E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯

সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় ১৭তম সম্মেলনের অভিমুখে

বিকল্পের জন্য শ্রমিকশ্রেণি এবং জনগণের প্রতিরোধ ও সংগ্রাম নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

তপন সেন


শোষিত মানুষের ওপর অন্তহীন আক্রমণ, দক্ষিণপন্থী-জনমোহিনী স্বৈরতান্ত্রিকতাবাদের উত্থান এবং নজিরবিহীন মন্দা-বিকাশহীন-মুদ্রাস্ফীতি সহ এসময় পর্যন্ত সবচেয়ে গভীরতম সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সংগঠিত হচ্ছে শৌর্যশীল প্রতিরোধ এবং বিদ্রোহের বীরোচিত ঘটনাবলিও।

দক্ষিণপন্থী অর্থনীতি, সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণ

সরকার-পোষিত একচেটিয়াকরণের অনুশীলন, সুদ, ভাড়া, ফাটকা লাভ এবং অন্যান্যরূপে জনগণকে নিংড়ে নেওয়ার অ-উৎপাদনশীল-পথে বিকৃতভাবে ব্যক্তিগত সম্পদ-পুঞ্জিভবনে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধ ও জোরজবরদস্তিভাবে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত এখন উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত মুনাফাকে বিপুলভাবে ছাপিয়ে যাচ্ছে। শোষণের ওপর স্থান নিয়েছে লুঠ। দীর্ঘসময় ধরে চলা মন্দার পরিস্থিতি এবং মুষ্টিমেয়র হাতে সম্পদের পুঞ্জিভবন ঘটে চলার প্রেক্ষিতে গণ-নিঃস্বতা আরও বিস্তৃত ও গভীরতর হচ্ছে, উৎপাদন ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ব্যবধান চওড়া হচ্ছে, ফলত হ্রাস পাচ্ছে ভোগক্ষমতা। এসবই হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনতিক্রম্য ব্যবস্থাগত দুর্বলতা।

বিশ্বায়িত ব্যবস্থাগত সংকট স্বাধীনতার পর সবচেয়ে স্বৈরাচারী দক্ষিণপন্থী বিভাজনকামী শাসনের উত্থানের সাথেই ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজে শোচনীয় প্রভাব ফেলেছে। এই সরকার আবার সর্বাত্মকরূপে জনবিরোধী এবং খোলাখুলিভাবেই করপোরেটপন্থী ও বৃহৎ ব্যবসাপন্থী। এই সরকারের গৃহীত সমস্ত আইনগত, প্রশাসনিক সমাজ-সংক্রান্ত নীতিতে সরকারের এই চরিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। এটা আবারও জাতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতি করছে। সমস্তরকমের ব্যবস্থাগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এতদিন অর্থনীতির আনুভূমিক সম্প্রসারণের পথ অনুসরণ করা হয়েছিল। মোদি জমানায় সেই পথকে সম্পূর্ণ খর্ব করে দেশি-বিদেশি বৃহৎ করপোরেটের অনুকুলে গভীরতর একচেটিয়াকরণসহ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকে উলম্বভাবে কেন্দ্রীভূতকরণে পৃষ্ঠপোষণা করা হচ্ছে। ইউএপিএ, দেশদ্রোহের মামলা দায়েরের মতো এবং অন্যান্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে নানারকমের প্রশাসনিক পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক অধিকার, জনগণের মতপ্রকাশ ও বিরুদ্ধাচরণের অধিকারের ওপর উগ্র স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণের উদ্দেশে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর নিরন্তর ষড়যন্ত্র চলছে।

প্রশাসনের সক্রিয় মদতে আরএসএস-বিজেপি বাজনদারদের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে সমাজের ওপর সাম্প্রদায়িক বিভাজনকামী কর্মপ্রণালীর উগ্র আক্রমণ এসময়ের সবচেয়ে গুরুতর বিষয়। এর লক্ষ্য হলো, কাঙ্ক্ষিত সংখ্যাগুরু হিন্দুত্ববাদী শাসন প্রকল্পকে মরিয়াভাবে গ্রহণ করে সংখ্যালঘুদের মনে আতঙ্কের পরিবেশ রচনা করা এবং সাথেসাথেই জনগণের মধ্যে সামাজিক-জনজাতিগত যে বৈচিত্র্য রয়েছে তার ওপর হিন্দুত্বের পরিচিতি নির্মাণ করা। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, জীবন ও রুটি-রুজির ওপর যে ক্রমবর্ধমান দুর্বিপাক চলছে তার থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া এবং একইসঙ্গে দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সুপ্রতিষ্ঠিতকরণকে সহজসাধ্য করে তোলা।

যা দেখা যাচ্ছে সংক্ষেপে তা হলো, কেন্দ্রের শাসনপ্রক্রিয়ায় করপোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত সমগ্র শাসনব্যবস্থার স্বৈরতান্ত্রিকীকরণে বাধ্য করার মধ্যদিয়ে বর্ধমান ব্যবস্থাগত সংকটের পরিস্থিতিতে তাদের লুঠকে বজায় রাখতে এসবই হচ্ছে শাসকশ্রেণির এক সর্বব্যাপক প্রকল্প।

সংকট বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথেই দেশের শাসকশ্রেণি অর্থনীতি-পরিচালনা ব্যবস্থাকে বেশি বেশি করে পশ্চাদগামী ও স্বৈরাচারী অভিমুখে পুনঃনির্মাণ ও ঢেলে সাজানোর আরও মরিয়া পদক্ষেপ নিয়েছে। যেটা দেশের জনগণ এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিধ্বংসী আক্রমণকে তীব্র করেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে নানাপথে ধনীদের কর মকুব/ছাড় ও প্রণোদনা-অর্থ প্রদানের ধারা চলেছেই এবং শ্রমজীবী জনগণের ওপর অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা দৃষ্টান্তমূলকভাবে বৃদ্ধি করে রাজস্ব-ক্ষতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছে সরকার। ২০১৬ সালে মোদি সরকার সম্পত্তি কর তুলে দেয় এবং একে অনুসরণ করেই ২০১৯ সালে করপোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২২ শতাংশ করা হয়। একইসাথে, নয়া-উদ্যোগপতিদের জন্য করপোরেট করেও ছাড়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়। তাদের করপোরেট করের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে হয় ১৫ শতাংশ। বৃহৎ করপোরেটরাও ঘুরপথে এই সুযোগকে এখন কাজে লাগাচ্ছে। আবার অন্যদিকে দেশের কর প্রশাসন এতোটাই সুশৃঙ্খল ও তালিমপ্রাপ্ত যে, প্রতিবছর কমবেশি ৫ থেকে ৭ লক্ষ কোটি টাকা আয়কর ও করপোরেট কর বাবদ করপোরেটদের কাছ থেকে অসংগৃহীত বা তাদের অদেয় থাকে।

এরই সাথে জিএসটি-রাজের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণভাবে অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা বেড়েছে এবং এমনকী এই বোঝা চেপেছে খাদ্যদ্রব্য, দুধ ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের ওপরেও। পেট্রোপণ্যের ওপরে অপ্রত্যক্ষ করের অত্যধিক বৃদ্ধি দেখা গেছে। পেট্রোল ও ডিজেলের ওপর আবগারি শুল্ক ২০১৪ সালে ছিল যথাক্রমে প্রতি লিটারে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা এবং ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। ২০২০ সালের মে মাসে এটা রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়ে হয় লিটারপিছু পেট্রোলে ৩২ টাকা ৯৮ পয়সা ও ডিজেলে ৩১ টাকা ৮৩ পয়সা। জ্বালানি-সংক্রান্ত করসমূহ থেকে ২০১৪-১৫ বর্ষে সরকারের আয় ছিল ১ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা, সেটাই ২০২১-২২-তে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৪ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি-সংক্রান্ত কর ও মূলবৃদ্ধির এই দানবীয় শোষণ-কাঠামোর দ্বারা সাধারণ মানুষকে শুষে নেওয়ার পরিমাণ ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ সময়কালে ১৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ অর্থবর্ষে ভারতের প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ ছিল ৯ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট গার্হস্থ্য উৎপাদনে (জিডিপি)’র ৪.৭ শতাংশ; যেখানে ওই বছর অপ্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ হয় ১০ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা, জিডিপি’র ৫.৪ শতাংশ। এই পরিমাণ মোট কর সংগ্রহের ৫৩ শতাংশের বেশি। প্রসঙ্গত, ওইসিডি-ভুক্ত দেশগুলিতে অপ্রত্যক্ষ করের পরিমাণ গড়পড়তা মোট কর সংগ্রহের ৩৩ শতাংশের আশেপাশে।

ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুনাল দ্বারা পরিচালিত ইনসলভেনসি ব্যাঙ্করাপসি প্রসিডিও-এর ইচ্ছাকৃতভাবে বৃহৎ করপোরেটদের খেলাপি-ঋণের দায় থেকে মুক্তি দেওয়াকে বৈধ করার পথে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় সম্পদের সংগঠিত চুরির প্রক্রিয়ার গতিকে সরকার নির্লজ্জভাবে ত্বরান্বিত করেছে। এখন ঋণখেলাপি কোম্পানিগুলির দেউলিয়া ঘোষণার বিষয়টি ন্যাশনাল ল ট্রাইবুনাল দেখভাল করবে। সমস্ত প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত হবে আরেকটি বেসরকারি করপোরেশন দ্বারা দেউলিয়া কোম্পানিটির অধিগ্রহণের মধ্যদিয়ে। এর পরিবর্তে বেসরকারি করপোরেশনটি দেউলিয়া কোম্পানির খেলাপি-ঋণের একটা সামান্য অংশের দায় নেবে। খেলাপি ঋণের অবশিষ্টাংশের দায় ব্যাঙ্কের ঘাড়ে পড়বে। সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের ওপর এই ধরনের বৈধ আত্মত্যাগের চাপকেই ‘হেয়ারকাট’ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

ভরতুকি এবং কল্যাণকর/সামাজিক খাতে বরাদ্দ ধাপে ধাপে বন্ধ করা নয়া-উদারবাদের আরেকটা চালিকাসূচক বৈশিষ্ট্য। মোদি জমানায় এটা সর্বনাশা স্তরে পৌঁছেছে। দেশে ক্ষুধার তীব্রতা যখন বৃদ্ধি ঘটছে তখন ২০২২-২৩ সালের বাজেটে খাদ্যে ভরতুকি কমেছে ২৭ শতাংশের বেশি, টাকার অঙ্কে যা ৮০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। ওই বাজেটেই সারে ভরতুকি কাটছাঁট করা হয়েছে ১ লক্ষ ৫ হাজার ২২২ কোটি টাকা; অর্থাৎ ভরতুকি হ্রাস হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যেই ভারতীয় রির্জাভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিত সীমা অতিক্রম করে গেছে। বৃহৎ অংশের জনগণের ধারাবাহিকভাবে আয় সংকোচন হয়ে চলার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই এই মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে, মানুষের পণ্য-ভোগকে যা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলস্বরূপ শিল্প ও পরিষেবাসমূহের কর্মক্ষমতার ব্যবহারযোগ্যতা বিরাটভাবে কাটছাঁট করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান ও আয়-পরিস্থিতিতে যা আরও ক্ষয় ঘটাচ্ছে। বিনিয়োগ পড়ে যাচ্ছে এবং পরিণতিতে কর্মসংস্থান ও উৎপাদিকা শক্তির বিনাশ ঘটছে। মন্দা সহ মুদ্রাস্ফীতি-বিকাশহীন-এর কুৎসিত চক্র অর্থনীতিতে জঘন্য বিকার ঘটাচ্ছে।

সংকটের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিতে শাসকশ্রেণি একইসাথে শ্রমের ওপর তিনভাবে চক্রান্তমূলক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। প্রথমত, প্রথাগত ক্ষেত্রকে অসংগঠিত করা হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, উৎপাদন-ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়তা এবং কৃত্রিম মেধার প্রয়োগ বৃদ্ধি এবং আরেকটি হলো, গিগ ও পরিষেবা ক্ষেত্রের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি। ফলস্বরূপ, কর্মসংস্থানের অবনমনের সাথেই যুগপৎভাবে বিভিন্নরূপে শ্রমসম্পর্কের নিয়ম শিথিল হচ্ছে।
ক) আরও বেশি অপ্রথাগতকরণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই কর্মস্থলে ক্ষণস্থায়ী ও মিশ্রপ্রকৃতির কাজের সাথেই কর্মশক্তির ছাঁটাই;
খ) সংশয়াতীতভাবে করপোরেট ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের প্রত্যক্ষ করে বিরাট ছাড় সহ ঋণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড়, অন্যদিকে অপ্রত্যক্ষ করের বিপুল বোঝা এবং পরিকাঠামোগত ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে অন্যরূপে ভাড়া চাপিয়ে দেওয়া সহ দ্রুততর গতিতে সম্পত্তিচ্যুত করার প্রক্রিয়ায় জনগণের ওপর লুট চালানোর পরিবেশ তৈরি করা; এবং
গ) করপোরেটদের আরও বেশি করে সম্পদ পুঞ্জিভবনের পথকে সুগম করতে সরকারের সহায়তা ও রাজকোষ থেকে বিপুল ভরতুকি প্রদান সহ প্রকৃতঅর্থে কোনো লিজ-বিনিয়োগ ছাড়াই শিল্প, পরিষেবা, পরিকাঠামো ও গণ-উপযোগগুলিকে বেসরকারি করপোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে মুনাফা লোটার নতুন পথের উন্মোচন।

দীর্ঘদিন ধরেই উৎপাদন ক্ষেত্র সহ পরিকাঠামো ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপে শ্রমশক্তির অস্থায়ীকরণ এবং ঠিকাদারিকরণ অবিরামভাবে হয়ে চলেছে। স্বয়ংক্রিয়করণ এবং প্রযুক্তির আধুনিকীকরণের বিরূপ প্রভাবে উৎপাদন ক্ষেত্রে স্থায়ীশ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া গতি পেয়েছে। অন্যদিকে, চুক্তিবদ্ধ বা ঠিকাশ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অকল্পনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ বোঝা চাপিয়ে তাঁদের নিঃস্বতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদন ও কারিগরি শিল্পের মোট শ্রমশক্তিতে চুক্তিশ্রমিকের অংশ ইতিমধ্যেই ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের বেশি অতিক্রম করে গেছে। পেট্রোলিয়ম, বিএইচইএল, পাওয়ারগ্রিড, এনটিপিসি, এনএইচপিসি প্রভৃতিতে চুক্তি শ্রমিকের সংখ্যা গড়ে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি। এর সাথে ‘অন জব ট্রেনি’, ‘লং ট্রাম ট্রেনি এমপ্লয়িস’, ‘লার্ন হোয়াইল ইউ আর্ন’, ‘জুনিয়র এক্সিকিউটিভস’, ‘ফিস্কড ট্রাম এমপ্লয়িস’, কিংবা ‘এনইইএম’, ‘এনইটিএপি’, এবং ‘এসআইটিএ’ স্কিম ট্রেনি প্রভৃতি বিভিন্ন সরকারি পরিপোষিত প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষানবিশী নিয়োগের মধ্য দিয়ে এখন এক নতুনতর এবং এযাবতকালের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী ও ঠুনকো শ্রমশক্তির উদ্ভব হচ্ছে। স্থায়ীশ্রমিকের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়ে তাদের উপস্থিতি এখন অকিঞ্চিৎকর; এমনকী কোনো কোনো শিল্পে স্থায়ীশ্রমিকের সংখ্যা ১০ শতাংশেরও তলায়।

শ্রম-ব্যয় আরও হ্রাস করতে বুনিয়াদি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বেশি বেশি সংখ্যায় শিক্ষানবিশী নিয়োগের এই নয়াতম চিত্রনাট্য রচনা করছে শাসকশ্রেণি। ইতিমধ্যেই শ্রমআইনের সংশোধনে (ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড) শ্রমজীবীর সংজ্ঞা থেকে শিক্ষানবিশীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। যখন শ্রমিক হিসেবে তাঁদের অস্তিত্বই দুর্বল করে দিয়ে বাস্তবিকই তাঁদের যে অর্থ দেওয়া হয় তা খুবই যৎসামান্য। এবং পরিশেষে, মোদি সরকার অ্যাপরেনটিসশিপ অ্যাক্ট ১৯৬১ এবং এ সম্পর্কিত ১৯৯২ সালের বিধিসমূহও যথাক্রমে ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে সংশোধিত করেছে।

শ্রমের প্রতি শাখায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে, প্রতি একক শ্রম সময়ে এমনকী সেটা মিনিটে কিংবা তার ভগ্নাংশে কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি ও শ্রমকে নিবিড় করা হয়ছে। স্বয়ংক্রিয়তা এবং তার পরিণতিতে স্পষ্টভাবেই নয়া-প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাতিল হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় হয়েছে নির্দিষ্ট কাজের জন্য উৎসর্গীকৃত অভিজ্ঞ শ্রমশক্তি। উৎপাদনের উপায় এমনদিকে যাচ্ছে যেখানে এই নতুন প্রশিক্ষিতদের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় ও প্রযুক্তির অতি উন্নতমানের জ্ঞানের অধিকারী সহ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ বেকার এবং যারা দক্ষ নয়া-প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার জন্য তা দ্রুত শিখে নিতে সক্ষম এমন বিপুল মজুত বাহিনী উৎপাদন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় দায়িত্বের সাথেই এক বোঝা হতে চলেছে।

পুনর্গঠনের এই সমগ্র অনুশীলনের লক্ষ্যই হলো - কর্মসংস্থানের পরিস্থিতিকে আরও হতোদ্যম করে তোলা, সংগঠিত ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া ভঙ্গুর চাকরি-সম্পর্ককে সম্পূর্ণ অপ্রথাগত করা যাতে শ্রমকেন্দ্রগুলি থেকে নির্দিষ্ট শ্রম-ঘণ্টা, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, সংগঠিত হওয়া ও যৌথ দরকষাকষির মতো বুনিয়াদি ধারণাগুলিকে সম্পূর্ণ বিলোপ করা যায় এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের ওপর একপ্রকার দাসত্বের শর্তকে চাপিয়ে দেওয়া যায়। লাগু হওয়া শ্রম কোডগুলি ইতিমধ্যে উৎপাদনব্যবস্থাকে সেই অভিমুখেই পরিচালনা নির্দিষ্ট করেছে।

প্রতিরোধ সংগ্রাম

জনমুখী বিকল্পের অভিমুখে পরিবর্তনের জন্য এবং এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে কার্যকরী লড়াই ও প্রতিরোধ উভয়কেই সংগ্রাম-তীব্রতর করার মধ্যদিয়ে গড়ে তুলতে শ্রমিকশ্রেণিকে অবশ্যই ভালোভাবে শ্রম-সম্পর্কের পুনঃনির্মাণের সমগ্র প্রক্রিয়া এবং অর্থনীতি/ সম্পদ পরিচালনা ব্যবস্থাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে।

পরিশেষে, শোষিত শ্রেণির যৌথ সংগ্রামের পর্যায়কে তীব্রতর করার জন্যই তথাকথিত পুনঃনির্মাণের অভিমুখে এই বিকারগ্রস্ত লুটেরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্বন্ধে সর্বাঙ্গীণ বোঝাপড়া থাকা দরকার। একইসাথে, করপোরেট-সাম্প্রদায়িক জমানার সমাজের ওপর হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের বিপর্যয়কর কর্মপ্রণালীর সঙ্গে লড়াই করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত সচেতন হস্তক্ষেপ অবিচলিতভাবে তীব্র করতে হবে শ্রমিকশ্রেণিকে। যুগপৎভাবে এটা হলো রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াই, যা সংগঠিত শ্রেণি-লড়াইয়ের সাথেই জোরদার করতে হবে।

প্রশাসনে করপোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাতের সর্বব্যাপী কৌশল ও অন্তর্ভুক্তিকরণ সহ জনবিরোধী এবং দেশবিরোধী এই শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের রণকৌশল নির্ধারিত করাই হবে সিআইটিইউ’র ১৭ তম সম্মেলনের কর্মসূচি।


ভাষান্তরঃ শংকর মুখার্জি