E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯

২৬ জানুয়ারি সংযুক্ত কিষান মোর্চার ট্রাক্টর মিছিলের আহ্বান

বিপ্লব মজুমদার


ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রামের তৃতীয় দিন, ২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর দিল্লির সীমান্তে কৃষক জমায়েত।

গত ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ হরিয়ানার কারনালে সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)’র জাতীয় স্তরের কমিটি সভায় ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি দেশের সব জেলার সদরে ট্রাক্টর মিছিলের আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, আগামী ২৬ জানুয়ারি জেলা কেন্দ্রে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে জাতীয় পতাকা তোলা হবে, তারপর শুরু হবে ট্রাক্টর মিছিল। লক্ষ রাখতে হবে, কৃষকদের কর্মসূচির কারণে প্রজাতন্ত্র দিবসের সরকারি কর্মসূচি যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। প্রজাতন্ত্র দিবসে ট্রাক্টর মিছিলের তাৎপর্য সুগভীর। জাতীয় দিবসে সমাজের নানা অংশ তাদের নিজস্ব নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে মর্যাদার সাথে স্মরণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি দেশের সংবিধান গ্রহণ করা হয়। এই দিনটি তাই দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার তথা গণতান্ত্রিক অধিকারের আইনি স্বীকৃতির দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা সঠিকভাবেই এই বিশেষ দিনটিকে সমাজে কৃষকের বিশেষ অধিকার ও অবস্থানের কথা সোচ্চারে ঘোষণার জন্য বেছে নিয়েছে। একই দিন হরিয়ানার ঝিন্দে কৃষকদের এক মহাপঞ্চায়েতের আহ্বান জানানো হয়েছে। এই মহাপঞ্চায়েতে হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড থেকে ৩,৯০০ জন কৃষক প্রতিনিধি অংশ নেবেন এবং কৃষক আন্দোলনের পরবর্তী রূপরেখা নিয়ে মতবিনিময় করবেন। ২৬ জানুয়ারি ট্রাক্টর মিছিল যাতে সারা দেশের নজর কাড়ে সেই মতো আগাম প্রস্তুতির অনুরোধ করতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০টি রাজ্যে এসকেএম’র রাজ্য শাখা গঠিত হয়ে গেছে, বাকিগুলিতে শীঘ্র রাজ্য শাখা গঠন হয়ে যাবে। এই রাজ্য শাখাগুলি ২৬ জানুয়ারির কর্মসূচির প্রস্তুতির সাথে সাথে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের প্রধান প্রধান দাবিগুলি বাছাই করবে। এইভাবে রাজ্যের কৃষকদের স্থানীয় সমস্যার সাথে কেন্দ্রীয় সমস্যার আলোচনা ও তার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেবার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

সংযুক্ত কৃষক মোর্চার অপূর্ণ কেন্দ্রীয় দাবি ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে স্থানীয় দাবি পেশ করতে বলা হয়েছে এবং সকল দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সংগ্রাম চলাকালীন কেন্দ্রীয় দাবি হিসাবে যা নির্দ্দিষ্ট হয়েছে তা হলোঃ
(১) ফসলের সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্যে আইনি নিশ্চয়তা প্রদান,
(২) পরোপুরি ঋণ মুক্তি,
(৩) মাসে ১০,০০০ টাকা করে কৃষি পেনশন,
(৪) কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার,
(৫) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের (টেনি) মন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ ও তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ,
(৬) বিগত আন্দোলনে যে সকল কৃষককে জেলে আটক করা হয়েছিল তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি সহ দিল্লি আন্দোলনের সব কৃষকের উপর থেকে মামলা প্রত্যাহার,
(৭) দিল্লি আন্দোলনে প্রয়াত ৭১৫ জন শহিদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান।

সবাই জানেন যে, ২০২০ সালে কোভিড-১৯ আতিমারীর ভয়াবহ প্রকোপের মাঝেই কেন্দ্রীয় সরকার তিন কালা কানুন জারি করে। এর মধ্যদিয়ে তারা কৃষকদের করপোরেট পুঁজির সেবাদাসে পরিণত করতে চেয়েছিল। অর্ডিন্যান্স জারি করে লোকসভা ও রাজ্যসভায় আলোচনার প্রচলিত সুযোগ ও বিধি ব্যবস্থাকে তছনছ করে অতিদ্রুত বিল পাস ও অতিদ্রুত রাষ্ট্রপতির সম্মতি সহ আইন পাশের অস্বাভাবিক ঘটনাক্রম যে করপোরেট পুঁজির স্বার্থেই সংঘটিত হয়েছিল তা জলের মতো পরিষ্কার। তাই সেদিন কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন করে সংসদ অভিযানের ডাক দিতে হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের কোনো কথা শুনতে চাইল না। কৃষক মিছিলগুলিকে দিল্লি প্রবেশের আগেই সেদিন আটকে দেওয়া হয়েছিল। দিল্লির চারদিকে পাঁচ বর্ডার অর্থাৎ দিল্লির সীমান্তে জাতীয় সড়কে ৩৭৮ দিন এক ঐতিহাসিক কৃষক অবস্থান, শেষে মোদি সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হলো - এ কাহিনিও সবাই জানেন।

২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা ও অন্যান্য আশ্বাসের ঘটনাক্রমও সবারই গোচরে আছে। সেদিন সংযুক্ত কিষান মোর্চার অন্যতম প্রধান নেতা হান্নান মোল্লার মন্তব্য ছিল ঐতিহাসিক - “প্রতারকের বাড়ির নেমন্তন্ন না আঁচালে বিশ্বাস নেই”। ৯ ডিসেম্বর লিখিত আশ্বাসের পর সংযুক্ত কিষান মোর্চা সভা করে ৫- দিল্লি সীমান্ত খালি করে দেবার ঘোষণা করে। কিন্তু আন্দোলন বন্ধ করেননি কৃষকরা। সংসদে ওই ৩ কালা কানুন প্রত্যাহত হলেও গত এক বছর ধরে কেন্দ্র টালবাহানা করে চলেছে। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি “বিশ্বাসঘাতকতা দিবস” পালন, ২৬ নভেম্বর রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালের ভবনের কাছে অবস্থান ও ডেপুটেশন সহ নানা কর্মসূচিতে লক্ষ লক্ষ কৃষক রাস্তায় নেমেছেন। সংযুক্ত কৃষক মোর্চার ৭ দফা দাবির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ও অটুট কৃষক ঐক্যের প্রদর্শনের কর্মসূচিগুলির পর আগামী ২৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফার সংগঠিত কৃষক আন্দোলন শুরুর উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই আরও একবার দেশের কৃষকদের মতামত গ্রহণ ও মার্গ দর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিগত এক বছরে করপোরেট সংস্থাগুলি ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নানা চক্রান্ত, নানা প্রলোভন সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কৃষকদের ঐক্যে কোনো আঁচড় কাটতে পারেনি। গত একবছরে সরকারের সহায়তা পেয়ে করপোরেট পুঁজির শোষণ জালের বিস্তার আরও বিস্তৃত হয়েছে। গুজরাট ও উত্তরপ্রদেশে বিজেপি’র নির্বাচনী সাফল্য, পাঞ্জাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে কৃষক ঐক্যে ফাটল ধরানোর চক্রান্ত সত্ত্বেও সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্বের সুকৌশল অবস্থান সংগ্রামী কৃষকদের মধ্যে আস্থা জাগিয়ে যাচ্ছে। তাই এবারের দ্বিতীয় দফার সংগ্রামের কেন্দ্র আর কেবলমাত্র রাজধানী দিল্লি নয়। এবারের মূল লক্ষ্য, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’কে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না দেওয়া। বিজেপি এবং করপোরেট সংস্থাগুলি যে সমার্থক তা কৃষকদের কাছে আরও বেশি স্পষ্ট করে তুলে ধরা প্রয়োজন। গত ২২ আগস্ট ২০২২ তারিখে নয়া দিল্লির গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন হলে এক কানায় কানায় পূর্ণ সমাবেশে “কৃষক সংগ্রামের ভবিষ্যৎ” সম্পর্কিত আলোচনাসভায় তার আভাস ফুটে ওঠে।

উপরোক্ত সেমিনারে ভাষণের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই সভায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষক প্রতিনিধি ছাড়াও গণসংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ ও দিল্লিস্থ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অংশ নেন। এক বাক্যে সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্ব মত প্রকাশ করেন যে, কৃষক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) আইন লাগু করতে হলে কৃষকদের আরও দৃঢ়, আরও ঐক্যবদ্ধ প্রসারিত সংগ্রামের প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হবে।

মোর্চার অন্যতম নেতা দর্শন পাল সিংয়ের কথায় - মোদি যে অপরাজেয় এই কল্পকথা কৃষকরা ভেঙে দিয়েছে। অপর নেতা রাজেশ টিকায়েতের কথায়, আদানি-আম্বানির মতো করপোরেটদের স্বার্থে কৃষকদের সর্বনাশ ডেকে আনছে বিজেপি সরকার। এজন্যই যেকোনো মূল্যে বিজেপি-কে পরাস্ত করতে হবে। কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা যোগেন্দ্র যাদব ঐক্যবদ্ধ কৃষক সংগ্রামে সারা ভারত কৃষকসভার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে, এমএসপি আইন সহ অন্যান্য দাবি পূরণের জন্য বিজেপি’কে পরাস্ত করতে হবে। হান্নান মোল্লা বলেন যে, অতীতের কৃষক আন্দোলনগুলি পারিচালিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে, এবং তার অবশেষের বিরুদ্ধে। এখনো লড়তে হচ্ছে মূল শত্রু হলো দেশি ও বিদেশি করপোরেট পুঁজি। তিনি সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্বৈরশাসন ও নয়া উদারবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকেই মোদি জমানার অবসানের আহ্বান জানান।

সারা ভারত কৃষক সভার ৩৫তম জাতীয় সম্মেলনে “সব গ্রামে কৃষক সভা ও সব কৃষক কৃষক সভায়” স্লোগান পুনরায় উচ্চারিত হয়েছে। সব গ্রামে সংগঠন প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়ে “সংগ্রাম, সংহতি ও বিকল্পের জন্য এগিয়ে যাবার” - ও আহ্বান জানিয়েছে ওই সম্মেলন।

এক বছর আগের সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল, তিন কালা কৃষি কানুন প্রত্যাহার করা। দ্বিতীয় দফার সংগ্রামের লক্ষ্য আরও সুনির্দিষ্ট - এমএসপি এবং এককালীন কৃষি ঋণ মকুবের আইনি গ্যারান্টির জন্য সংগ্রাম এবং নয়া উদারীকরণের নীতিগুলির কুফল থেকে কৃষিকে মুক্ত করা ও স্বনির্ভর কৃষি নীতি গ্রহণের ব্যবস্থা করা। তিন কৃষি কালা কানুনের আঘাত আচমকা আক্রমণ করে সেই সব রাজ্যকে, যেখানে মান্ডি প্রথা চালু ছিল ও সরকার বেশি বেশি ফসল ক্রয় করত। তাই ওইসব রাজ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব যা ৩৭৮ দিনের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক বেশি উন্নতমানে পৌঁছে গেছে এবং প্রসারিত হয়েছে গণতান্ত্রিক আবহাওয়া - যা কৃষকদের গণচেতনা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছে। আমাদের দেশের অনেক রাজ্যেই এমএসপি আইন চালু নেই, থাকলেও খুব একটা মানা হয় না এবং সরকার কর্তৃক ফসল ক্রয় খুবই সীমিত। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়োজিত শান্তাকুমার কমিটির মতে উৎপন্ন ফসলের মাত্র ৬ শতাংশ সরকার ক্রয় করে। বাদবাকি ফসল বিক্রয় পুঁজিবাদী বাজারের উপর নির্ভরশীল।

তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের কৃষক সংগ্রামের আরও বেশি ব্যাপকতা ও তীব্রতা নিয়ে উদারীকরণের অর্থনীতিকে প্রত্যাঘাত করতে উদ্যত, যা গণতান্ত্রিক ও প্রগতিকামী শক্তিগুলিকে মদত দেবে ও ভবিষ্যৎ সংগ্রামের দিগন্তকে উন্মোচিত করবে।

সবুজ বিপ্লবের আশীর্বাদধন্য দিল্লির আশপাশের এলাকা ধনী কৃষক অধ্যুষিত এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের দৃঢ় সমর্থনভূমি বলে পরিচিত। সেখানে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন চিন্তা ও চেতনার জগতে যে গভীর দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে তা বিবেচনায় রাখা অসমীচীন হবে না। সংগ্রামের আঁচে ওই সব এলাকার গরিব ও পিছনে থাকা জনগণের বিরাট যোগদান এই সংগ্রামে নতুন দিক উন্মোচিত করে। এরফলে কেবল ধর্মীয় বিভাজন রেখা আবছা হয়েছে তা নয়, জাতপাতের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বাধা লুপ্ত হতে পেরেছে। তবে সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হলো - সব ধরনের কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষজন ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী সংগ্রামে এই শ্রেণি-ঐক্যের ধার ও ভার পরীক্ষিত হবে।

এই আস্থাবোধের কারণ দুটো - (১) সংযুক্ত কৃষক মোর্চার কাজের ধারায় আমলাতান্ত্রিকতার স্থলে গণতন্ত্রের বিকাশ (২) সমমর্যাদার সংস্কৃতির প্রাধান্য। আগামী ২৬ জানুয়ারি দেশের সর্বত্র গণতান্ত্রিক পথেই সব ধরনের কৃষকের মতামতের উপর ও নতুন নতুন পরামর্শের দিকে তাকিয়ে আছেন সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্ব।

ফলে দেশ প্রত্যক্ষ করতে চলেছে শক্তিশালী স্বৈরশক্তির সাথে দেশব্যাপী প্রসারিত গণতান্ত্রিক শক্তির আসন্ন লড়াই।