E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১৩ আগস্ট, ২০২১ / ২৭ শ্রাবণ, ১৪২৮

‘নতুন ভারত’ নির্মাণ যজ্ঞে দিশাহারা মানুষ

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


দেশজুড়ে নাকি চলছে ‘নতুন ভারত নির্মাণ’ যজ্ঞ। সেই যজ্ঞের ধোঁয়ায় চারদিকে এত অন্ধকার হয়ে গেছে যে মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নতুন ভারত নির্মাণের ঠেলায় দিন আনা দিন খাওয়া গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন এনিয়ে সন্দেহ নেই। মানুষের মনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে, সেই সন্দেহ প্রকাশ করলে সেটাকে সরকার মানতে পারছেন না। কখনো কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করছে, অথচ সন্দেহ নিরসনের দায়িত্ব সরকারের। অজস্র বিষয়ের মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করছি যেগুলির ক্ষেত্রে মানুষের মনে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন দানা বেঁধেছে -

(১) সরকার কি কতিপয় শিল্পপতির স্বার্থের প্রতি বেশি যত্নবান, যারা সরকারের সব কাজকে কোনো না কোনো কৌশলে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়?
(২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিকভাবে শক্তিশালী কিন্তু অবিশ্বাসজনক ঐতিহ্যের দেশের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেই দেশের দোসর হয়ে ওঠার চেষ্টাতে দেশের কি লাভ আছে কিছু?
(৩) অতিমারী পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ বিশেষত গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন - সরকার কী করছে?
(৪) সরকার লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেঁচে দিতে বা বেসরকারি হাতে তুলে দিতে এত আগ্রহী কেন?
(৫) বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পণ্য সামগ্রীর দাম লাগামছাড়া কেন?
(৬) দেশের শিক্ষা কি সরকারের হাতে থাকবে, না বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে?
(৭) দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি সরকারের হাতে থাকবে, না বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে?
(৮) সরকারের তৈরি রেল, ব্যাঙ্কগুলো কি সরকারের হাতেই থাকবে?
(৯) দেশের প্রতিরক্ষার মতো ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকির হয়ে উঠল না তো?
(১০) জীবনবিমা ব্যবস্থা কি সরকারের হাতেই থাকবে?
(১১) শিশু শ্রমিকদের, পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি সরকার নেবে?
(১২) মহিলাদের কথা কি শুধু নারী দিবসেই মনে পড়বে?
(১৩) শিক্ষকদের মর্যাদার কথা কি শুধু শিক্ষক দিবসেই আটকে থাকবে?
(১৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে জ্যোর্তিবিদ্যা থাকবে, পাশাপাশি অবৈজ্ঞানিক জ্যোতিষবিদ্যাও আসবে?
(১৫) দেশবাসীর টিকার ব্যবস্থা কে করবে - সরকার? ভোটের আগে ঘোষণা ছিল সরকার সবার টিকার ব্যবস্থা করবে, তাহলে ভোটের পরে টিকা কেন্দ্রে সরকারকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে কেন?
(১৪) ১০০ দিনের কাজের সুযোগ বাড়বে?

এছাড়াও নতুন ভারত নির্মাণ যজ্ঞে গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের হাল দেখলে আর যাই হোক সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুণগান করা যায় না। গুণগান না করলে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা, গুণগান করলে ‘শ্রী/ ভূষণ’ জুটে যাবার প্রবল সম্ভাবনা। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করলে তা শাসককে খুশি করার মতো প্রশ্ন করতে হবে। শাসক বিব্রত বোধ করে এমন প্রশ্ন করা যাবে না। শাসকের মুখোশ মেনে নিলে সাংবাদিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়া যাবে, নচেৎ না। সাংবাদিক চাকরি বাঁচাবে, না গণতন্ত্রের স্তম্ভ হয়ে উঠবে? সাক্ষাৎকার মানে শাসকের একপেশে বাণী শুনে যেতে হবে? সংবাদমাধ্যমের মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোন্‌ ছবি ছাপাতে হবে বা দেখাতে হবে, কোন্‌ খবর চেপে যেতে হবে। সাংবাদিক জানে মালিক কী খবর চান, কী ছবি চান। এ এক প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক অনাচার চলেছে। কোর্টের পরামর্শ, আদেশ-নির্দেশ সব জলের তলায়। শাসকের যা ইচ্ছে হবে, সে তাই করবে। প্রয়োজনে জেলে ভরে দেবে নানান দেশবিরোধী আইনের জালে ফাঁসিয়ে। এখন তো দূর-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় কম্পিউটারেও ভুলভাল কথা ঢুকিয়ে দিয়ে দেশদ্রোহী সাজিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশ্য দুনিয়ায় খুব নামডাক হয়েছে পেগাসাস সফটওয়্যারের, যদিও গোপন দুনিয়ায় তা বহুল ব্যবহৃত অনেক বছর ধরেই। কোনো ঘটনায় গণতন্ত্র হরণের, গণতান্ত্রিক সৌজন্য লঙ্ঘনের অভিযোগ করে মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশের প্রতিক্রিয়া ও অতি সক্রিয়তা দেখা যায়। সেই একই মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়াহীন ও অতিনিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা যায় গণতন্ত্রহরণের, গণতান্ত্রিক সৌজন্য লঙ্ঘনের অন্য কোনো ঘটনায়। এরা হলেন বিবেকহীন, আদর্শহীন গোষ্ঠী এনিয়ে সন্দেহ নেই। তাই নিরপেক্ষ বলে দাবি করা সংবাদমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জীবন যন্ত্রণার কথাগুলি। থাকছে দল বদলের গল্প - থাকছে না দিন বদলের গল্প। কৃষক আন্দোলনের খবর দেখানো হয় না, থাকছে না বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র, কৃষি আইনের ভয়ঙ্কর দিকগুলো, থাকছে না নতুন শ্রম কোড-এর অমানবিক দিকের আলোচনা, থাকছে না ছাঁটাইয়ের নিদারুণ কাহিনি, থাকছে না মূল্যবৃদ্ধির গল্প। থাকছে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় কথার চাষ।

আদর্শ, দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের ভিত যাদের নেই, তাদের দলে ভাঙন চলতেই থাকবে। যে ঘর ভাঙছে, আর ব্যক্তিস্বার্থের লাভ-ক্ষতির বোঝাপড়া থেকে যে ঘরে গিয়ে তারা উঠছে - কেউই গরিব দেশবাসীর স্বার্থের অনুকূলে কিছু ভাবে না। নিজের পরিবারের সুনাম রক্ষার দায়িত্ব সব সদস্যের। পরিবারের সবাই সবাইকে খেয়াল রাখলেই পরিবারে বন্ধন দৃঢ় হয়, পরিবারটা ভালো চলে, পরিবারের উন্নতি হয়। এই যুক্তি দেশের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। দেশের সুনাম রক্ষার দায়িত্ব সব সদস্যের, সব মতের রাজনৈতিক দলের। সরকার কী শুনলে খুশি হবে শুধু সেটা বলা নাগরিকের দায়িত্ব নয়, সরকারের মন জুগিয়ে কথা বলার সেই দায়িত্ব কোনো রাজনৈতিক দলেরও নয়। সরকারের সব কাজের প্রশংসা করা শাসকের কাজ, আর স্তাবকের কাজ। সরকার ভালো চললে আমরা ভালো থাকব, তাই সরকারকে দল-মত নির্বিশেষে সঠিক দিশা দেখানো দেশপ্রেমের পরিচয়, দেশদ্রোহীর নয়। তাই ‘নতুন দেশ নির্মাণ’ এর গল্পে মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকা দেশের কল্যাণের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রমাণের মানদণ্ড নিশ্চয়ই শাসকের নির্ভেজাল তাঁবেদারি করে যাওয়া নয়। ব্যক্তি জীবনে ভালোবাসা মানে তো ভালোবাসার মানুষটিকে আগলে রাখা, প্রিয় মানুষের বিপদের দিনে পাশে থাকাও। ভালোবাসা মানে তো ভালোবাসার মানুষটির সব কাজের অনুমোদন নয়। তাহলে দেশকে ভালোবাসার মানে আলাদা হতে যাবে কেন!