৬০ বর্ষ ২২ সংখ্যা / ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২৮ পৌষ, ১৪২৯
যোশীমঠে প্রকৃতির প্রত্যাঘাত
তপন মিশ্র
ধস যোশীমঠে।
প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। হিমালয়ের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের উপর যে অত্যাচার গত কয়েক বছর ধরে করে চলেছে সরকার, হিমালয় তার প্রতিবাদ করছে। দু’দিন আগে চামোলি জেলার হেলাং এবং মারওয়ারির মধ্যে সড়ক তৈরির কাজের বিরুদ্ধে বদ্রীনাথ জাতীয় সড়ক অবরোধ করে যোশীমঠের অধিবাসীরা। তাঁরা সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে স্লোগান তোলেন। যোশীমঠের কাছে অবস্থিত ‘নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ’। এই জৈববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই অংশকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ৯টি ছোটো বড়ো নালা (প্রাকৃতিক) শহরের মধ্যে এবং আশেপাশের জল বহন করে অলকানন্দা এবং ধৌউলিগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, হিমালয়ের এই অংশের এক বিপুল পরিমাণের জল যোশীমঠ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এখানেই চার চারটি বড়ো এবং ভারি প্রকল্পের কাজ চালাচ্ছে সরকার।
বিজ্ঞানকে অস্বীকার করছে সরকার
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যোশীমঠের উচ্চতা প্রায় ৬,০০০ থেকে ৭,৫০০ ফুটের মধ্যে। মিশ্র কমিশনের রিপোর্টে যা উল্লেখ আছে তা হলো, ভূতত্ত্ববিদদের ভাষায় ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিকদিয়ে এই অঞ্চল ‘weathered, landslide mass of big unsettled boulders in the loose matrix of fine micaceous sandy and clayey materials’। অল্প কথায় বললে ক্ষয়ীভূত, ভূস্খলনের ফলে সৃষ্ট বড়ো বড়ো অস্থির পাথরের চাঁইর উপর এই অঞ্চলের অবস্থান। এখানে কাদামাটি এবং বালির সূক্ষ্ম কণার যে ভিত্তি রয়েছে তা অত্যন্ত আলগা। এই থেকে বোঝা যায় যে, কতটা ক্ষণভঙ্গুর শিলার উপর এই শহর রয়েছে। যারা ভূতত্ত্বের ছাত্র নন তারাও সহজে বুঝবেন যে, এইরকম একটি শিলাস্তরের উপর ভারি নির্মাণ অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। মোদি জমানায় অর্থাৎ মাত্র এই কয়েক বছরে যে এই ভূতাত্ত্বিক গঠনের আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে না এটা সবাইয়ের জানা। কিন্তু এখানে অবস্থিত ধর্মস্থানগুলির উন্নয়নের নামে হিন্দু ভাবাবেগকে আরও তীব্র করা সম্ভব সেটা হিন্দুত্ববাদীরা ভালোই বোঝে। সুতরাং প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের সমূহ ক্ষতি হলেও কুছ পরোয়া নেই।
১৯৭৬ সালে গাড়োয়াল কমিশনার এম সি মিশ্রকে এই অঞ্চলে এক বড়ো বিপর্যয়ের পর এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপদ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়। তখন পর্যটন শিল্পের জন্য এই অঞ্চলে হোটেল ও অন্যান্য সুবিধা তৈরির উদ্যোগ তখন শুরু হয়ে গেছে। যোশীমঠের ১৬ কিলোমিটার দূরে আউলিতে তখন ভূস্খলন হয়েছিল। আউলি হলো উত্তরাখণ্ডের শীত ক্রীড়ার এক বড়ো কেন্দ্র। এম সি মিশ্র কমিটি রিপোর্টে বলা হয় যে, আউলিতে যে ভূস্খলন ঘটছে, এখানকার অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণের কাজ তার জন্য দায়ী। কমিশনের রিপোর্ট বলছে যে, ১৯৬২ সালের পর থেকে এই অঞ্চলে ব্যপকভাবে জঙ্গলে গাছ কাটা এবং নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর এই কাজকে সরকার বন্ধ করেনি।
এম সি মিশ্র ১৯৬০ সাল থেকে গড়োয়ালের কমিশনার ছিলেন। তিনি রিপোর্ট তৈরির আগে বেশ কয়েকজন ভূবিজ্ঞানী, অরণ্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেন। পরবর্তীকালে এনিয়ে আরও অনেক গবেষণা এবং অধ্যয়ন হয়েছে। কোনো গবেষণা-তথ্যই এই অঞ্চলে বিশালাকার নির্মাণের পক্ষে কথা বলেনি বরং তার বিরোধিতা করেছে। কিন্তু সরকার এসবের কোনো গুরুত্ব দেয়নি। এখানকার বাসিন্দাদের দাবি অগ্রাহ্য করে হিন্দু ভাবাবেগকে উৎসাহিত করার জন্য বার বার এই অঞ্চলের বাইরের মানুষদের জন্য এই সমস্ত বড়ো প্রকল্পের কথা বিরাটভাবে প্রচার করা হয়েছে। এই রিপোর্টে ১৮৮৬ সালে ইংরেজ আমলের ‘হিমালয়ান গেজেটিয়ারে’রও কথা উল্লেখিত হয়। সেখানেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছিল।
২০০৬ সালে ডঃ স্বপ্নমিত্র চৌধুরী নামে একজন ভূবিজ্ঞানী যোশীমঠের কাছে একটি অঞ্চলে, তৎকালীন কিছু ভূস্খলনের কারণে একটি রিপোর্ট তৈরি করার দায়িত্ব পান। তিনিও লেখেন “Unplanned growth and construction of heavy infrastructure, as observed in Joshimath, are not advisable in this area.” - যোশীমঠে যে অপরিকল্পিত নির্মাণ হচ্ছে তা এই রিপোর্টে স্পষ্ট।
২০১৮ সালে, ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন, এই অঞ্চলে প্রধান ভূমিধসের কথা তুলে ধরে। এই বিশাল ভূমিধস ঘটে ২০১৭ সালের ১৯ মে যোশীমঠ থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে ধৌলিগঙ্গা এবং অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল বিষ্ণুপ্রয়াগে। বলা হয় ‘‘...এই পর্বতাঞ্চল একটি ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চল কারণ এই পর্বতে খুব খাড়া ঢাল রয়েছে এবং সঙ্গে আছে আলগা এবং বড়ো পাথরের ব্লক। এখানে আরও বলা হয়েছে “The road sector particularly from Chamoli to Badrinath is a high landslide prone zone due to weak geological formation, steep slopes, highly dissected topography, seismically active area and high rainfall…’’ অর্থাৎ চামোলি থেকে বদ্রীনাথ পর্যন্ত সড়ক দুর্বল ভূতাত্ত্বিক গঠন, খাড়া ঢাল, ভূকম্পনগতভাবে সক্রিয় এলাকা এবং উচ্চ বৃষ্টিপাতের কারণে একটি উচ্চ ভূমিধস প্রবণ অঞ্চল…’’
সরাসরি যোশীমঠ থেকে
গত ৮ জানুয়ারি এবং ৯ জানুয়ারি যোশীমঠ ঘুরে এসেছেন বিজয় ভাট। বিজয় একজন বিজ্ঞানকর্মী এবং এই সমস্ত প্রকল্পের ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) সমীক্ষার জন্য লাগাতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে ৯ তারিখ রাত্রে কথা হয়। তিনি বলেন, পরিবেশ কর্মী এবং এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ইআইএ এবং উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষার পদ্ধতি কার্যকর করার দাবি করছেন। তিনি বলেন যে, দীর্ঘদিন ধরে একথা সবার জানা যে, যোশীমঠের অবস্থান সিসমিক জোন-৫-এর উপর। অর্থাৎ এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণতার দিকদিয়ে অনেকটাই সংবেদনশীল। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, ধস নামার এবং তলিয়ে যাওয়ার (subsidence) প্রবণতা এখানে অনেকটাই বেশি হবে। যোশীমঠের কাছে হৃষীকেশ-কর্ণপ্রয়াগ রেল যোগাযোগের জন্য একটি টানেল বা সুড়ঙ্গ তৈরি হচ্ছে। এর জন্য পরিবেশরক্ষার সমস্ত বিধি ভেঙে দিন রাত কাজ চলছে বিস্ফোরক দিয়ে পাথর ভাঙার কাজ। ফলে সমস্ত যোশীমঠ এলাকার ক্ষয় প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
৯ তারিখ রাত্রে কথা হলো একজন সাংবাদিক সত্যম কুমারের সাথে। সত্যম গত ৩ থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যোশীমঠে ছিলেন। সত্যম বলছেন যে, ৩ জানুয়ারি থেকে যোশীমঠের ১ নম্বর ওয়ার্ডে বড়ো ফাটল দেখা দেয়। ৮ তারিখ নাগাদ সমস্ত শহরে এবং গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এই সর্বগ্রাসী ফাটল। তার আরও বক্তব্য হলো, গত ২২ ডিসেম্বর থেকেই যোশীমঠে পাহাড়ের নিচে ফাটল হতে শুরু করে। প্রশাসন তাকে অগ্রাহ্য করে সমস্ত প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যায়। শহরের নাগরিকরা বার বার তার প্রতিবাদ করে, মাঝে মাঝে রাস্তা অবরোধও হয়। কোনো সতর্কতা না নিয়ে প্রকল্পগুলির কাজ চলতে থাকে। ৩ জানুয়ারি যখন শহরের ১নং ওয়ার্ডে ফাটল বোঝা যায় এবং বেশ কিছু মানুষকে ঘর ছাড়তে হয় তখন ৪ জানুয়ারি থেকে কাজ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
সত্যম আরও উল্লেখ করেন যে, সরকার যে ৬৮০টি বাড়ি ধসে যাওয়ার কথা বলছে তা অসত্য। তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৬৮০টি বড়ো বাড়ি ছাড়াও উপজাতি এবং বাল্মীকি সম্প্রদায়ের অনেক ছোটো বাড়ি ধসে গেছে। এঁদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। যা দেখানো হচ্ছে তা সবকিছু বড়ো বাড়ির। যোশীমঠের নগরপালিকা বিজেপি পরিচালিত। গত ৭ জানুয়ারি যোশীমঠের পিডব্লিউডি-র দপ্তরে বড়ো ফাটল দেখা দেয়। ফলে সেই বাড়ি খালি করে দিতে হয়। এর পরই ৮ জানুয়ারি থেকে সংবাদমাধ্যমে এই খবর আসতে থাকে। খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, এখানে সেনাবাহিনীর যে ক্যাম্প আছে তার ঘরগুলিতেও ফাটল দেখা দিয়েছে।
চারধাম প্রকল্পের যে ডিপিআর (ডিটেইলড প্রোজেক্ট রিপোর্ট) তৈরি হয় তাতে পরিষ্কার এই অঞ্চলে বড়ো নির্মাণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়। উল্লেখ করা হয় যে, সড়ক নির্মাণের সময় কোনভাবেই পাহাড়ে ৪৫ শতাংশের বেশি গড়ান (slope) করে কাটা যাবে না। কিন্তু সত্যম বলছেন যে, আকছার ৯০ শতাংশের মতো গড়ান করে পাহাড় কাটার দৃশ্য সবার চোখে পড়বে। ফলে পাহাড়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং দিনে দিনে যোশীমঠের কষ্ট বাড়ছে।
এবারের এই জরুরি পরিস্থিতিতে সরকার তাৎক্ষণিক একটি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করে। এই টিম ৬০০-র বেশি বাড়িকে ভেঙে ফেলে এবং সেই আবর্জনা সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করে। অর্থাৎ বাড়িগুলির আবর্জনা মাটির ওপর যে চাপ ফেলছে তা বহন করার ক্ষমতাও এখানকার ভূমির নেই। ‘গাঁও কানেক্সন’ নামে একটি ওয়েব পত্রিকা ৪ ডিসেম্বর লিখছে যে, এই সমস্ত বিস্ফোরণ এবং নির্মাণ কাজের জন্য যে পরিমাণ ভূমিক্ষয় হচ্ছে তা যোশীমঠের মাটিকে আরও দুর্বল করে ফেলছে। আউলিও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। আউলি-যোশীমঠ রাস্তায় সব থেকে বেশি ফাটল দেখা যাচ্ছে। ‘যোশীমঠ বাঁচাও সঙ্ঘর্ষ সমিতি’ সরকারকে একটি চিঠি দিয়ে বলেছে যে, চারধাম সড়ক প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। এই সংগঠনের মতে এপর্যন্ত প্রায় ২৫,০০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ধস কর্ণপ্রয়াগে।
পরিবেশের অনৈতিক শোষণ
১২,০০০ কোটি টাকার চারধাম রোড প্রকল্পের কাজ অত্যন্ত নৃশংসভাবে হিমালয়কে ক্ষত বিক্ষত করছে। ধর্মীয় উসকানি দিয়ে, বিভিন্ন কৌশলে পরিবেশ অভিঘাত (ইআইএ) সম্পর্কিত কোনো সমীক্ষা না’করে, পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে গায়ের জোরে চারধাম অলওয়েদার সড়ক (Chardham All-weather Road) প্রকল্পের কাজ করছে সরকার। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিগত কয়েক বছর ধরে বারবার এই প্রকল্পের পরিবেশগত কুপ্রভাবের কথা বলে যাচ্ছেন। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এনটিপিসি’র তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্প এবং ধৌলিগঙ্গা নদীর উপর আর একটি প্রকল্প যার নাম বিষ্ণুপ্রয়াগ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
বিগত ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে যোশীমঠের আশেপাশের অঞ্চলে ছোটো ছোটো ফাটল দেখা যায়। তখন থেকে বোঝা যায় যে, এবারের ফাটল আরও ব্যাপক অঞ্চলে হতে চলেছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে কেদারনাথে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল সেখান থেকে সরকার কোনো শিক্ষা নেয়নি।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর দেশের সমস্ত পরিবেশ রক্ষার আইন, অরণ্য রক্ষার আইনগুলিকে ধাপে ধাপে লঘু করেছে এই সরকার। চারধাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের যাতে ইআইএ করতে না হয় তার জন্য এই রাস্তাকে ছোটো ছোটো ভাগ করে দেখানো হয়েছে। সড়ক সহ অন্য প্রকল্পগুলির ছাড়পত্রের জন্য যে অরণ্য নষ্ট করা হয়েছে তার ক্ষতিপুরণের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এটাই স্বাভাবিক যে, সরকারের এই অবিবেচক কাজের ফলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে।