E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৩ মে, ২০২২ / ২৯ বৈশাখ, ১৪২৯

জম্মু-কাশ্মীরের ডিলিমিটেশন কমিশনের সুপারিশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে নয়, ভোটের রাজনীতির ফায়দা তুলতেই মেরুকরণের দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্বাচনী জনবিন্যাস বদলে দেবার লক্ষ্যে ৫ মে জম্মু কাশ্মীরের ডিলিমিটেশন কমিশন তার সুপারিশ জমা করল। মূলত ৯০টি বিধানসভা আসন এবং ৫টি লোকসভা আসনের এলাকাগত বিন্যাস সাপেক্ষে এই সুপারিশ প্রকাশ করা হলো। প্রসঙ্গত, মূলত তিন সদস্যের এই কমিশন তৈরি হয় জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর রিঅরগানাইজেশন অ্যাক্ট ২০১৯ অনুযায়ী, যা বিচারাধীন। ডিলিমিটেশন কমিশন ফর জম্মু-কাশ্মীর অ্যান্ড ইউনিয়ন টেরিটরিজ-এর সুপারিশ অনুযায়ী, আসন পুনর্বিন্যাসের পর কাশ্মীরের জন্য ৪৭টি এবং জম্মুর জন্য ৪৩টি বিধানসভা আসন থাকবে। কিন্তু, ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, কাশ্মীরের জনসংখ্যা ৬৮ লক্ষ ৯০ হাজার সেখানে জম্মুর জনসংখ্যা ৫৩ লক্ষ আশি হাজার। তা সত্ত্বেও কমিশন বিধানসভায় কাশ্মীরের জন্য ৪৬ থেকে বাড়িয়ে ৪৭টি এবং জম্মুর জন্য ৩৭ থেকে বাড়িয়ে ৪৩টি আসনের সুপারিশ করেছে। ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা একটা মৌলিক মাপকাঠি হলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই পুনর্বিন্যাস করা হলো বলে মনে করা হচ্ছে। বিরোধীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নাম করে এই সুপারিশগুলি ব্যবহার করে কাশ্মীরের দখলদারি নিশ্চিত করতে চাইছে বিজেপি। বিজেপি’র পরিচিত স্লোগান, ‘এক দেশ এক নিশান’ এখানে কার্যকর করতে চাইছে হিন্দুত্ববাদীরা।

এই সুপারিশের বিরোধিতা করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিজেপি ছাড়া উপত্যকার অন্যান্য সব রাজনৈতিক দল। কমিশনের সুপারিশের ফলে জম্মু কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশের জন্য জম্মুতে থাকবে ৪৮ শতাংশ বিধানসভার আসন আর কাশ্মীরে মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাস করলেও সেখানে থাকবে বিধানসভার মাত্র ৫২ শতাংশ আসন। জনগণনার ভিত্তিতে ন্যায্য পদ্ধতিতে সীমানার পুনর্বিন্যাস করা হলে কাশ্মীরের ৫১টি এবং জম্মুর ৩৯টি আসন পাওয়ার কথা। এপ্রসঙ্গে উপত্যকা জুড়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে একাধিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ। সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে এই ডিলিমিটেশন কমিশনের সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে ডিলিমিটেশন কমিশনের সুপারিশ বাতিলের দাবি জানিয়ে পলিট ব্যুরো বলেছে, এই সুপারিশ নির্লজ্জভাবে অযৌক্তিক ও একপেশে। এই ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচনে জনগণকে দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য বদলে দিতে বাধ্য। এক বিবৃতিতে পার্টি বলেছে, সাংবিধানিকভাবে জম্মু কাশ্মীরের লোকসভা এবং বিধানসভার আসন বৃদ্ধি বা কমানোর কোনো সুযোগ না থাকলেও ডিলিমিটেশন কমিশন সেই সুপারিশ জমা দিয়েছে। ২০০২ সালের ডিলিমিটেশন আইন অনুযায়ী ডিলিমিটেশন কমিশন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ডিলিমিটেশন করা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন ২০১৯ অনুযায়ী, যাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যেই মামলা দায়ের হয়েছে। এই তথাকথিত পুনর্গঠন আইনে জম্মু-কাশ্মীরের ভোটাধিকার আইনকে পরিবর্তন করেছে। আগে জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দাদের শুধু ভোটাধিকার ছিল, এখন তা সকলের জন্য প্রসারিত করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে দীর্ঘমেয়াদিভাবে ক্ষমতাহীন করতে বাধ্য করবে।

বিজেপি’র পক্ষ থেকে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো হলেও বিজেপি’র মত অনুযায়ী জনসংখ্যার সহজলভ্যতা, ভূসংস্থান এবং পৃথক পৃথক জেলার ভূখণ্ড দেখে যে কাজ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তা নিয়ে স্ববিরোধিতা রয়েছে। বিজেপি’র দাবি নিয়ে স্ববিরোধিতার অভিযোগের কারণ হলো, ২০১১ সালের জনসংখ্যার নিরিখে ডিলিমিটেশন হচ্ছে বলা হলেও তা মানা হয়নি।

আবার পূর্বের জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় ২৪ টি আসন ফাঁকা থাকত পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জন্য। তা এবারও অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরের জন্য মোট আসন সংখ্যা হবে ১১৪টি।

ডিলিমিটেশনের এই প্রস্তাবে ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর ফারুক আবদুল্লাহ সহ ৩ জন এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং সহ বিজেপি’র দুজন সই করেছেন। কমিশনকে এবং তার সুপারিশকে আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি। এদিকে প্রস্তাবের বিরোধিতা না করার জন্য ন্যাশনাল কনফারেন্স উপত্যকা জুড়ে সমালোচিত হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, ডিলিমিটেশন প্রসঙ্গে বাইরের কোনো মতামত এবং পরামর্শের ধার ধারেনি এই কমিশন।

এ প্রসঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ৪ বারের সিপিআই(এম) বিধায়ক ইউসুফ তারিগামি সুপারিশের বিরোধিতা করে বলেছেন, ডিলিমিটেশন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত শুধু জম্মু বা কাশ্মীরের জন্য নয়, গোটা জম্মু-কাশ্মীরের জন্যই অপমানজনক। দেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এরকম কোনো নজির নেই। এখানে আগেও কোনো সাংবিধানিক পদ্ধতি চালু করার ক্ষেত্রে জনগণের সামনে সেই বিষয়কে রাখা হয়েছে তাদের মতামত জানানোর জন্য। কিন্তু এবারে মানুষের রায় নেওয়া তো দূর অস্ত মানুষের উপর অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়েছে। তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। একতরফাভাবে এই সুপারিশ কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা মনে করি এই কাজ অসাংবিধানিক।

ডিলিমিটেশন ছাড়া ভোট নয় এবং ভোট না হলে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো হবে না বলে মোদি সরকার যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন তার বিরোধিতায় বিরোধী দলগুলির যুক্তি হলো, আসাম এবং অন্ধপ্রদেশের ক্ষেত্রেও একই সঙ্গে ডিলিমিটেশন কমিশন তৈরি হয়েছে কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় পুরনো জনবিন্যাসের নিরিখে আসামে ভোট হয়েছে সম্প্রতি। তাহলে জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতা কার্যকর হবে না কেন।

আবার উঠে এসেছে অন্ধ্রপ্রদেশের কথাও। অন্ধ্রপ্রদেশ রিঅরগানাইজেশন আইন যখন আনা হয়েছিল এবং তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরি করা হয়েছিল তখন নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিধানসভার প্রস্তাবিত বর্ধিত আসন কখনও পূরণ করা হয়নি।

অন্যদিকে ২০০০ সালে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় একটি প্রস্তাব পাস হয় যে, রাজ্যে পরবর্তী ডিলিমিটেশন হবে ২০২৬ সালে। সে ক্ষেত্রে জনগণনার ভিত্তিতে ২০২১ সালকে ভিত্তি ধরা হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কেন একতরফাভাবে বদল করা হলো তারও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি বিজেপি সরকারের কাছ থেকে।

ডিলিমিটেশন-এর এই প্রক্রিয়া থেকে একটা বিষয় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তা হলো হিন্দুপ্রধান জম্মু এবং মুসলিমপ্রধান কাশ্মীরের মধ্যে বিরোধ আরও তীব্র করতেই এই ডিলিমিটেশন। সেই কারণে ডিলিমিটেশন যুক্তিযুক্ত নয়। বিজেপি মনে করছে, হিন্দুপ্রধান জম্মুতে আসন বাড়িয়ে কাশ্মীরের কাছাকাছি নিয়ে গেলে সেখানে তাদের সরকার বানানো নিশ্চিত। প্রবল ধর্মীয় মেরুকরণের জেরে জম্মুর আসনগুলোতে তারা একতরফাভাবে জিতে যাবে। বিপরীতে কাশ্মীরের আসনগুলোতে বিভাজিত হয়ে যাবে বিরোধী ভোট। তারপরে বিজেপি’র সরকার বানাতে অসুবিধা হবে না। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নাম করে ডিলিমিটেশন-এর মতো বিষয়কে ব্যবহার করে কাশ্মীরের দখলদারি নিশ্চিত করতে চাইছেন তারা।