E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৩ মে, ২০২২ / ২৯ বৈশাখ, ১৪২৯

সকলের জন্য বিদ্যালয় শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে

বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির একাদশ রাজ্য সম্মেলনের আহ্বান


বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির একাদশ রাজ্য সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন বিমান বসু।

বিশেষ সংবাদদাতাঃ শুধু অক্ষর পরিচিতি যথেষ্ট নয়, সামাজিক বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়নে পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক অংশে পৌঁছাতে হবে বিজ্ঞান ভাবনা, যুক্তিবোধ, জনস্বাস্থ্যের মানোন্নয়ন ও বিকল্প সংস্কৃতিকে। তবেই স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে পথ চলতে সক্ষম হবে পিছিয়ে থাকা অংশ। তাই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সাধ্যমতো একাধিক বহুমাত্রিক সাক্ষরতার স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির কর্মী-সংগঠকদের। এই আহ্বান, এই অঙ্গীকার নিয়েই শেষ হয়েছে সমিতির একাদশ রাজ্য সম্মেলন।

পুরুলিয়ার টামনায় বিদ্যাসাগর ফাউন্ডেশন ভবনে (অধ্যাপক আনন্দদেব মুখার্জি নগরের মিনাক মুখার্জি মঞ্চে) ৬ মে থেকে ৮ মে আয়োজিত এই সম্মেলনের সমাপ্তি লগ্নে সমিতির নবনির্বাচিত রাজ্য সভাপতি বিমান বসু বলেন, এই বহুমাত্রিক সাক্ষরতার স্থায়ী কেন্দ্র গড়ার পথে জনশিক্ষা, জনবিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকা উচিত। সামাজিক বৈষম্য, বঞ্চনা দূর করার লক্ষ্য নিয়ে এই যৌথ কাজে বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির দায়িত্ব আজ অনেকখানি বেড়ে গেছে। রাজ্যের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মহল্লায় সাক্ষরতা আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে ধৈর্য্য, সহনশীলতা প্রয়োজন। অভিমুখ স্থির করে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে আমাদের। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় চার শতাধিক স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন পুনর্নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক অনুপ সরকার।

কোভিড পরিস্থিতির কারণে এবং জাতীয় শিক্ষানীতির প্রভাবে স্কুলছুট পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়েছে হু-হু করে। শিক্ষাঙ্গন থেকে হারিয়ে যাওয়া পড়ুয়াদের ফের বিদ্যালয়মুখী করার লক্ষ্য নিয়েই সমিতির এই একাদশ রাজ্য সম্মেলনের আহ্বান ছিল ‘চাই সকলের জন্য বিদ্যালয় শিক্ষার সুনিশ্চিতকরণ’। ১৯৮ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সম্মেলন উদ্বোধন করেন ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কাশীনাথ চ্যাটার্জি। সম্মেলন স্থলে সমিতির পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভাপতি নভেন্দু হোতা। সম্মেলন পরিচালনা করেছেন নভেন্দু হোতা, সাইদুল হক, উৎপল রায় ও শকুন্তলা ঘোষকে নিয়ে গড়া সভাপতিমণ্ডলী।

সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী সম্পাদক অনুপ সরকার। নিরক্ষরতার উৎসমুখ রোধ ও বিদ্যালয় শিক্ষার সুনিশ্চিতিকরণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন উর্বা চৌধুরী।

তিনদিন ব্যাপী এই সম্মেলনে খসড়া প্রতিবেদনের উপর বিশেষ আলোচনায় অংশ নেন মোট ৭৫ জন প্রতিনিধি। সম্মেলন থেকে সভাপতি পদে বিমান বসু, কার্যনির্বাহী সভাপতি পদে নভেন্দু হোতা, রাজ্য সম্পাদক পদে অনুপ সরকার, কোষাধ্যক্ষ পদে গৌতম লাহিড়ী সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। মোট ৬২ জনের রাজ্য কমিটি ও ১৩১ জনের রাজ্য কাউন্সিল গঠন করা হয়।

সম্মেলন মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছেন আদিবাসী শিল্পীরা।

রাজ্যে কোভিড-উত্তর নতুন পরিস্থিতিতে শিক্ষার ওপর নেমে আসা বেনজির আক্রমণের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বিমান বসু বলেছেন, সম্প্রতি শুধু কলকাতায় ৭৯টি আধা-সরকারি স্কুল বন্ধ করা হয়েছে। গত দশ বছরে শুধু কলকাতাতেই জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও স্কুলের আঙিনা থেকে ৮০ হাজার পড়ুয়া হারিয়ে গেছে। শিক্ষাশ্রয়ী সমাজ গড়ার পথে এ এক গভীর সংকট। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির দায়িত্ব অনেকখানি বেড়ে গেল। নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে ষাটের দশকের মধ্যভাগে এরাজ্যে সাক্ষরতা আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। তার পরবর্তী সময়ে সংগঠনের গতিমুখ স্থির হয়েছিল সাক্ষরতা, সচেতনতা, সক্ষমতার স্লোগান দিয়ে। সম্মেলনে জবাবি ভাষণে রাজ্য সম্পাদক অনুপ সরকার বললেন, শুধুমাত্র সামাজিক পরিসরের মধ্যেই কাজ করতে হবে আমাদের। তবেই নতুন নতুন আঙিনা উন্মুক্ত করা যাবে সাক্ষরতা আন্দোলনের জন্য। শুধু নিরক্ষরকে সাক্ষর করার কর্মসূচি দিয়েই নয়,বিজ্ঞান ভাবনা,জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও সচেতনতা গড়ে তোলা, বিকল্প সংস্কৃতির উপাদান মেলে ধরা, সর্বোপরি স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী নির্মাণও করতে হবে এই বহুমাত্রিক সাক্ষরতা আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে।

এর আগে সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে কাশীনাথ চ্যাটার্জি বলেন, ভারতে প্রথম সাক্ষরতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল কেরালার এরনাকুলাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। বাংলা থেকে শিক্ষা নিয়েছে সারা দেশ। কারণ এখানে সমাজের একেবারে নিচু স্তর থেকে শুরু হয়েছিল সাক্ষরতা আন্দোলন। তিনি বলেন, কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ নানা নিরিখেই সমাজজীবনের ওপর এক ভয়ঙ্কর আঘাত নেমে এসেছে। এরসঙ্গেই নতুন শিক্ষানীতি শিক্ষাঙ্গন থেকে বহু পড়ুয়াকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একসময় সাক্ষরতা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেওয়া পশ্চিমবঙ্গকে আজ বাড়তি দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। জোর দিতে হবে কমিউনিটি লার্নিংয়ের ওপর।

নিরক্ষরতার উৎসমুখ রোধ ও বিদ্যালয় শিক্ষার সুনিশ্চিতকরণ, প্রসঙ্গ সক্ষমতা ও স্বনির্ভরশীলতা, বহুমাত্রিক সাক্ষরতা আন্দোলন ও সংগঠন, সচেতনতা ও সাক্ষরতা প্রসঙ্গ এবং জনস্বাস্থ্য আন্দোলন ও সাক্ষরতা - এই পাঁচটি বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিরা। রাজ্যের ১৫টি জেলায় ইউনিট, আঞ্চলিক ও জেলা স্তরের সাংগঠনিক সম্মেলন প্রক্রিয়া শেষে এই রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন চলাকালীন প্রতিনিধিদের এক অংশ পুরুলিয়ারই শবর অধ্যুষিত ও আদিবাসী অধ্যুষিত প্রান্তিক গ্রামে সমীক্ষার কাজে নেমেছিলেন। শিক্ষার মান ও অন্যান্য মানব সম্পদ উন্নয়নের সূচকে গ্রামের মানুষদের নিয়ে সমীক্ষা হয়। বিদ্যাসাগর আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এই তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনকে ঘিরে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মেতেছিলেন।