E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯

ত্রিপুরার চিঠি

জনবিচ্ছিন্নতায় ভীত বিজেপি সরকার ত্রিপুরায় আরও হিংস্র অত্যাচারী হয়ে উঠেছে

হারাধন দেবনাথ


৮ জানুয়ারি আগরতলার বিবেকানন্দ ময়দানের সুবিশাল সমাবেশ।

৫৮ মাসে বিজেপি’র বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত ছোট্ট পার্বতী ত্রিপুরা। গণতন্ত্র নিধনের পরীক্ষাগার হিসেবে ত্রিপুরাকে বেছে নিয়েছে শাসক বিজেপি। শরিক আইপিএফটি মৃত্যুপথযাত্রী, কার্যত অস্তিত্বহীন। ২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৯টি প্রতিশ্রুতিতে যাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন তাঁরা আজ প্রতারিত। বঞ্চিত মানুষ, শিক্ষক-কর্মচারী, বেকার যুবক-যুবতী বিজেপি’কে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বিজেপি জোট সরকার নির্বাচনের দোড়গোড়ায় কর্মচারীদের সামান্য ডিএ, ১ লক্ষ ভাতা প্রাপকের নাম বাদ দিয়ে ভাতার পরিমাণ বাড়িয়েছে। প্রথম বছরেই ৫০ হাজার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিকি ভাগও চাকরি দেয়নি নির্বাচনের সন্ধিক্ষণে এসেও। শীত, প্রশাসনের বাধা ডিঙিয়ে চাকুরিচ্যুত ১০,৩২৩ শিক্ষক ইন্টারভিউ দেওয়া বেকার যুবক-যুবতী, চাকুরি-প্রত্যাশী নার্সরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। বৃদ্ধা মা, সন্তান হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছেনঃ ‘বাবার চাকুরি ফিরিয়ে দাও, সন্তানের কাজ চাই’। বর্বর বিজেপি সরকার আন্দোলন ভাঙতে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে। অমানবিক সরকার প্রবীণার আকুতির মর্যাদা দেয়নি। জনবিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকায় শহরে পুরনিগমের, গ্রামে রেগা শ্রমিকদের বিজেপি পতাকা লাগাতে বাধ্য করছে। পোষা কিছু লোক দিয়ে গড়া ‘বাইক বাহিনী’ একমাত্র ভরসা। বাইক বাহিনী কার্যত জনমানসে ঠ্যাঙারে বাহিনী হিসেবে পরিচিত। যতদিন যাচ্ছে ততই শাসকের বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এনে বাজার গরম করার চেষ্টা হয়েছে। শাসক বিজেপি ধর্মনগর থেকে ‘যাত্রা’র সূচনা করেছিল। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই যাত্রার পর সাব্রুম গিয়ে উদ্বোধন করেন আরেকটি যাত্রার। কেন এই ‘যাত্রা’র আয়োজন? জনগণ শাসকদলকে পিঠ দেখাতে শুরু করেছেন। তাই হুমকি দিয়ে এবং নানা কৌশলে লোক জড়ো করা হয়েছে দুটি স্থানে। প্রধানমন্ত্রীর আগরতলার সমাবেশের ইতিবৃত্ত তো কর্মচারী-অফিসাররাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। পাঁচ বছরের শাসনে এমন কি ঘটল যে শাসকদলকে এখন এমন যাত্রা, আস্থা সমাবেশ করে দেখাতে হচ্ছে? আসলে লম্বা লম্বা প্রতিশ্রুতি আর বাগাড়ম্বর নির্ভরতায় যে ক্ষুধার পেট ভরে না, এটা শাসকরা ভালোই বোঝেন। তাই ফের জুমলার নন্দী-ভৃঙ্গীরা আসছেন। যাত্রা শুরু করেছেন। জনগণের ওপর আর আস্থা, ভরসা রাখতে পারছেন না। জনগণ মুখ ফেরালে এসব যাত্রা, বাইক বাহিনী কিংবা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর উপর কতটা ভরসা করা যায়? অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে মানুষ শত্রু-মিত্র চিনছেন। তাই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লালঝান্ডার মিছিলে, সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে - তা দেখে শাসক কোন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বিছাবে তা সময়েই বলা যাবে।

৮ জানুয়ারি আগরতলার বিবেকানন্দ ময়দানের বিশাল সমাবেশে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য মানিক সরকার সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, রাজনৈতিক স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করা হলে মানুষ ছেড়ে দেবেন না। মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দপ্তর থেকে জনগণকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা হচ্ছে, জিরো পোল ভায়োলেন্সের কথা। এই প্রসঙ্গে মানিক সরকার বলেছেন, লোকসভা ও চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কমিশন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময় পুলিশ কেন্দ্রের কাছে যে আধা-সামরিক বাহিনী চাইতো ভোটের আগের দিনও চাহিদার অর্ধেকও আসত না। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই সরকার থাকার পরও ১০০ কোম্পানি চলে এসেছে। আরও নাকি ৩০০ কোম্পানি আসবে। চাইলে হাজার কোম্পানি আসতে পারে। কারণ কী? অন্য ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। সমাবেশে শামিল শ্রমজীবীসহ অন্য অংশের মানুষের কাছে বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন - দুশমন, জনবিরোধী ফ্যাসিস্তসুলভ সরকারকে হঠান। জনদরদি, বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচির সরকার গঠন সু‍‌নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নিন। সমাবেশে একই আহ্বান জানিয়েছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী, সিআইটিইউ’র রাজ্য কমিটির সভাপতি মানিক দে, সংগঠনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক শংকর প্রসাদ দত্ত এবং শ্রমজীবী নারী নেত্রী পাঞ্চালী ভট্টাচার্য। তাঁরা বলেছেন অতীতে ত্রিপুরা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। আগামীদিনেও সফল হবে। ফেব্রুয়ারিতে ভোট। যাঁরা ঘর ছেড়েছেন তাঁরা জয়ী হয়ে ঘরে ফিরুন।

৮ জানুয়ারি নির্বাচনকে সামনে রেখে শ্রমজীবী মানুষের সমাবেশ নতুন বার্তা দিয়ে গেল। কুয়াশার চাদর সরিয়ে ভেসে ওঠা সূর্যের আলোতেই রাজ্যের বুকে বি‍‌জেপি’র দুঃশাসনের আঁধার কাটিয়ে নতুন ভোর আনার সংকল্প শুনিয়ে গেলেন শ্রমজীবী মানুষ। ধর্মনগর থেকে সাব্রুম। খোয়াই থেকে করবুক। লালঝান্ডা হাতে শ্রমজীবী অংশের মানুষ সংগ্রামী চেতনার ঢেউ তুলে জানান দিলেন ভোটাধিকার রক্ষার লড়াই চলবে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে।

রবিবারের দুপুর ছিল রোদ ঝলমলে। স্বামী বিবেকানন্দ ময়দান ভরে উঠেছিল যুদ্ধ জয়ের প্রত্যাশী সেনানীদের উপস্থিতিতে। পরপর কয়েকদিন ছিল আবছা আকাশ। শ্রমজীবী মানুষের উদ্দীপনাকে কুর্নিশ জানাতেই যেন হেসে উঠেছিল সূর্য। মঞ্চের ব্যারিকেড লাগোয়া প্রথম দিকের সারির এককোণে চেয়ারে বসে রোদের আমেজ নিচ্ছিলেন অশোক সাহা। কয়েক মাস হলো বোধজংনগর শিল্পতালুকের একটি কোম্পানিতে তালা ঝোলায় কাজ হারাতে হয়েছে। সমাবেশে আসার কারণ জানতেই তিনি বললেন, বাঁচতে হবে। বাঁচার লড়াই মানুষকে সঠিক পথ দেখাচ্ছে। তিল তিল করে চোখের সামনে গড়ে ওঠা শিল্পতালুক ৫৮-৫৯ মাসেই খাদের কিনারায়। এক এক করে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি কোম্পানি। নতুন করে মাঝারি মাপের একটি কোম্পানিও চালু করতে পারেনি। বেকারদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে কী করে? সোনার থালাকে ছিদ্র করে দিয়েছে বিজেপি। এই সরকার না পালটালে ধ্বংস হয়ে যাবে ত্রিপুরা। মানুষের একটাই কথা। অবাধ ভোটের ব্যবস্থা করুক নির্বাচন কমিশন। বিজেপি’র পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।

সিআইটিইউ’র ডাকা সমাবেশে পালাবদলের কথাই অনুরণিত হলো উপস্থিত মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে। কেউ কেউ ঘর ছেড়েছিলেন অন্ধকার থাকতে। কেউ কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে চেপেছেন গাড়িতে। কেউ কেউ গাড়ি না পেয়ে ট্রেনে চাপার চেষ্টা করেছেন। ধরেছেন যাত্রীবাহী গাড়ি। লালঝান্ডা আতঙ্ক ধরায় শাসকের বুকে। তাই স্থানে স্থানে ভাড়া করা গাড়ি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে চালক, মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে। খোয়াই, উদয়পুর, কমলপুর, সোনামুড়া মহকুমা এলাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি বেশি ঘটে। প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করানোর চেষ্টা হয় রেলপথেও। তিনটি মিছিল উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় বিবেকানন্দ ময়দানে। দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, পরিবহণ শ্রমিক, কলকারখানা, চালকল শ্রমিক, মাঠে কাজ করা কৃষিশ্রমিক, বাগিচা শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, দোকান কর্মী কে না ছিলেন সমাবেশে। সকলের চোখে-মুখে ছিল প্রত্যয়। বিজেপি’র ৫৮-৫৯ মাসের শাসন কেড়ে নিয়েছে রাতের ঘুম। রক্তাক্ত শহর, গ্রাম-পাহাড়। লুটতরাজে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। ভুলুণ্ঠিত অধিকার। বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে কাজের সমস্যা। সরকারি বিনিয়োগ না হওয়ায় আঘাত নেমে এসেছে নির্মাণ শিল্পে। আগের মতো কাজ মিলছে না দিনমজুরদের। ডিজেল, পেট্রোল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে পঙ্গু পরিবহণ ব্যবস্থা। আর্থিক বিপর্যয়ে বন্ধ হয়ে পড়ছে একের পর এক কলকারখানা। লোকসানের মুখে উঠে যাচ্ছে চালকল। বাগিচা শ্রমিকদের উপর চলছে শোষণ। কাজ নেই রেগায়। দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে পুর, নগর, পঞ্চায়েত সংস্থা। কাজ চাইলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে অফিস থেকে। প্রতিবাদ জানানোর উপায় নেই। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর। মানুষের আওয়াজ ছিল দুঃশাসনের জাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার। সমাবেশে যুবকদের অংশগ্রহণ ছিল নজরকাড়া। ছিল উদ্দীপনা। লাল পাঞ্জাবি, লালশার্ট পড়া যুবক, লাল শাড়ি পড়া মহিলারা সংগীতের তালে তালে নাচছিলেন। এ যেন নতুন সূর্য ওঠার বার্তা।

জনগণের কথাই উঠে এসেছে মানিক সরকারের এবং নেতৃত্বের ভাষণে। মানিক সরকার বলেন, পরিস্থিতি যা এই সরকার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরা ভীত, সন্ত্রস্ত ও শঙ্কিত। সাধারণ মানুষের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিকে সংহত করার জন্য ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণি, শ্রমজীবীদের এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হবে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে। ‘আমার ভোট আমি দেব’ - এই অধিকার আর হরণ করতে দেব না। এর জন্য মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই বার্তা নিয়ে সারা রাজ্যে ছুটতে হবে। তাহলেই দুশমন, জনবিরোধী ও ফ্যাসিস্তসুলভ ভাবনার সরকারকে হটিয়ে আপনাদের স্বার্থে যাঁরা লড়াই করে এরকম শক্তিকে জয়যুক্ত করতে হবে। কুল ছাপানো সমাবেশে শামিল মানুষ ফিরেছেন সেই বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে।