরা তো রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্যুত করেন; এবং তাঁরাই প্রথম হিন্দু- মুসলিম-শিখ ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব দেন।
প্রস্তাবে বিবৃত অর্থনৈতিক নীতিবলি এবং শ্রমনীতিও ছিল খুবই প্রগতিশীল এবং অগ্রগামী চিন্তার পরিচায়ক। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে প্রধান ভাবনাগুলি, ছিলঃ দেশের সমস্ত বুনিয়াদি শিল্প এবং প্রাকৃতিক সম্পদ থাকবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে; উচ্চ কৃষি আয়ে প্রগতিশীল কর আরোপ, ভূমি রাজস্ব হ্রাস প্রভৃতি। শ্রমনীতিবলিতে বলা হয়ঃ শ্রমিকদের জীবনধারণের উপযোগী মজুরি, সম্মানজনক শ্রমশর্ত, ইউনিয়ন গড়ার এবং যৌথ দরকষাকষির অধিকার, শ্রমবিবাদ মীমাংসায় প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি, বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা, মহিলা শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং প্রসূতিকালীন সবেতন ছুটি, ভূমিদাস প্রথা থেকে গ্রামীণ শ্রমিকদের মুক্ত করা এবং বার্ধক্যে-অসুস্থতায়-বেকারত্বে শ্রমিকদের নিরাপত্তাপ্রদান।
শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই করাচী প্রস্তাবের বিষয়বস্তু গড়ে ওঠেনি; উনবিংশ ও বিংশ শতকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজ সংস্কারমূলক এবং জ্যোতিরাও ফুলে, পেরিয়ার ই ভি রামাস্বামী, বি আর আম্বেদকরের মতো নেতাদের নেতৃত্বে সামাজিক মুক্তির যে আন্দোলনগুলি গড়ে উঠেছিল তার প্রভাবও ছিল এই প্রস্তাবে। অন্যদিকে আরএসএস’র ন্যায় হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা সামাজিক আন্দোলন কোনো কিছুর সাথেই তাদের কোনো সংস্রব ছিল না। শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন ভি ডি সাভারকার, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও পরে নিজেকে সরিয়ে নেন। আরএসএস প্রধান এম এস গোলওয়ালকরের তো আবার উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের ওপর এতো কম আস্থা ছিল যে, তিনি ভাবতেন স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষ শাসন করার জন্য ব্রিটিশদের ডেকে আনতে হবে। গান্ধীজিকে হত্যা করার পর ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদীদের অস্তিত্ব বিপন্ন না হলেও ভারতের জনজীবন থেকে তারা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই স্বাধীনতার আগেও যেমন তাদের স্বাধীন ভারত নিয়ে কোনো স্বপ্ন ছিল না একইভাবে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায়ও তারা কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি।। একটাই তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, স্বাধীনতার পর ভারত যেন হিন্দুরাষ্ট্র হয় এবং যেখানে সামাজিক ক্ষেত্রে মনুর বিধান স্বীকৃতি পাবে।
সংবিধান রচনায় করাচী প্রস্তাবের বিষয়গুলি গুরুত্ব পেয়েছিল। শ্রমিকশ্রেণি, কৃষকসমাজ, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুব, মহিলাদের গণঅংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতীয় আন্দোলন সফল হয়। তাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল জমি, খাদ্য, ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা,আবাসন, চিকিৎসার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান। স্বাধীনতার অর্থ ছিল জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার মতো সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্তি, গণতান্ত্রিক এক কাঠামোয় মানুষের আকাঙ্ক্ষাপূরণ।
কিন্তু স্বাধীন ভারতে যেটা প্রয়োজন ছিল তা হলো, উৎপাদনশক্তির সমস্ত শৃঙ্খলকে চূর্ণ করা; বিদেশি পুঁজির আধিপত্য থেকে শিল্পকে মুক্ত করা এবং পরজীবী জমিদারতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে কৃষিমজুর ও গরিব কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন। নতুন রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা বুর্জোয়ারা যার নেতৃত্বে ছিল কংগ্রেস দল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই মৌল কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করতে অস্বীকার করে। তারা পুঁজিবাদী বিকাশের বিশেষ ধরনের পথ নেয়। সাম্রাজ্যবাদের সাথে দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের সাথে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আতাঁতের পথে যায়, দেশে সামন্ততন্ত্রের অবশেষকে ধ্বংস না করে ভূস্বামীদের সাথে মৈত্রী করে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক থাকলেও কংগ্রেস দল ক্ষুদ্র নির্বচনী স্বার্থে বারবার নরম সাম্প্রদায়িকতার নীতি গ্রহণ করেছে, সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপস করেছে; জরুরি অবস্থা জারির মতো ঘটনাও সংগঠিত করেছে।
রাষ্ট্রের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় সরকারি নীতির সীমাবদ্ধতা ছিল। তাসত্ত্বেও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উৎপাদন কাঠামোয় বৈচিত্র্য এসেছিল; ভারী শিল্প গড়ে তোলা, ব্যাঙ্ক-বিমা-কয়লা-তেল শিল্পের জাতীয়করণ, ক্ষুদ্র শিল্পে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা, বিদেশি পণ্য ও পুঁজির প্রবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ দেশে পুঁজিবাদী বিকাশেএকটা নির্দিষ্ট অভিমুখ দিয়েছিল। এটা অনস্বীকার্য যে, এরফলে অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা হলেও কমেছিল। কাজের সংস্থানেরও কিছুটা ব্যবস্থা হয়েছিল। একটা প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল। যদিও সেটা সম্পূর্ণতা পায়নি সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা না হওয়ায়। মোটের ওপর একটা প্রগতিশীল শ্রমআইনের কাঠামো তৈরি হয়েছিল, তার দেখভালের জন্য একটা ব্যবস্থাও ছিল। বিজ্ঞানমনষ্কতা গড়ে তোলায় সরকারের খুব একটা ভূমিকা না থাকলেও বিরোধিতা ছিল না। ভূমিসংস্কার না হলেও খাদ্যের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথেই এগোচ্ছিল ভারত।
কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটায় আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় গতশতকের নব্বইয়ের দশকে দেশে নয়া উদারনীতির যুগ শুরু হবার পর থেকে। কংগ্রেস এই প্রক্রিয়া শুরু করলেও দুই পর্যায়ের বিজেপি জমানায় তা আরও আগ্রাসী হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদন ক্ষেত্র সহ আর্থিক ক্ষেত্রেরও সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণের পথে হাঁটছে বর্তমান বিজেপি সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদন ক্ষেত্র, প্রাকৃতিক সম্পদ দেশি-বিদেশি পুঁজির কাছে লুঠের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শ্রমকোড চালুর মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অবাধ শোষণের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। করপোরেট-রাজনীতিক-প্রশাসনের অপবিত্র আতাঁতে দেশজুড়ে লুঠ, ব্যবসায়ী-করপোরেটদের ক্রমাগত করছাড় ও ঋণমকুবে মুনাফা আর সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠেছে। বর্তমানে ভারতীয় সমাজে যে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তা ইতিপূর্বে কোনোদিন দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পর আয় সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধিতে জওহরলাল নেহরু উদ্বিগ্ন ছিলেন। এব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্য মহলানবীশ কমিটিও গড়েছিলেন। সেসব ব্যবস্থা বহুদিন আগেই অবলুপ্ত হয়েছে। এখন দেশে বিলিওনেয়ারের সংখ্যাবৃদ্ধিকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হলেও শিক্ষায় বেসরকারিকরণের গতি খুবই দ্রুত। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ভরতুকি হ্রাস এবং অবাধ আমদানি নীতির ফলে গত তিন দশকে সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিণতি দেখা দিয়েছে কৃষিতে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে কৃষি আইন, যা দেশের কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে করপোরেটের কুক্ষিগত করে ফেলবে।
বিজেপি জমানায় এই আগ্রাসী আক্রমণ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীামাবদ্ধ নেই তা রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছে। বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পরই আরএসএস তাদের গোপন অ্যাজন্ডাগুলির রূপায়ণ শুরু করেছে যা সরাসরি দেশের সংবিধান, সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে আঘাত করছে। সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসীদের সমস্ত অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে; নাগরিক হিসেবে তাঁদের মর্যাদাও আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। রাষ্ট্রের উদ্যোগে বিজ্ঞানবিরোধী চিন্তা, কুসংস্কারে মদত দেওয়া হচ্ছে। সরকার বিরোধিতাকে সমতুল হিসেবে বিচার করা হচ্ছে। এই অপরাধে সব অংশের মানুষকে জেলে পোরা হচ্ছে। একটা আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে। সংসদ, বিচারব্যবস্থা সহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকার মর্যাদাকে খর্ব করা হচ্ছে। সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ কবজা করার চেষ্ঠা করছে হিন্দুত্ববাদীরা।
দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়নি এটা ঠিকই, কিন্তু এক ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ত শক্তি শাসনক্ষমতায় আসীন। তারা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বৈদেশিক নীতি সমস্ত কিছুকে চরম দক্ষিণপন্থার দিকে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। গত এক দেড় বছর বাদ দিলে দেশে অর্থনীতির উচ্চহার বজায় ছিল।পুঁজিপতিদের মুনাফা ও সম্পদ বৃদ্ধির হারেও ভাটা পড়েনি। তাসত্ত্বেও পুঁজিবাদ সঙ্কট থেকে মুক্ত তো হতেই পারেনি, আরও সঙ্কট গভীর হয়েছে। আয় ও সম্পদের বৈষম্যের ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ কমছে যা সঙ্কট থেকে মুক্তির পথকে আরও শক্ত করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদও আগ্রাসী দক্ষিণপন্থার মধ্যে নিজের সুরক্ষা খুঁজছে। ইতিহাসেও এ নজির অসংখ্য পাওয়া যায়। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ফ্যাসিবাদের বিপদ। এই অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণির পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন দুর্বল হলে এই বিপদ আরও বাড়ে। ভারতে এঅবস্থা বিরাজ করছে।
তাই স্বাধীনতার ৭৫তম দিবসে দেশের কমিউনিস্টদের কাছে,দেশের বামপন্থীদের কাছে এক গুরুদায়িত্ব হাজির হয়েছে। এই আগ্রাসী দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে সর্বঅংশের মেহনতি মানুষ ও গণতান্ত্রিক মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এই ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদারনীতি ও সাম্প্রদায়িক নীতি এবং জাতপাতগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগপত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। পশাপাশি সর্বজনীন শিক্ষা, সর্বজনীন স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দেশের সম্পদ রক্ষা, বৃদ্ধবয়সে পেনশন চালু,সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থা, আবাসন, শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রম আইন চালু, জমির অধিকারের মতো বিষয়গুলিকে বিকল্প নীতি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। আর এই প্রেক্ষাপটেই নিয়ে আনতে হবে ১৯৩১ সালের করাচী প্রস্তাবের আলোচ্যসূচিকে। এটা একইসাথে বিকল্প নীতির ভিত্তিতে জনগণের ঐক্য গড়ে তুলতে সহায়ক হবে এবং অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লব রূপায়ণের পথেও বামপন্থীদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।