৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯
খাদ্যের অভাব নয় - দারিদ্র্য এবং বণ্টন ব্যবস্থাই ক্ষুধার কারণ
পারভেজ রহমান
‘ক্ষুধা হলো ক্ষুধাই, কিন্তু ছুরি ও কাঁটা দিয়ে রান্না করা মাংসের দ্বারা মেটানো ক্ষুধা, হাত, নখ এবং দাঁতের সাহায্যে কাঁচা মাংসকে ঠেলে দেওয়ার থেকে আলাদা ক্ষুধা’
- কার্ল মার্কস (গ্রুন্ড্রিস)
সাধারণভাবে আমাদের বলা হয়ে থাকে যে, এই বিশ্বে প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নেই, পৃথিবীতে অনেক বেশি মানুষ আছে তাই আমাদের সকলকে অবশ্যই খাবারের ব্যবহার কমাতে হবে - বুর্জোয়া প্রচারকদের একটি সহজ ধারণা।
কার্ল মার্কসের লেখা, ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘‘রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনায় অবদান’’ গ্রন্থের ভূমিকা অনুযায়ী কোনো সমাজের জন্য বস্তুগত শক্তিগুলি না আসা পর্যন্ত কোনো নতুন সমাজ সম্ভব নয়। পুঁজিবাদ কমবেশি দুই শতাব্দীর ব্যবধানে ব্যাপক উৎপাদন শক্তি সৃষ্টি করেছে। এটি খাদ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, শুধু চরম হিসাবে নয় বরং আপেক্ষিক অর্থেও, অর্থাৎ গ্রহে বসবাসকারী মানুষের প্রকৃত সংখ্যার অনুপাতে।
আসলে সমস্যাটি উৎপাদনের নয়, সমস্যাটি বিতরণের। কোটি কোটি মানুষ আছে যারা ক্ষুধার্ত থাকে তার কারণ পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদিত হয় না - এমনটা নয়, বরং উৎপাদিত খাদ্য কেনার সামর্থ্য তার নেই বলে। আমাদের খাদ্যের ‘‘অতিরিক্ত উৎপাদন’’ আছে, এই অর্থে নয় যে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয়, বরং এই অর্থে যে, এটি বাজারের ‘শোষণে’র জন্য খুব বেশি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পুঁজিবাদীদের জন্য ব্যক্তি কেবল তখনই বিদ্যমান থাকে যখন তাদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে, অর্থাৎ খরচ করার জন্য তাদের পকেটে অর্থ থাকে। যে মানুষের কাছে টাকা নেই, বাজারের কাছে সে হিসাব বহির্ভুত।
এটা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই মানুষগুলো শুধু বিদ্যমান নয়, তারা খুব রাগীও হয়। এই শতাব্দীর শুরুতেই আমরা বিশ্বের কয়েক ডজন দেশে খাদ্য দাঙ্গা দেখেছি। বাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অস্তিত্বহীন মানুষগুলোকেই আমরা দেখেছি হাইতির রাস্তায় নেমে এসে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। এইভাবে আমাদের যা আছে তা হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পুঁজিবাদের সীমাবদ্ধতার প্রত্যক্ষ পরিণতি।
খাদ্য সংকটের উপরে রয়েছে পুঁজিবাদের সাধারণীকৃত সংকট যা সারা বিশ্বের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের চেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কোটি কোটি মানুষ সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দিকেই প্রশ্নচিহ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, যে ব্যবস্থার অধীনে তারা বাস করে। অথচ গণমাধ্যম, সরকার এবং তথাকথিত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস করলে এই ব্যবস্থাটি সবচেয়ে ভালো বলে মেনে নিতে হয়।
দশকের পর দশক ধরে জমা হওয়া পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলো প্রতিশোধ নিয়ে সমাজের উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এই সংকটের মধ্যেই খাদ্য উৎপাদনের বিশেষ সংকট রয়েছে বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, খাদ্য বিতরণের।
খাদ্য সংকটের প্রশ্নটির আসল সত্যটাকে উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন যা সরকারি বুর্জোয়া মিডিয়া দ্বারা চাপা পড়ে গেছে। সাধারণভাবে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ বা দার্শনিকেরা সমস্যাটি দেখার একটি খুব সাধারণ উপায় বাতলে দেন যে, ‘‘পৃথিবীতে অনেক বেশি মানুষ আছে’’ বা ‘‘পশ্চিমের লোকেরা খুব বেশি খায়।’’ আসলে এভাবে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে আড়াল করে দোষ চাপানো হয় শিল্পোন্নত দেশগুলিতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাঁধে। বাস্তব পরিস্থিতির উপর গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে বোঝা যাবে যে, বিশ্ব আসলে প্রত্যেকের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করে। আসলে সমস্যাটি উৎপাদন বা সরবরাহের নয়, কেনার ক্ষমতার!
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সর্বজনিক। জাতিসংঘের মতে ২০১৯ সালে প্রায় ৮২.১ কোটি মানুষ ‘দীর্ঘস্থায়ীভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে’। যদিও, যে সময়ে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত, ঠিক তখনই ১০০০ হাজার কোটিরও বেশি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত হয় - যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দেড় গুণ।
জাতিসংঘের আর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৮২.৮ কোটিতে পৌঁছেছে। এটি ২০২০ সাল থেকে প্রায় ৪.৬ কোটি এবং কোভিড-১৯ মহামারী প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ১৫ কোটি বেশি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। সেই দেশের ২.৩৫ কোটি আমেরিকান, সর্বাধিক দরিদ্র। যারা আদতে খাদ্য মরুভূমিতে বাস করে।
পুঁজিবাদের অধীনে অত্যধিক উৎপাদন এবং অপচয় যথারীতি ব্যবসা। ‘অতিরিক্ত খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। ব্রিটেনের সুপার মার্কেটগুলিতে প্রতি বছর ১৯ কোটি মূল্যের খাবার ফেলে দেওয়া হয়। খাদ্য বর্জ্যসূচক ২০২১ অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ৯৩.১ কোটি টন খাদ্য অপচয় করা হয়েছে, যার ৬১ শতাংশ এসেছে পরিবার থেকে, ২৬ শতাংশ খাদ্য পরিষেবা থেকে এবং ১৩ শতাংশ খুচরা থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ব্যক্তি প্রতি ৫৯ কিলোগ্রাম বা ১৯,৩৫৯৯৫১ টন অপচয় করে, যেখানে ভারতীয়রা প্রতি বছর ৫০ কিলোগ্রাম বা ৬৮,৭৬০,১৬৩ টন অপচয় করে।
‘অতিরিক্ত’ পণ্য ধ্বংস করা আসলে পুঁজিপতিদের কম দামে বিক্রি করা এড়ানোয় এবং পণ্যের কৃত্রিম অভাবের মাধ্যমে দাম বাড়াতে সাহায্য করে। তারপরও বিপুল সংখ্যক অবিক্রীত খাবারের পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষুধার ঘটনাটি এমন একটি ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি যা তাদের ন্যূনতম মজুরি পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেয়।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতেও, ‘খাবারের জন্য অর্থ প্রদানের অক্ষমতাই ক্ষুধার আসল কারণ।’
ভারতেও, দুর্বল-ভ্রান্ত সরকারি নীতি এবং ধনীক শ্রেণির দ্বারা আর্থিকভাবে দুর্বল অংশের উপর অর্থনৈতিক শোষণই হলো এদেশে দারিদ্র্যের প্রাথমিক কারণ। ক্ষুধা এই দারিদ্র্যের প্রধান প্রভাব।
আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়, তবে অনাহারজনিত মৃত্যুর কোনো সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ২০২০-২১ সালে গত বছরের তুলনায় ৩.৭৪ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি করে ৩০.৮৬৫ কোটি টন খাদ্য শস্য উৎপাদন করেছে অথচ ভারত ক্ষুধার্তের এক উদ্বেগজনক হারের সম্মুখীন হচ্ছে।
‘ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট হেলথ’-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং আসামে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সর্বোচ্চ মাত্রা রয়েছে, যা দ্রুত মৃত্যু ঘটায়। অপুষ্টি এবং প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি গ্রহণে ভারসাম্যহীনতা এদেশের শিশুদের মধ্যে খুব সাধারণ বিষয়। প্রসঙ্গত, ভারতে ৬৯ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি।
ভারতেও ক্ষুদার্থ মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’ (GLOBAL HUNGER INDEX)-২০২২-এ ভারত ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭তম স্থানে রয়েছে। এশিয়ায়, আফগানিস্তান ১০৯তম স্থানে থেকে ভারতের পিছনে একমাত্র দেশ। প্রতিবেশী দেশগুলি - পাকিস্তান (৯৯), বাংলাদেশ (৮৪), নেপাল (৮১) এবং শ্রীলঙ্কা (৬৪) সবারই এই সূচকে অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো। ২০২১ সালে, ভারত ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম স্থানে ছিল এবং ২০২০ সালে দেশটি ৯৪তম স্থানে ছিল। ২০০৯ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ৬৮টি দেশের মধ্যে ৬৬তম।
শুধু ক্ষিদের ক্ষেত্রেই নয়, অপুষ্টির দিক থেকেও ভারত ক্রমাগত পিছিয়ে চলেছে। দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের পরিমাণ ২০১৮-২০২০ সালে ১৪.৬ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০২১ সালে ১৬.৩ শতাংশে বেড়েছে। অর্থাৎ ভারতে ২২.৪৩ কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার। বিশ্বব্যাপী মোট ৮২.৮ কোটি মানুষের মধ্যে।
আমাদের দেশে ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ (NATIONAL FOOD SECURITY ACT-NFSA) ২০১৩, জুলাই, ২০১৩-তে পাশ করা হয়েছিল। খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আইন অনুসারে, গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত, পাশাপাশি শহুরে জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ, মানুষ রেশনের মাধ্যমে ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্য পাওয়ার অধিকারী। অতএব, এই আইন অনুযায়ী জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ভরতুকিযুক্ত খাদ্যশস্য পাওয়ার অধিকারী।
‘খাদ্য নিরাপত্তা’কে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, ‘একটি পরিবারের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা মানে সক্রিয়, স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যে সব সময় সকল সদস্যের প্রবেশাধিকার (ACCESS)। ‘অর্থাৎ ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ - ২০১৩ দেশের সমস্ত মানুষের মুখে খাদ্য জোগান দেবে - এই লক্ষ্য নিয়ে। এনএসএস-র তথ্য এর সাহায্যে এটি প্রমাণিত যে ১৯৯৬ সালে শুরু হওয়া রেশন ব্যবস্থায় বিপুল সংখ্যক দরিদ্রদের বাদ দিয়েছে। অর্ধেকেরও বেশি কৃষি শ্রমিককে বিপিএল বিভাগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্ধেকেরও বেশি দলিত ও উপজাতি সম্প্রদায়ও বাদ পড়েছে।
তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের মতে গড় জাতীয় দারিদ্র্যসীমা গ্রামীণ এলাকায় জনপ্রতি দৈনিক যে টাকা দারিদ্র্য সীমার ম্যাপ হিসাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে তা আসলে দারিদ্র্য নয়, দরিদ্রতার মাত্রা। এবং এখনও, এই স্তরের উপরে উপার্জনকারী যে কেউ ভরতুকির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। বাম এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দলের চাপের মুখে, দারিদ্র্যের অনুমান পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ডঃ এস তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে কমিটি এমন একটি পদ্ধতির সুপারিশ করেছিল যা তৎকালীন স্তর থেকে গ্রামীণ দারিদ্র্যকে প্রায় ৪২ শতাংশে উন্নীত করবে এবং শহুরে দারিদ্র্যের অনুমান ২৬ শতাংশে উন্নীত হবে। এই সংক্রান্ত বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী সম্প্রতি রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘দারিদ্র্যরেখা কোন স্তরে নির্দিষ্ট করা উচিত সে সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে।’’ সেই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘‘তেন্ডুলকরের পক্ষে বা উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার পক্ষে একটি ঐক্যমত্য আবির্ভূত হয়নি,’’ তারা বলেছে, টাস্ক ফোর্স এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, বিষয়টি আরও গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত। একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দারিদ্র্য সম্পর্কিত দেশের শীর্ষ বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া উচিত। আইন অনুযায়ী দেশের কোনো মানুষের অভুক্ত থাকার সুযোগ নেই।
এর পাশাপাশি এপিএল বিভাগের জন্য কোনো খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয় না। শুধু এপিএল ভরতুকি বাদ দেওয়া হয় না, এমনকী এপিএল বিভাগও বাতিল করা হয়েছে।
বিভিন্ন কৃত্রিমভাবে আরোপিত পদ্ধতির মাধ্যমে, এনএফএসএ বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা রাজ্য সরকারগুলি তথাকথিত ‘‘অগ্রাধিকার’’ পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করার নামে যোগ্য সুবিধাভোগীদের সংখ্যা কমাতে সব ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করছে। মহারাষ্ট্রে, রাজ্য সরকার ২০১১-১২ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষা ব্যবহার করেছে, যেখানে গ্রামীণ এলাকার জন্য ৪৪,০০০ টাকা এবং শহুরে এলাকার জন্য ৫৯,০০০ টাকা কাট-অফ বার্ষিক আয়ের মাত্রা রয়েছে। পরিবারগুলিকে আয়ের শংসাপত্র তৈরি করতে বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটদের ৬০,০০০ টাকার নিচে আয়ের শংসাপত্র না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওডিশায় যে কোনো পরিবারের সদস্যদের আয় বা পেনশন হিসাবে ১৫,০০০ টাকা শহরাঞ্চলে এবং ১০,০০০ টাকা গ্রামীণ এলাকায় থাকলে নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ দেওয়া হয়। কর্ণাটকে ভোটার আইডি এবং নামের বিদ্যুৎ বিল যোগ্যতার জন্য বাধ্যতামূলক। উত্তরপ্রদেশে একটি অনলাইন রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ফর্মগুলি প্রত্যাখ্যান করে যা ভোটার আইডি এবং মোবাইল নম্বর দিতে পারেনি। বায়োমেট্রিক রেশন কার্ড, আধারের সাথে সংযোগ, অনলাইনে ফর্ম পূরণ, এবং প্রযুক্তিগত (‘DIGITAL’) বিষয়ের উপর জোর দেওয়ায় দরিদ্রদের জন্য বিশাল অসুবিধা তৈরি করছে যাদের কম্পিউটারে অ্যাক্সেস নেই বা এই সিস্টেমগুলি ব্যবহার করার প্রযুক্তিগত দক্ষতা নেই।
পশ্চিমবাংলাতেও এই সমস্ত পদ্ধতিকে খুব সুচারুভাবে ব্যবহার করে বহু মানুষকে এই সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পশ্চিমবাংলার যন্ত্রণা আর এক ধাপ বাড়িয়েছে - রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মানুষকে সরাসরি এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে।
আগস্ট ২০১৫, সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশ অনুসারে আধার পিডিএস-র জন্য এবং খাদ্যশস্য, কেরোসিন এবং এলপিজি বিতরণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই আদেশকে ব্যবহার করে সরকার বহু মানুষকে আধার না থাকার অজুহাতে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। এটি নয়া উদারনীতির (NEO LIBERAL) অর্থনীতির অ্যাজেন্ডার অংশ।
তদুপরি, লোকেদের যোগ্যতা প্রমাণের প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত রেখে এবং একটি মিথ্যা আশা যে, তারা সফলভাবে সমস্ত প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরে প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হবে।
এই মিথ্যা আশা জাগিয়ে রেখে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আসলে স্পষ্টতই এই বিযুক্তকরণের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মানুষকে সংঘবদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাকেও বিনষ্ট করছে। খাদ্যের মৌলিক অধিকার থেকে বৃহৎ অংশকে বাদ দিয়েছে।
এর সমাধান খুবই নির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট - একটি সর্বজনীন বণ্টন ব্যবস্থা - যা নিয়ন্ত্রিত মূল্যে সমস্ত প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে। সেই মাধ্যমেই দেশের সকল মানুষের জন্য ভরতুকিযুক্ত মূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা। অন্যথায় ভবিষ্যতে ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’- এ পিছিয়ে পড়া নিশ্চিত হয়ে উঠবে।