৫৯ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৩ মে, ২০২২ / ২৯ বৈশাখ, ১৪২৯
পলিট ব্যুরো
মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালাবে বাম দলগুলি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। এই চরম মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সমস্ত বামপন্থী দলকে সঙ্গে নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সদ্য সমাপ্ত পলিট ব্যুরো বৈঠকে। এরই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন সম্পূর্ণভাবে বাতিলের জোরালো দাবি তোলা হয়েছে। ১১ েম বুধবার এক বিবৃতিতে একথা জানানোর পাশাপাশি যথেচ্ছ জাতীয় সম্পদ লুট, সাম্প্রদায়িক হিংসা, বুলডোজার রাজনীতি, আধিপত্যবাদের বিস্তারের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। গত ৯-১০ মে এই বৈঠক হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা হোক
দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন বৃদ্ধি নজিরবিহীনভাবে বাড়তি বোঝা হিসাবে চেপে বসেছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। কোটি কোটি মানুষ শিকার হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধির এবং এর ফলে ক্ষুধার যন্ত্রণায় আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে নজিরবিহীন বেকারত্ব মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, গত এক বছরে পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশ, সবজি ২০ শতাংশ, ভোজ্য তেল ২৩ শতাংশ এবং ডাল ৮ শতাংশ। দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য গম, তার দাম এখন কেজি প্রতি ৩৫ টাকা। পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং রান্নার গ্যাসের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিই সামগ্রিকভাবে মুদ্রাস্ফীতির কারণ। সমস্ত পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে সেস/সারচার্জ প্রত্যাহার করুক কেন্দ্রীয় সরকার। গণবণ্টন ব্যবস্থায় গম সরবরাহ চালু করা হোক। মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে অবশ্যই গণবণ্টন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা উচিত।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গোটা দেশে ঐক্যবদ্ধ এবং সমবেত লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলবে সিপিআই(এম)।
জাতীয় সম্পদ লুট
অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন (এনএমপি) প্রবর্তন করে জাতীয় সম্পদ লুটের পথ আরও মসৃণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো পুনরায় জীবন বিমার বেসরকারিকরণের পূর্ণ বিরোধিতা করছে। যেভাবে জীবন বিমার শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার বিরোধিতা করা হয়েছে। প্রায় ২৯ কোটি পলিসি হোল্ডার রয়েছে জীবন বিমার। দেশের স্বার্থ পদদলিত করে উলটে বিদেশি লগ্নিকারীদের তোষণ করতেই শেয়ারের অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে বিক্রি করেছে কেন্দ্র। পলিসি হোল্ডারদের জমা অর্থের বিনিময়ে বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে ওই লগ্নিকারীদের। গোটা দেশে জীবন বিমার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩৮ লক্ষ কোটি টাকা, এক লক্ষেরও বেশি মানুষ কাজ করেন, এজেন্ট আছেন ১৪ লক্ষ।
জীবন বিমার শেয়ারের এই একতরফা অবমূল্যায়নের বিরোধিতা করেছে পলিট ব্যুরো এবং এরই সঙ্গে শেয়ার বিক্রির পরের কিস্তির যাবতীয় উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছে।
মারাত্মক সাম্প্রদায়িক হিংসা
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা একটার পর একটা সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় উদ্বেগের পাশাপাশি সন্তাপও প্রকাশ করেছে পলিট ব্যুরো। প্রত্যকটি ঘটনার পিছনে জঘন্য এক ধরনের ছক কাজ করছে। রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তীর মতো ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে আগ্রাসী সশস্ত্র মিছিল বের করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক হিংসাকে উসকে দিতে। ওইসব সশস্ত্র মিছিলের আগে জ্বালাময়ী বিদ্বেষমূলক ভাষণ দেওয়া হচ্ছে। মুসলিমদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হলেও কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এতেই প্রমাণ হয় যে, বিদ্বেষ এবং হিংসা ছড়ানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতেই।
বিদ্বেষমূলক ভাষণ এবং ধর্মান্ধতা প্রচার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা কার্যত বেসরকারি সশস্ত্র বাহিনী যে উলটে সরকারি মদত পাচ্ছে, তারই সাক্ষ্য বহন করে।
সর্বস্তরের মানুষকে শান্তি বজায় রাখার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে আরও ধারালো করার লক্ষ্যে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো এবং হিংসা ছড়ানোর চক্রান্ত ব্যর্থ করার আহ্বান জানিয়েছে পলিট ব্যুরো।
বুলডোজার রাজনীতির নিন্দা
জাহাঙ্গিরপুরী সহ অন্যান্য এলাকায় বেছে বেছে ধ্বংস অভিযান চালানো হলো যার লক্ষ্যই হলো উত্তেজনা সৃষ্টির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে আরও সুচারু করা। তস্য গরিব এবং শ্রমজীবী পরিবারগুলির আশ্রয়স্থলকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বুলডোজার রাজনীতিতে।
বেআইনি কাঠামো এবং দখলদারিত্ব ধ্বংসের নির্দিষ্ট আইন এবং তার প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু বুলডোজার রাজনীতিতে সেই দায় লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার সাহায্যে জাহাঙ্গিরপুরীর উচ্ছেদ অভিযান রুখে দেওয়া গেলেও দিল্লির বিভিন্ন অঞ্চলে সেই অভিযান চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে যে কোনও ধরনের বেআইনি কাঠামো ভাঙতে গেলে আইনমাফিক উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেই আইনি প্রক্রিয়া কঠোরভাবেই মেনে চলা উচিত। ওইসব মানুষজনের বিকল্প আশ্রয় এবং জীবিকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত না করতে পারলে বন্ধ রাখতে হবে উচ্ছেদ অভিযান।
আধিপত্যবাদের বিস্তার
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সরকারের নিন্দা করার অভিযোগে যেভাবে গুজরাটের নির্দল বিধায়ক জিগনেশ মেওয়ানিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তার নিন্দা করছে পলিট ব্যুরো। এরই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন সম্পূর্ণভাবে বিলোপের দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের পুনর্বিবেচনার আরজিতে সায় না দিয়ে একেবারে প্রত্যাহারের দাবিই জানানো হয়েছে।
আরেকটি বড়ো বিষয় হলো বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সংক্রান্ত রিপোর্ট, যাতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৫০। আগে ছিল ১৪২ এবং ২০১৬ সালে ছিল ১৩৩ স্থানে।
জম্মু-কাশ্মীরের ডিলিমিটেশন কমিশনের সুপারিশ খারিজ করতে হবে
আসন পুনর্গঠন সংক্রান্ত সুপারিশ খারিজের দাবি জানিয়ে পলিট ব্যুরো বলেছে, স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। যার লক্ষ্যই হলো জম্মু-কাশ্মীরের জনসংখ্যাগত বিন্যাসের বদল ঘটানো।
আসন পুনর্গঠন সংক্রান্ত বিন্যাসের ক্ষেত্রে মৌলিক মাপকাঠিই হলো জনসংখ্যা। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে কাশ্মীরের জনসংখ্যা হলো ৬৮ লক্ষ ৯০ হাজার এবং জম্মুতে ৫৩ লক্ষ ৮০ হাজার। নিরপেক্ষভাবে আসন পুনর্গঠন করা হলে কাশ্মীরের আসন হয় ৫১ এবং জম্মুর ৩৯টি। কিন্তু সেখানে ৯০ আসনের বিধানসভায় কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ৪৭ এবং জম্মুর ৪৩টি আসনের সুপারিশ করা হয়েছে।
কোভিড-মৃত্যুতে হু’র তথ্য
ভারতে কোভিডে মৃত্যু নিয়ে হু যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পলিট ব্যুরো। হু ৪৭ লক্ষ কোভিডে মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেছে যা ভারতের সরকারি তথ্যের প্রায় ১০ গুণ বেশি। বহু রাজ্য সরকারিভাবে জানানো মৃত্যু সংখ্যার কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। বিজেপি শাসিত গুজরাট এমন ১০ গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। শুধু মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজের অভিযোগই নয়, একই সঙ্গে নিকৃষ্ট ধরনের তথ্যের প্রতারণাও। গণনা না করে মোদি সরকার মোটেই কোভিডে মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত ক্ষতিপূরণ নির্দেশিকা মেনেই প্রতিটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
সদ্য সমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসের পর এই প্রথমবার পলিট ব্যুরো বৈঠকে বসেছিল। পলিট ব্যুরো সদস্যদের দায়িত্ব এবং কাজের ভাগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে যা ১৮-১৯ জুনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পেশ করা হবে।