৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র রাজ্য সম্মেলন থেকে প্রত্যয়ী আহ্বান
সৃষ্টি ও মনন জগতের সংগ্রামের সঙ্গে মেলাতে হবে রাজপথের লড়াই
সন্দীপ দে
আক্রান্ত সময়ে অন্ধকারের আবর্ত থেকে আলোর দিশায় নতুন পথ সন্ধানের অভিযাত্রায় সৃজন সংগ্রামকে শানিত করার দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র দশম রাজ্য সম্মেলন (নবপর্যায়)-এ। ৭ ও ৮ জানুয়ারি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতা মহানগরীর তপন থিয়েটারে।
সম্মেলনের অভিমুখে উচ্চারিত হয়েছিল দৃপ্ত স্লোগান - ‘খাদের কিনারা থেকে শৃঙ্গের উজানে যাত্রা করো’। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সম্মেলনে বর্তমান সার্বিক সংকটের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। এই সময়ে উগ্র-দক্ষিণপন্থা, করপোরেট পুঁজির সঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধন এবং তাদেরই পৃষ্ঠপোষিত শাসকের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব একদিকে যেমন গণতন্ত্রের বৃহত্তর পরিসরকে সংকুচিত করছে, আবার অন্যদিকে সমাজজীবনে ও মনন জগতে নিদারুণ অভিঘাত তৈরি করছে। এর প্রতিরোধে আমাদের আদর্শ-চেতনার ভিতকে যেমন সুদৃঢ় করতে হবে, তেমনি সুতীক্ষ্ণ করতে হবে আমাদের সৃষ্টি ও সংগ্রামের আয়ুধকে। দৃপ্ত চেতনায় আমাদের সৃজন সংগ্রামকে ক্ষুধা-বঞ্চনা-হতাশা থেকে মুক্তির বৃহত্তর আলোর পথে উত্তরণের স্রোতে মিলিয়ে দিয়ে উজান-যাত্রায় শামিল হতে হবে। সম্মেলনে ঘোষিত এই প্রত্যয় নিয়েই আগামীর আলোক-যাত্রায় অগ্রসর হবে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ।
সম্মেলনের আগে প্রতিনিধিদের রাসবিহারী অঞ্চল পরিক্রমা।
রাজপথে-মিছিলে
সম্মেলনের সূচনা দিনের সকালে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সৃজন-সাথিরা দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী সংগঠনের প্রতীক সংবলিত ফেস্টুনকে সামনে রেখে রাসবিহারী অঞ্চল পরিক্রমা করেন। তাতে অংশ নেওয়া গড়িয়া সুচর্চা’র শিল্পীদের ছন্দময় স্লোগানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গিমা ও প্রতিনিধিদের করতালির সঙ্গে গান পদযাত্রায় অভিনব মাত্রা সংযোজন করে।
সম্মেলনের সূচনায় সংঠনের পতাকা উত্তোলন করছেন পবিত্র সরকার।
পথ পরিক্রমা শেষে সম্মেলন মঞ্চের সামনে পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের সভাপতি শিক্ষাবিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকার।
শহিদ স্মারক স্তম্ভে ফুল-মালা দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন অতিথি, নেতৃবৃন্দ ও আগত প্রতিনিধিরা।
প্রতিনিধি অধিবেশন
সূচনায় শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন সংগঠনের রাজ্য সহ সভাপতি অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়।
উদ্বোধন
সম্মেলন উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, সময়টা খুবই সংকটাপন্ন। রাজ্য ও দেশস্তরে ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদের বিভীষিকা গণতন্ত্রের ঠাটকে মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযানের মধ্য দিয়ে আমাদের যাবতীয় আচারবিধি-মূল্যবোধকে বিনষ্ট করার চক্রান্ত চলছে। আজ থেকে একশো বছর আগে ১৯২২ সালে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট শব্দবন্ধটির প্রথম উদ্ভাবন হয়েছিল। মুসোলিনি ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে রোমে হাজির হয়ে ফ্যাসিবাদের জয়যাত্রাকে আন্তর্জাতিক স্তরে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধে সোভিয়েতের বীরত্বপূর্ণ লড়াই এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানকে রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। নানা চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে আমাদের স্মৃতিতে রয়েছে সেই অগণিত মানুষকে হত্যার বীভৎস ইতিহাস। ফ্যাসিবাদ যখন সম্পূর্ণ পরাজিত তখন হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে ভয়ঙ্কর হত্যালীলা সেদিন আমেরিকা চালিয়েছিল। গণতন্ত্রের আড়ালে সেই প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে ঐক্য রচিত হয়েছিল - তা চুরমার করতে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ উদ্যত হয়েছে। জনসাধারণকে বিভ্রান্ত ও তাড়িত করতে নানারকম উৎকোচ দেওয়া হচ্ছে। অন্তর্জালের উপকরণ দিয়ে দুঃস্থ, দরিদ্র মানুষকে কিনে নেওয়া ও তাদের চেতনাকে বিনষ্ট করার ব্যাপক প্রক্রিয়া চলছে। এই সময়েই যে লেখক-শিল্পীরা গণতন্ত্রে আস্থাবান তাঁদের দায়িত্ব বেড়ে যায়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্য রাখছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, প্রত্যেক লেখক শিল্পীর সেই দুর্লভ ক্ষমতা আছে মানুষের চেতনাকে স্পর্শ করার, মনোদূষণের মাত্রাকে দূরীভূত করার। তবে এটা কোনো সাময়িক সভা-শোভাযাত্রা করে হবে না - প্রতি মুহূর্তে এই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই অপমানকে প্রতিহত করে চেতনার গভীরতম কেন্দ্রে গিয়ে মানুষকে স্পর্শ করতে হবে।
বক্তব্য রাখছেন সম্মেলনের প্রধান অতিথি বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ। তিনি সম্মেলনকে অভিনন্দিত করে বলেন, আমরা দুই বাংলাকে বলি ভঙ্গবঙ্গ। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কলকাতা। এই কলকাতার লড়াই-আন্দোলনের বিরাট ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশও পনেরোটি বছর সামরিক শাসনের অধীনে শোষণ শাসনের পর্ব কাটিয়েছে। আমাদের স্বাধিকারের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আমরা সংগ্রাম করেছি - বিজয়ী হয়েছি। তিনি বলেন, এই সময়ে মার্কেট ইকনমির নামে, গ্লোবালাইজেশনের নামে আদর্শবোধ ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, একটা সময় কলকাতায় লাল পতাকা উড্ডীন ছিল। আজ পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। শাসকের সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র ধর্ম, সেই ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে। এখন সাম্প্রদায়িকতা, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়েছে। এর ফলে প্রগতিশীল চেতনায় ধস নেমে এসেছে। আমাদের সামনে যখন অন্ধকার নেমে এসেছে, তখন ক্রমাগত আলোর সন্ধান করতে হবে। আজকে নতুন প্রযুক্তি এসেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতিতে, গানে আঘাত নামিয়ে এনেছে। আমাদের নতুন গান, নাটক রচনা করে যেমন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে হবে, তেমনি পচনশীল সমাজকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত মানুষ, হতাশ মানুষকে জাগানোটা আজকে বড়ো কাজ। আজকের দিনে ফ্যাসিবাদ-সাম্প্রদায়িকতাকে কীভাবে মোকাবিলা করব তা ভাবতে হবে।
মামুনুর রশিদ আরও বলেছেন, আজকে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ভাবা হচ্ছে অর্থ ছড়িয়েই সব কিছু করা সম্ভব। এখানে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। সেই শিক্ষক কী শিক্ষা দেবেন? আমাদের দেশেও প্রায় একই অবস্থা।
বক্তব্য রাখছেন সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক পবিত্র সরকার।
তিনি বলেন, আজকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তাদের স্বার্থে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নাটক প্রযোজনা করছে। সেখানে স্তালিনকে, মার্শাল জুকভকে ভাঁড় হিসেবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। আসলে ওরা সর্বত্র স্তালিনের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। তাই এই সময়ে আমাদের শৈল্পিকভাবে নতুন সৃষ্টি করতে হবে।
মামুনুর রশিদ বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির উল্লেখ করে বলেছেন, আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে এগোচ্ছি, সেখানে হতাশা সর্বব্যাপী। এই পরিস্থিতিতে নাটকের মতো একটি গণতান্ত্রিক মাধ্যমকে আমরা ব্যবহার করতে পারি। এখানে উৎপল দত্তের মতো নাট্যব্যক্তিত্ব কালজয়ী নাটক নির্মাণ করেছেন। গানের মধ্য দিয়েও মানুষকে জাগানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে আইপিটিএ-র গান জনমানসে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
উদ্বোধনী পর্বে সংগঠনের সভাপতি পবিত্র সরকার উদ্বোধক ও প্রধান অতিথিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, সমাজকে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে আমাদের বিকল্প সংকল্প নির্মাণ করতে হবে। এটা একটা রাজনৈতিক সংগ্রাম। একদিকে আমাদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করতে হবে - অন্যদিকে আমাদের সৃজনকে সংগ্রামের পথে চালিত করতে হবে। এজন্য আমাদের কঠোর চর্চা প্রয়োজন। আজকে ফ্যাসিবাদ-পুঁজিবাদ যে বিভ্রান্তিকর কাজ করছে, আমাদের সমাজজীবনকে আক্রান্ত করছে, তার বিরুদ্ধে সৃষ্টি কীভাবে করব - তার জন্য আমাদের নিরলস চর্চা করে যেতে হবে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে আমাদের লড়াই চালাতে হবে। এই সম্মেলন থেকে সংগ্রাম ও শিল্পের শপথ নিতে হবে আমাদের।
সম্মেলনে বিভিন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন অমিতাভ চক্রবর্তী (ভারতীয় গণসংস্কৃতি সংঘ), তরুণ গুপ্ত (পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোক শিল্পী সংঘ), দিব্যেন্দু চ্যাটার্জি (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ), অজন্তা রাজ মোহন (পুরগোনামা কলা সাহিত্য সংগম), তপন কুমার বসু (ক্রান্তি শিল্পী সংঘ) এবং ডঃ শান্তরাম (পশ্চিমবঙ্গ জনবাদী লেখক সংঘ)।
সম্পাদকীয় প্রতিবেদন
সম্মেলনে খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন উত্থাপন করেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীব্যাপী সংকট তীব্র হয়েছে। বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক ঝোঁক তীব্র হয়েছে। মানুষের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের রাজনীতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষের সংঘবদ্ধ শক্তিকে ভাঙতে শাসকের হাতিয়ার জাতিবিদ্বেষ, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও মৌলবাদ। কোভিডের অভিঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকা, শিক্ষা, সংস্কৃতি - সবকিছু। ভারতে বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ড ফ্যাসিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, আজকের ফ্যাসিবাদ গত শতকের ফ্যাসিবাদের চেহারায় ফিরে আসবে না। এই অবস্থায় লাতিন আমেরিকা আশার সঞ্চার করছে।
তিনি এই প্রেক্ষাপটেই জাতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বলেন, আমাদের দেশেও বিজেপি সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ক্রমাগত বাড়ছে। দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের প্রাক্মুহূর্তে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম।
সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করছেন সাধারণ সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজ্যের চেহারা ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে উঠছে, কেন্দ্রের সরকারের মতোই এখানেও গণতন্ত্রের ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত নেমে এসেছে। দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছে। কেন্দ্রের সরকার আরএসএস-র দর্শনকে বাস্তবায়িত করার সবরকম প্রয়াস নিচ্ছে, আর রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানও তাদের সহায়ক হয়ে উঠছে।
এই পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে অঙ্গীকার করা হয়েছে - আমরা সৃজনের মধ্য দিয়েই সংগ্রামের পটভূমি রচনা করব। নিবিড় অধ্যয়ন, সৃজনশীল মনন ও সমস্যার গভীরে গিয়ে উত্তরণের পথ সন্ধানের প্রত্যয়ের কথা উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবেদনে।
সম্মেলন মঞ্চে আয়ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন কোষাধ্যক্ষ শ্রীনিবাস ধর।
আলোচনায় সৃষ্টি ও সংগ্রামের প্রত্যয়
সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনার সূত্রে বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা বর্তমানের সার্বিক সংকট-দীর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেও সমস্ত দুর্বলতা, সংকোচ, ভয়কে অতিক্রম করে যাবতীয় সৃষ্টির আয়ুধকে শানিত করে আলোর অভিসারী হবার সংগ্রাম-দৃপ্ত শপথ উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, ধর্মান্ধতা, উগ্র-সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিচ্ছে, ফ্যাসিবাদের মতো প্রবণতা যখন প্রকট হচ্ছে, তখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত শ্রমজীবী ও মুক্তমনা মানুষ। এই সময়ে এর প্রতিরোধে আমাদের বিকল্পের রূপরেখা নির্মাণ করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের সংগঠনকে গড়ে তোলার দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে। মতাদর্শের ভিত্তিকেও আমাদের সুদৃঢ় করতে হবে। তাঁরা বলেছেন, গরিব নিপীড়িত মানুষ যারা উন্নততর সংস্কৃতি আস্বাদন করতে পারেন না, তাদের কাছে আমাদের সৃষ্টি সম্ভারকে নিয়ে যেতে হবে। উপেক্ষিত মানুষের ভাষা আমাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে তুলে ধরতে হবে।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে, কোভিডের ভয়ংকর অভিঘাতে ক্ষত গভীরতর হলেও এই দুঃসহকালে আমাদের অসামান্য অর্জন হলো ‘রেড ভলান্টিয়ার’। বিভিন্ন জেলায় সেইসময় মৃত্যুর বিভীষিকাময় ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করেই সংগঠনের সাথিরা সীমিত সাধ্য নিয়ে দুর্গত ও দুঃস্থ মানুষের পাশে উপস্থিত থেকেছেন। যা সৃজন সংগ্রামেরই এক অনন্য দিক।
প্রতিনিধিরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গেই তুলে ধরেছেন প্রান্তিক আদিবাসী লোকশিল্পীদের জীবন যন্ত্রণা, দুঃখের কথা। এই সূত্রেই তাঁরা উল্লেখ করেছেন জারি, সারি, মনসা গানের মতো লোকশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। সেখানে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের চটুল-অবক্ষয়ী উপস্থাপনা দূষণ ছড়াচ্ছে। তাই এই সংকট নিরসনে চাই সংগঠনের সুনির্দিষ্ট ভাবনা।
প্রতিনিধিরা এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন যে, এই সময়ের নিকষ কালো আঁধারের বুক চিরে অগ্রগতির পথ রচনায় বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো মনীষীদের সৃষ্টি ও জীবনচর্চাকে বেশি বেশি করে তুলে ধরা জরুরি।
তাঁদের উপলব্ধি, আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়া যখন আমাদের জীবন চর্যায় গভীরভাবে রেখাপাত করছে, তখন সংগঠনের প্রসারে বিশেষ করে মানুষের সার্বিক কল্যাণে এই মাধ্যমের ব্যবহারের কৌশলকে রপ্ত করতে হবে।
বর্তমানের বিভেদের রাজনীতি নৈরাজ্য, দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং বিশ্বভারতীর অচলাবস্থা ঘোচাতে প্রতিবাদী-আন্দোলন গড়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাঁরা।
প্রতিনিধিরা গর্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করেছেন সংগঠনের গৌরবময় পঞ্চাশ বছরের সুদীর্ঘ পথ পেরোনোর ঐতিহ্যের কথা।
প্রতিনিধিরা তাঁদের আলোচনায় গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলেছেন, এই সময়ে জরুরি হলো মানুষের স্বার্থে বিকল্প ভাবনা, বিকল্প সংস্কৃতির নির্মাণ - সেই লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরন্তর চর্চা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আপন আপন সৃষ্টিকে আরও পরিশীলিত ও শানিত করা। এর মধ্য দিয়েই সৃষ্টি ও সংগ্রামের নতুন অভিমুখে যাত্রাপথ নির্মিত হবে।
জবাবি ভাষণ
৪৪ জন প্রতিনিধির সমৃদ্ধ আলোচনার পর প্রতি-ভাষণে বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আন্তর্জাতিক-জাতীয় ও রাজ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদের অনুধ্যানে রয়েছে। প্রত্যেক জেলার নিজস্ব সমস্যা ও বৈচিত্র্য রয়েছে। তার উপর ভিত্তি করেই আমাদের আগামীদিনের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে।
তিনি তাঁর ভাষণে বিগত দিনে সংগঠন পরিচালনায় যে প্রতিবন্ধকতা এসেছে, বিশেষ করে কোভিড সংক্রমণকালে যে সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং অন্যান্য ত্রুটি-দুর্বলতাগুলি সামনে এসেছে তার উল্লেখ করে বলেছেন, আমাদের সমস্যার গভীরে যেতে হবে, মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনকে অনুভব করতে হবে। একলা সংস্কৃতিতে নয় - আমরা বিশ্বাস করি সমবেত সংস্কৃতিতে। আমরা গড়তে চাই জনমানুষের সংস্কৃতি।
প্রতিনিধিদের আলোচনায় যে সব সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও ভাবনার কথা উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি বলেছেন, লোকশিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়ে সাধ্যমতো তাদের সৃজন কর্মে উৎসাহ প্রদান করা জরুরি। গান, কবিতা, নাটক ইত্যাদি সৃষ্টির সমস্ত উপকরণ নিয়ে এবং লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে গভীরতম ভাবনা ও কর্মশালা করার উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মের হৃদয়কে স্পর্শ করা এবং সমাজে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর উপযোগী সৃষ্টি কর্মে আমাদের প্রয়াসী হতে হবে। এই লক্ষ্যে আমাদের সৃষ্টির মানের উত্তরণ ঘটাতে হবে।
তিনি বলেছেন, আমরা আমাদের লক্ষ্য ও মতাদর্শে স্থিত থেকেই অগ্রসর হবো। আমাদের সৃষ্টির সার্বিক বিকাশের পাশাপাশি বিজ্ঞান চেতনাও উন্নত করা একান্ত জরুরি।
পরিশেষে তিনি বলেছেন, আমাদের সৃষ্টির মধ্যে সময়কে প্রতিফলিত করতে হবে। আজকে করপোরেট পুঁজি লালিত সংস্কৃতি, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আমাদের মনন জগতে যে আঘাত হানছে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে, তার মোকাবিলায় সৃষ্টিকে হাতিয়ার করেই সংগ্রামে ব্রতী হতে হবে। আমাদের মনন জগতের সংগ্রামের সাথে রাজপথের সংগ্রামকেও মেলাতে হবে।
সম্মেলনের শেষদিনে প্রতিনিধিদের আলোচনার সূত্রে সংগঠনের অন্যতম সহ-সভাপতি শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, বর্তমান সময়ে উগ্রসাম্প্রদায়িকতা-ছদ্ম-ফ্যাসিবাদ-দুর্নীতি ইত্যাদিকে প্রতিহত করতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীর বাণী ও জীবনচর্যা আমাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষে সম্মেলনে সমাপ্তি ভাষণ দেন অধ্যাপক পল্লব সেনগুপ্ত।
নতুন নেতৃত্ব
সংগঠনকে আগামীর নতুন দিশায় পরিচালনার লক্ষ্যে সম্মেলন থেকে ১৯১ জনের রাজ্য কমিটি নির্বাচিত করা হয়েছে। এছাড়া ৩৫ জনের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী ও ৭২ জনের রাজ্য কর্ম পরিষদ গঠন করা হয়েছে।
সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন যথাক্রমে পবিত্র সরকার, রজত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রীনাবাস ধর।
সম্মেলন উপলক্ষে ছবি আঁকছেন শিল্পীরা।
গৃহীত প্রস্তাব
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ-র রাজ্য সম্মেলন থেকে অহিন্দিভাষী ভারতীয় নাগরিকদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার পক্ষে; ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে; শিক্ষায় দুর্নীতি ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব সহ রাজা রামমোহন রায়ের সার্ধ-দ্বিশততম জন্ম বার্ষিকী পালনের উদ্যোগ সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতিনিধি পরিচিতি
সম্মেলনের অন্তিমপর্বে প্রতিনিধি পরিচিতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন পেশ করেন মহাদেব চক্রবর্তী। এবারের সম্মেলনে ৩১২ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ প্রতিনিধি দক্ষিণ ২৪ পরগনার হেমেন মজুমদার (৯০) ও সবচেয়ে নবীন উত্তর ২৪ পরগনার শঙ্খজিৎ দে (২৩)।
সম্মেলন উপলক্ষে ছবি আঁকছেন শিল্পীরা।
সম্মেলনের শুরুর দিন সম্মেলনস্থলের বিপরীতে প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে ২৩ জন চিত্রশিল্পী তাঁদের ভাবনায় এই সময়ের ছবি চিত্রিত করেন ক্যানভাসে। সম্মেলন মঞ্চে সেই ছবিগুলো প্রত্যেক জেলার প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছবির ভাষার সাথে সম্মেলনে প্রতিভাসিত অঙ্গীকার মিলিয়ে মূর্ত হয় আগামীদিনের সৃষ্টি ও সংগ্রামের দৃপ্ত প্রত্যয়।