৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯
বিকল্প পথে - ‘কাল থেকে পাঠশালা বন্ধ’
অম্বিকেশ মহাপাত্র
২০১৯ সালের মার্চ মাসে খবরে প্রকাশ - স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-র মেধাতালিকাভুক্তরা দুর্নীতির শিকার! মেধাতালিকাভুক্তরা চাকুরি পাননি, পেয়েছেন মেধাতালিকার বাইরে থেকে! নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে, এমনকী সংসদীয় রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং তৎকালীন সময়ে বাম বিধায়কের শাসকদলে যোগদান! এবং পরের দিনই প্রাক্তন মন্ত্রী-কন্যার নাম এসএসসি’র মেধাতালিকায় উপরে উঠে যায়! এবং মন্ত্রী-কন্যার নিয়োগপত্র! বহুমুখী খুল্লমখুল্লা দুর্নীতির ভয়ংকর খেলা! প্রতারিতরা জড়ো হলেন কলকাতার ধর্মতলা চত্বরে। প্রেসক্লাবের সামনে খোলা আকাশের নিচে। শুরু করলেন অনশন কর্মসূচি, পুলিশ প্রশাসনের সার্বিক অসহযোগিতা সত্ত্বেও। মাথার উপর একটা ত্রিপলও টাঙাতে দেওয়া হলো না! কী অমানবিক আচরণ পুলিশ প্রশাসনের! যাঁরা জনগণের দেয় টাকায় মাস মাহিনা গ্রহণ করেন। কি অমানবিক সরকার! যে সরকারের আধিকারিকগণ জনগণের দেয় করের টাকায় নানাবিধ সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। এবং যাঁরা সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণ করেছেন, জনগণের জীবন-জীবিকা রক্ষায় পক্ষপাতহীন কাজ করবেন।
অনশনস্থল থেকে ফোন - ‘স্যার, একদিন আসুন।’ অগত্যা কয়েকজন মিলে একদিন অনশনস্থলে। দেখে বিস্মিত! মহিলারাও অনশনে! এমনকী কোলের বাচ্চা নিয়ে! রোদ-বৃষ্টি-আঁধার, তার উপর প্রশাসনের সার্বিক অসহযোগিতা, সর্বোপরি প্রেসক্লাবের সামনে অনশন অথচ প্রেসের ব্ল্যাক-আউট! অপরদিকে শিক্ষামন্ত্রীর নিদান - বসে পড়লেই চাকরি জুটবে না। জনগণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান, সংবিধানের মর্মবস্তু গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম ব্ল্যাক-আউট করলেও, ই-দুনিয়ার সহায়তায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদটি ভাইরাল। বহু সংগঠন, ব্যক্তি-মানুষ অনশনকারীদের পাশে। অপরদিকে লোকসভার সাধারণ নির্বাচন দোরগোড়ায়। অবস্থা বেগতিক বুঝে, অনশনের ২৯ দিনের মাথায়, ২৯ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী সহ মুখ্যমন্ত্রী সটান অনশনস্থলে। সংবাদমাধ্যম, অনশনকারী সহ সকলের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা - ‘অনশনকারী সকলের চাকুরির ব্যবস্থা হবে। তোমাদের কয়েকজনকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হবে, কমিটি সমস্ত খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে ওয়ান-টাইম নিয়ম বদলে সকলের চাকুরির ব্যবস্থা করবে।’
অনশনকারীরা অনশনের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন; মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির ভরসায়। খানিক স্বস্তিলাভের মধ্যে যে যাঁর বাড়ির পথে পা বাড়ালেন। লোকসভার সাধারণ নির্বাচন মিটল। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হতে থাকে। এই অবস্থায় পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে ফেলল। আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। উলটোদিকে আশঙ্কা ঘনীভূত হতে থাকল। অর্থাৎ সমুখে ঘোর অমানিশা। তারসঙ্গে ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়’; উপরি নব্য করোনা ভাইরাস, অতিদ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা, সঙ্গে অসুখ কোভিড-১৯, অতিমারী, টোটাল লক্-ডাউন, সরকারি নানান বিধিনিষেধ, disaster management act, বিশেষ করে জমায়েতে বিশেষ বিধিনিষেধ। শিক্ষা দপ্তরের পোয়াবারো। প্রতিশ্রুতি পাশে রেখে পুনর্বার প্রতারণা ! মোটা টাকার বিনিময়ে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ চলল বেলাগাম। ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে...’; এ খবর কি গোপন রাখা যায়? নতুন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী স্কুলে যোগদান করছেন অথচ মেধাতালিকায় নাম নেই! মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কমিটি তৈরি হয়েছে, কিন্তু সমাধান নেই! সবটাই আই-ওয়াশ! এদিকে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে। অতিমারী আবহে নির্বাচনের তোড়জোড়। আর যাঁরা মেধাতালিকায় নাম তুলে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শুধুই অপেক্ষা-আন্দোলন-প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন; সেই সকল প্রতারিতদের সুলুক সন্ধানে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় কোথায়? ‘পথেই এবার নামো সাথী পথেই হবে এ পথ চেনা...’। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নেই, সঙ্গে সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র অতিমারীর দোহাই। ‘বয়স কারোর ধার ধারে না, বেড়েই চলে’ (সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’); সেকারণে মেধাতালিকাভুক্তরা অনুমতি পেতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলেন। ‘হাইকোর্টের অনুমতি পাওয়া’ কি হাতের মোয়া? চাইলেই পাওয়া যায়? অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়, গব্য ঘৃত ঢালতে হয়, আইনজীবী ধরতে হয়। সে যাইহোক মহামান্য হাইকোর্ট শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দিলেন। ৩০ জানুয়ারি ২০২১, প্রতারিতরা বিধান নগরে শিক্ষাদপ্তর বিকাশ ভবন থেকে বেশ খানিকটা দূরে করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় ফুটপাথে অবস্থান ও রিলে অনশনে বসলেন। আবারও সেই পুলিশ প্রশাসনের সার্বিক অসহযোগিতা। পাশাপাশি হুমকি, মাঝেমধ্যে অবস্থানস্থল ভেঙে দেওয়া, গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া, এইসব লুকোচুরি চলল। মধ্যিখানে আন্দোলনকারীদের কাতর আবেদনে দু-বার গিয়ে দেখা করে এলাম। অনেককিছু জেনে ও শিখে এলাম। এইভাবে ১৮৭ দিন অতিক্রম করতে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে কোনো সুরাহা হয়নি! ইতিমধ্যে মাননীয়া বহুমত জোগাড় করে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রীর বদল ঘটিয়েছেন। সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব এবং মহাবিদ্যালয়-শিক্ষক তথা শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখাও করতে চাইলেন না! অপরদিকে এসএসসি’র চেয়ারম্যান পদে অনবরত বদল! তার উপর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। ফলে পুলিশ প্রশাসনের বাড়তি সুযোগ। অতীব উৎসাহ-উদ্দীপনায় রাতের আঁধারে আশপাশের সব আলো নিভিয়ে অবস্থানস্থল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন এবং অবস্থানকারীদের টেনে-হিঁচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে থানায় আটকে রাখলেন। আন্দোলনকারীরা আর আন্দোলনস্থলে জোট বাঁধতে পারেলেন না।
আন্দোলনকারীরা আবার হাইকোর্টে। অবস্থানে বসার অনুমতি চাই। অনুমতি মিলল। একসাথে ৫০ জন বসা যাবে, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত, কিন্তু মাথার উপর কোনো আচ্ছাদন নয়! এবার অবস্থানস্থল, ধর্মতলা চত্বরে জাতীর জনক গান্ধীমূর্তির পাদদেশে। সুবিচার, ন্যায়বিচার, প্রতিশ্রুতি পূরণ, মেধা অনুযায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ সবই মিলিয়ে গেছে! ২০১৬ সালে যাঁরা বিজ্ঞাপন দেখে, নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে, ফরম পূরণ করেছিলেন। জোরকদমে প্রস্তুতি নিয়ে স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি) দিয়েছিলেন, ইন্টারভিউ দিয়ে সমস্ত শংসাপত্র দেখিয়ে মেধাতালিকায় নাম তুলেছিলেন, বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মহান ব্রতে ব্রতী হবেন স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের বয়স ৬ বছর শুধু বেড়ে গেছে তাই নয়, হতাশায় কেউ কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত, কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, কেউ কেউ হাইকোর্টে কড়া নেড়েছেন। এই প্রেক্ষিতে দুর্নীতির অভিযোগে হাইকোর্টে একাধিক মামলা দায়ের। বিচারপতি মাননীয় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এসএসসি-কে তথ্য জমা দিতে বলেন। এসএসসি তথ্য জমা দিতে পারেনি। চেয়ারম্যানকে তলব করেন, চেয়ারম্যান কোর্ট এড়ান, নানান অজুহাতে। এই প্রক্রিয়ায় সামনে আসে - এসএসসি সুপারিশ করেনি অথচ স্কুল শিক্ষাদপ্তর নিয়োগপত্র দিয়েছেন, সেই নিয়োগপত্রে স্কুলে যোগদান, নিয়মিত মাস মাহিনা সবই চলছে। একটি ঘটনা নয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ভুরি ভুরি। আরও সামনে আসে শিক্ষাদপ্তর নিযুক্ত নজরদারি কমিটি, যার মাথায় শান্তি প্রসাদ সিংহ মহাশয়, এবং সেই সময়কালে এই সকল দুর্নীতি বেগবতী হয়েছে। নানান জনের দায়ের করা মামলার শুনানিতে পর্বত-প্রমাণ দুর্নীতির কেবলমাত্র শৈলশিখর দৃশ্যমান হয়। দুর্নীতির পুরো স্বরূপ জানতে বিচারপতির নজিরবিহীন নির্দেশ সিবিআই অনুসন্ধানের। একাধিক মামলায় একাধিক নির্দেশ সিবিআই অনুসন্ধানের। সরকার পক্ষ তড়িঘড়ি ডিভিশন বেঞ্চে, সিবিআই অনুসন্ধানে একের পর এক স্থগিতাদেশ! পাশাপাশি বিচারপতিকে প্রস্তাব এবং প্রকারান্তরে ভীতি-প্রদর্শন। বিচারপতি বিচার চেয়ে চিঠি লিখলেন হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কাছে ! হাইকোর্টের বিচারপতি যদি বিচার প্রার্থনা করেন, তাহলে মেধাতালিকাভুক্তরা যে প্রতারিত থেকে যাবেন, বিচার পাবেন না, অপরদিকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, পুলিশ প্রশাসনের অমানবিক হৃদয়হীন অসহযোগিতা, নাগরিক অধিকারের উপর নগ্ন আক্রমণ নেমে আসবে, এ আর এমনকী?
একটি মামলায় ডিভিশন বেঞ্চ সিবিআই অনুসন্ধানের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগ মহাশয়ের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটি তাঁদের রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা করেন। তার থেকে জানা যায়, শান্তি প্রসাদ সিংহ মহাশয় নেতৃত্বাধীন ৫-সদস্যের কমিটি গঠন বেআইনি। বেআইনি কমিটি এসএসসি’র সমান্তরাল অফিস গড়ে জাল সুপারিশপত্র দিয়ে গেছেন, কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে। এই প্রক্রিয়ায় ৬০৯ জন শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হয়েছে, সাম্প্রতিককালে! পাঠক পড়তে পড়তে অবাক হচ্ছেন, হয়তো কারুর কারুর একঘেয়েমি লাগছে। কিন্তু সবকিছু পুঙ্খানুপঙ্খ লিখলে একটি রামায়ণ বা মহাভারত হয়ে যাবে। সেই পথে যাব না। ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না। এখানেই শেষ করব। বাকিটা পাঠক চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ প্রয়োগে অনুধাবন করুন। আপনার করণীয় কী? ঠিক করুন। ইত্যবসরে আমার একটি অভিজ্ঞতা বলি।
১৯৭৯ সালে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করে, তিন বছরের বিএসসি অনার্স এবং দু-বছরের এমএসসি পাস করলে, এমএসসি পাস করার কথা ১৯৮৪ সালে। কিন্তু কোনো স্তরে অকৃতকার্য না হয়েও, পাস সার্টিফিকেট হাতে পেলাম এক বছরেরও বেশি সময় পরে, ১৯৮৫ সালে। বিনা অপরাধে জীবনের সময়কাল থেকে এক বছরের বেশি সময়কাল ভ্যানিস! কারণ খুঁজতে গেলে আপনাকে সত্তরের দশকে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য সহ ছাত্রখুন, গণটোকাটুকি, শিক্ষক খুন, উপাচার্য খুন,... ইত্যাদির ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। এমএসসি পাশের পর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ অথবা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি (এমসি) শিক্ষক বাছাই করতেন, জেলার ডিআই অফিসের অনুমোদন নিয়ে এমসি শিক্ষকের নিয়োগপত্র দিতেন। তাতে অর্থের বিনিময়, স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ আসত। তার প্রতিকারে তদানীন্তন সরকার ৫টি জোন সহ এসএসসি গড়ে শিক্ষক বাছাইয়ের দায়িত্ব অর্পণ করে। এসএসসি সুপারিশ পাঠিয়ে দিতেন এমসি’র কাছে, এমসি নিয়োগপত্র দিতেন। নিয়মিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় ফি বছর চাকুরিপ্রার্থীরা অনায়াসে শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োজিত হয়েছেন। সারণি থেকে তা জানা যাবে। মেধার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে হবে, এই আশা বিশ্বাসে পরিণত হয়।
তখন অবস্থান, অনশন, পুলিশি নির্যাতন, হাইকোর্ট, সিবিআই অনুসন্ধান, ডিভিশন বেঞ্চ, নজরদারি কমিটি, ভুয়ো সুপারিশ, কোটি কোটি টাকার লেনদেন - কোনো অভিযোগই সামনে আসেনি। এখন নিয়োগপত্র দেওয়ার দায়িত্ব স্কুল শিক্ষা দপ্তরের হাতে। অর্থাৎ সরাসরি শিক্ষামন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। সেকারণেই নজরদারি কমিটির সকলের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর তলব সিবিআই দপ্তর নিজাম প্যালেসে! তলব এড়াতে আবারও ডিভিশন বেঞ্চের সহযোগিতা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও শেষমেশ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সহ শিক্ষা দপ্তরের প্রায় সকলেই দীর্ঘদিন জেলবন্দি। দুর্নীতি-সমস্যার সমাধানের রাস্তা কী? আমার তো মনে হয় রাস্তাই রাস্তা দেখাবে। দলমত নির্বিশেষে নিজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে রাস্তায় নামুন। অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব হোন। চুপ থাকবেন না।
আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, এসব কী করে সম্ভব হচ্ছে? দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, তার সংবিধান, সাংবিধানিক প্রধান, সাংবিধানিক নানান প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, বিচার-ব্যবস্থা,... ইত্যাদি ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও? আমি প্রকৃতি বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক। আমি প্রকৃতি থেকেই শিখি। তারসঙ্গে ব্যক্তিজীবনের গত দশ বছরের কার্টুনকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাই প্রকৃত শিক্ষক। তার উপর নির্ভর করে বলি। এই ‘দুর্নীতি সহ নৈরাজ্য’ কেবল এসএসসি সহ শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, বিচারালয়ে, নির্বাচনে সর্বত্র। ফলত গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক কাঠামো প্রতি দিন ভাঙছে, প্রতি দিন প্রতি পলে রাজ্যের প্রতিটি এলাকায় তা নজিরবিহীন আক্রান্ত হচ্ছে। মুখ্য কারণ প্রশাসনিক প্রধান। যিনি কেবল প্রশাসনিক প্রধানই নন, শাসকদলের সর্বময়ী নেত্রী। উল্লেখ্য শাসকদলের নেতারাই বলেন - ‘আমাদের দলে একটি পোস্ট বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট’। তিনি ধান্ধার পুঁজিতন্ত্রে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে; ‘দলতন্ত্র নয় গণতন্ত্র চাই’, ‘বদলা নয় বদল চাই’, সততার প্রতীক স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে, মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর ‘শাসকদল-আশ্রিত দুষ্কৃতী-পুলিশ প্রশাসনের যোগসাজশ’-র ‘শাসনব্যবস্থা’ কায়েম করেছেন। ফলশ্রুতিতে এই সকল ঘটছে। তিনি যে এই সকল ঘটাবেন তার ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল। ২০১১ সাল থেকে যিনি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড কি বলছে? তিনি ভুয়ো ডক্টরেট ডিগ্রি ব্যবহার করে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন, নিজের দল ভেঙে দল গঠন করে সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে জোট গড়ে মন্ত্রীত্ব করেছেন, দাঙ্গায় অভিযুক্তকে ফুল পাঠিয়েছেন, আরএসএস’র দুর্গা সম্বোধনে ভূষিত, সংবিধানের বই হাতে নিয়ে অনুগামীদের দিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিধানসভায় ভাঙচুর করিয়েছেন, শিল্প সম্ভাবনাকে সমূলে উপড়ে ফেলতে রামধনু জোট এবং মিথ্যাচারের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, প্রকাশ্যে বলেছেন ‘আমি গুন্ডা কন্ট্রোল করি’, সেই তিনিই যখন প্রশাসনিক প্রধান তখন যা ঘটবার তাই-ই প্রকৃতির নিয়মে ঘটছে। এখন সবই তাঁর অনুপ্রেরণায় ঘটেছে, ঘটছে, ঘটবে। শাসকদল সহ প্রশাসনের সকলকেই ‘অনুপ্রেরণা’ শব্দটি ব্যবহার করেই কথা বলতে হয়। শেষ করি মুক্তমনা চিন্তাবিদ, বিশিষ্ট মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ, যিনি সগর্বে বলতে পারেন ‘আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট,’ সেই ডঃ অশোক মিত্রের বক্তব্য দিয়ে। একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি ২২ নভেম্বর ২০১৫ তাঁর সমুখে উপস্থিত হয়েছিলাম। আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে। উনি যা বলেছিলেন - ‘‘পশ্চিমবাংলার মানুষ আজ সর্বস্তরে আক্রান্ত। বিভিন্ন স্তরের সমাজবিরোধীরা একত্রিত হয়ে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরিতে সফল। তাদের যিনি সর্বময়ী নেত্রী, গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি অনেক গুন্ডাদের অনুশাসনে রেখেছেন। হয়তো যোগ করতে ভুলে গেছেন, এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ গুন্ডারাও তাকে শাসন করে।... গুন্ডার দল রাজ্যের প্রশাসন অধিকার করে বসেছে। প্রশাসন ভয়ে কুঁকড়োলো, গুন্ডাদের নির্দেশেই পুলিশ এখন পরিচালিত হয়। অতএব খুনি, চোর-জোচ্চোর, লুটেরা ও ধর্ষণকারী সম্প্রদায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।’’ এই প্রেক্ষিতে আপনি ভাবুন, আপনি মুক্তমনে সিদ্ধান্ত নিন।
এসএসসি-র মাধ্যমে নিয়োগ ১৯৯৮-২০১১ সময়কালে
সাল | নিয়োজিত |
১৯৯৮ | ৮,০৭২ |
১৯৯৯ | ১০,৯৮৭ |
২০০১ | ১২,৬৪১ |
২০০২ | ৯,৯৮০ |
২০০৪ | ৮,৬৮৫ |
২০০৫ | ১৪,২৬৭ |
২০০৭ | ২০,৮৮৭ |
২০০৮ | ১০,৯৯৫ |
২০০৯ | ১২,৯৩১ |
২০১০ | ১৩,৬৭৭ |
২০১১ | ১১,৭২৩ |