E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৯ সংখ্যা / ১৩ মে, ২০২২ / ২৯ বৈশাখ, ১৪২৯

১৯ মে বরাক উপত্যকার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন স্মরণে


১৯৬১ সালের ১৯ মে-র ১১ ভাষা শহিদ।

বিশেষ সংবাদদাতাঃ বর্তমানের এই পঙ্কিল সময়েও প্রতিবাদী ও আশাবাদী মানুষ আজ ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন মেখে সমাজের কথা, সমাজ পরিবর্তনের কথা ভাবেন এবং লড়াই-আন্দোলনের বহুমুখী ধারায় শামিল হন। তাঁদের নিশ্চিতভাবেই মনে পড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে’র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের কথা। ১৯৫২-র মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। গোটা বিশ্বের মানুষ এই শহিদ দিবসকে ভাষা-অধিকারের জন্য শপথ দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন ২০০০ সাল থেকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ১৯৫২’র ৭০ বছর পরেও মাতৃভাষা পূর্ণভাবে সর্বত্র কার্যকর হয়নি।

আজকের ভাষা ও সংস্কৃতি সচেতন মানুষ, বিশেষকরে বাংলাভাষী যাঁরা ২১শের ঐতিহ্যে ঋদ্ধ, তাঁরা ১৯ মে’র আসামের বরাক উপত্যকার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের কথা জানেন। এই আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১১ জন ভাষাব্রতী শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

অনেকেরই জানা যে, ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে ‘ভাগ কর আর শাসন কর’ নীতিতে নানাভাবে ও নানা কারণে রাজ্য ও রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তন করেছে। তেমনভাবেই একদিন (১৮৭৪ সালে) সিলেট বা শ্রীহট্ট জেলাকে বাংলা বিভাগ থেকে কেটে আসামে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শ্রীহট্টে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই প্রতিবাদ প্রশমিত করার জন্য তদানীন্তন ভারতের বড়োলাট নর্থব্রুক শ্রীহট্টে ছুটে এসেছিলেন।

ব্রিটিশ সরকার নবগঠিত আসাম যাতে এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাজ্য হিসাবে গড়ে উঠতে না পারে তার জন্য আসামকে দুটি উপত্যকায় ভাগ করে। এই দুই উপত্যকার নাম ছিল আসাম উপত্যকা ও সুরমা উপত্যকা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নিয়ে আসাম উপত্যকা গঠিত হয়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর অভিনব পন্থায় শ্রীহট্টকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হয়। দেশ ভাগের পরপরেই সিলেট কোনদিকে থাকবে - ভারতে না পাকিস্তানে এই প্রশ্নে যে গণভোট হয়, তাতে দেখা যায় অন্যায়ভাবে শ্রীহট্টকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হয়। এই গণভোটে ৫২৭৮০ ভোটে শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই শ্রীহট্ট জেলায় তখন প্রায় আড়াইলক্ষ চা শ্রমিক ছিলেন যাঁরা আসাম বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। পার্লামেন্টের নির্বাচনেও ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীহট্টের গণভোটের সময়ে সেখানকার চা শ্রমিকদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়নি। চা শ্রমিকদের ভোটের অধিকার দেওয়ার জন্য কংগ্রেসীদের কোনো উদ্যোগ ছিলনা। যদিও তখন আসামে কংগ্রেস সরকার শাসন ক্ষমতায় ছিল। তখন নানা সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজ্যে বিরামহীনভাবে চলেছে ক্ষমতার দখল নিয়ে কংগ্রেস দলের আত্মকলহ।

এরপর নানা ঘটনার আবর্তে আসামে মুখ্যমন্ত্রী হন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রিয় নেতা বিমলা প্রসাদ চালিহা। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিষ্ণুরাম মেধি। তিনি নানা কারণে নেহরুর বিরাগভাজন হন। বদরপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়লাভ করার পর বিমলা প্রসাদ চালিহা আসামের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে আসীন হলে বিষ্ণুরাম মেধিকে মাদ্রাজের রাজ্যপাল করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি চলে গেলেও তাঁর অনুগামীদের প্রাধান্য ছিল প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে। ১৯৬০ সালের ২২ এপ্রিল প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভায় অসমিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র রাজ্য ভাষা করার প্রস্তাব করা হয়। ২৪ অক্টোবর সেই প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সংগ্রাম কমিটির ডাকে গোটা কাছাড় জেলা জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকারীরা ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর,করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং শুরু করে। এই আন্দোলন দমন করতে শিলচরে রেলওয়ে স্টেশনে আন্দোলনকারীদের উপর নির্মমভাবে গুলি চালায় পুলিশ। এই গুলিচালনার ফলে ঘটনাস্থলেই ৯ জনের মৃত্যু হয়। পরে মৃত্যু হয় আরও ২ জনের। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হন ১১ জন।

সেই মহান শহিদেরা হলেন কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্রনাথ পাল, সুনীল সরকার, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, সুকমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তরণী দেবনাথ। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে বরাক উপত্যকার সর্বত্র যেমন লাগাতার কার্ফু অগ্রাহ্য করে চলে হাজার হাজার সত্যাগ্রহীর প্রভাত ফেরি, প্রতিবাদ সমাবেশ, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির শিলচর কমিটি এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জনগণকে আবেদন করে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে ৭ দিন কালোব্যাজ ধারণ করতে হবে; ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড্ডীন রাখতে হবে; শহিদ দিবস উদযাপনের একটি তারিখ নির্দিষ্ট করে নিয়ে সেদিন হরতাল, অরন্ধন, উপোস ও মৌন শোভাযাত্রায় শামিল হতে হবে; দমন-পীড়ন নীতির প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে এবং সঠিক স্বাধীনতা দিতে হবে।

কেবল ১৯৬১’র এই শহিদেরাই নন, এই রক্ত স্রোত সারা আসামে নানাভাবে বইতে থাকে। ভাষার অধিকারের প্রশ্নে এর পরেও শহিদ হন। ভাষা আন্দোলনের ১২তম শহিদ বিজন চক্রবর্তী (বাচ্চু) প্রাণ দেন ১৭ই আগস্ট ১৯৭২। তিনি যুব ফেডারেশনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরপর ১৯৮৬’র ২১ জুলাই প্রাণ দেন দিব্যেন্দু দাস (যিশু) (১৩তম) ও জগন্ময় দেব (জগন) ১৪তম শহিদ। বরাকের সর্বজনস্বীকৃত ১৫তম শহিদ হলেন সুদেষ্ণা সিংহ। তিনি মুখ্যত অসমিয়া ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিষ্ণুপুরী মণিপুরি ভাষার অধিকারের আন্দোলনে প্রাণ দেন ১৯৯৬-এর ১৬ মার্চ বরাকের কলকলিঘাট স্টেশনে। এই ১৫জন শহিদের প্রতি কেবল বরাক উপত্যকার মানুষরাই নন, দেশ তথা বিশ্ববঙ্গভাষীরা আজও মাথানত করেন, আর তাঁদের ত্যাগ ও আত্মবলিদান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চেষ্টা করেন।

শিলচর স্টেশনে ভাষা শহিদ স্মারক।

একথা অনেকেরই জানা, ১৯৬০-৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালে রাজ্য ভাষা আইন সংশোধন করে যে আইনি ব্যবস্থা গৃহীত হয় তাতে অবিভক্ত কাছাড় জেলায় (বর্তমানে কাছাড়,করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলার সমন্বয়ে বরাক উপত্যকা নামে পরিচিত) সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা। এই সংশোধিত আসাম রাজ্য ভাষা আইন অনুসারে এই অঞ্চলে সমস্ত সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়। ১৯৬১ সালের সংশোধিত আসাম রাজ্য ভাষা আইনের ৫ নং ধারায় (Safeguard of the use of Bengali Language in the District of Cachar) পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে - ‘‘Without prejudice to the provisions contained in Section 3, the Bengali language shall be used for administrative and other official purpose upto and including district level in the district of Cachar.’’

একইভাবে ২৪ জুলাই, ১৯৬৪ সালে ঘোষিত সরকারি বিজ্ঞপ্তি (No.PLB. 19/63/146, dated 24 July 1964) অনুসারে অবিভক্ত কাছাড় জেলায় সব সরকারি কাজকর্মে, জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে বাংলা ভাষা ব্যবহার সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে - ‘‘In exercise of the powers conferred by Sub Section 3 of Section 1 of the Assam Official language Act,1960,the Governor of Assam is pleased to appoint the 1st August,1964 as the date on which the Assamese Language in the Brahmaputra Valley Districts and Bengali Language in Cacher District shall be used for all official purposes at the levels of Anchalik Panchayet, Development Blocks and Sub- Deputy Collectors' Circle while communicating with public and others of the same level.

এই বরাক উপত্যকায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, বরাক উপত্যকায় সংশোধিত সেই রাজ্যভাষা আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি নির্দেশিকা, প্রপত্র, নিয়মাবলি, বিজ্ঞাপন, হোর্ডিং ইত্যাদিতে, নিযুক্তির পরীক্ষায় এবং সরকারি ও প্রশাসনিক কাজকর্মে ভাষা আইন লঙ্ঘন করার প্রবণতা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই অপচেষ্টা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। এভাবে বরাক উপত্যকায় ১৯ মে’র ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য, ভাষার অধিকার খর্ব করার কৌশলী প্রয়াস চলছে। লক্ষ করা যাচ্ছে, এই আইন প্রয়োগের দাবি তুললেই ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার নামে সুপ্রিম কোর্টে এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) পুনরায় পরীক্ষার আরজি জানানোর মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু,বিশেষত মুসলিমদের উপর নতুন করে আক্রমণের ছক কষা হচ্ছে। এই আক্রমণ আগামীদিনে সমাজের অন্যান্য অংশ, এমনকী বাংলাভাষী হিন্দুদের উপরেও নেমে আসার আশংকা ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। একই সঙ্গে সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে ধর্মের নামে বিভাজনের সুড়সুড়ি দিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলার অপচেষ্টা চলছে। এমনই একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে ১৯ মে’র ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শানিত করে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় সমস্ত প্রতিক্রিয়ার চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্যকভাবেই দেখা দিয়েছে।