৫৮ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা / ১৩ নভেম্বর ২০২০ / ২৭ কার্ত্তিক ১৪২৭
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা সফল হলো
প্রকাশ কারাত
সম্প্রতি ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে যে ‘‘বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট’’ (BECA) স্বাক্ষরিত হয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পেন্টাগনের কাছে অত্যন্ত স্বস্তির কারণ। গত তিন দশক আগে ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক সহযোগী হিসেবে পরিণত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা গত ২৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মাধ্যমে পূর্ণতা পেল। তথাকথিত বুনিয়াদি চুক্তিগুলির মধ্যে এটি ছিল শেষ চুক্তি। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের প্রধান অ্যাডমিরাল কিকলাইটারের ভারত সফরের মাধ্যমে এই ভারত-মার্কিন সামরিক বোঝাপড়ার সূত্রপাত হয়। ১৯৯২ সালে নরসিমা রাও-এর সরকারের সময় প্রথম ‘‘ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার ভিত্তি প্রস্তুত করার জন্য’’ একটি সামরিক স্টিয়ারিং কমিটি তৈরি করা হয়। সেই বছর থেকেই পশ্চিম উপকূলে শুরু হয় নৌবাহিনীর ‘মালাবার মহড়া’।
এরপর থেকেই ভারতের প্রতিটি সরকারকে মার্কিন প্রশাসন এশিয়াতে মার্কিনীদের সামরিক সহযোগিতা করতে উৎসাহিত করেছে। ১৯৯৫ সালে নরসিমা রাও-এর সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে (Agreed Minutes on Defence Cooperation)। এরই সূত্র ধরে ২০০২ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত হয় General Security of Military Information Agreement (GSOMIA)। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা বজায় রাখতে দায়বদ্ধ যা কিনা পরবর্তীতে দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তির হস্তান্তর এবং গোপনীয় বার্তা আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে বাড়তি ভরসা জোগাতে সহায়তা করে।
২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে ২০০৫ সালের জুন মাসে Defence Framework Agreement-এ স্বাক্ষর করেন। ভারত-মার্কিন সামরিক সহযোগিতা বাড়তি মাত্রা পায়। পরবর্তীকালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতামূলক এবং সামুদ্রিক সুরক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় চুক্তি এই ‘ডিফেন্স ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’-র ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। এই চুক্তির সময়সীমা ছিল ১০ বছর এবং ২০১৫ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদী সরকার এই চুক্তির পুনর্নবীকরণ করে।
এর সূত্র ধরেই ভারত-মার্কিন সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ককে মজবুত করতে অসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর বিরোধিতা করে সিপিআই(এম)সহ বামপন্থী দলগুলো এবং এই ইস্যুতেই ২০০৮ সালে প্রথম ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে বাম দলগুলো।
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা ও স্ট্র্যাটেজিক বোঝাপড়া আরও বৃদ্ধি করতে মোদী সরকার যারপরনাই উদগ্রীব। এই সরকার তিনটি বুনিয়াদি চুক্তি [LEMOA (২০১৬), COMCASA (২০১৮) এবং BECA (২০২০)] সই করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরের সময় “Joint Strategic Vision for Asia-Pacific and Indian Ocean Region” চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে এ কাজে আরও গতি আসে এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণমাত্রার স্ট্র্যাটেজিক সহযোগী হিসেবে ভারত আত্মপ্রকাশ করে।২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় জোট বা কোয়াড পূর্ণাঙ্গ সামরিক সহযোগিতা শুরু করে।
২০০২ সালের অক্টোবর মাসে পেন্টাগন বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে ভারত মার্কিন সামরিক সম্পর্ক বিষয়ক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। “Indo-US Military Relationship: Expectations and Perceptions” শীর্ষক এই রিপোর্টের উপসংহারে লেখা হয়; ‘‘২০২০ সালে আমরা এমন এক সহযোগী চাই যারা মার্কিন সামরিক শক্তিকে চীনের বিপদ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। আমরা নিঃসন্দেহ যে, চীনের প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসেবে ভারত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।’’ ২০২০ সালের এই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরের বেশকিছু কারণের দরুন ভারতকে কেন্দ্র করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা সফল হয়েছে। ভারতের শাসকশ্রেণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্ট্র্যাটেজিক মৈত্রীকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করতে শুরু করে। ১৯৯১-৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের সময় থেকেই দেশের শাসকশ্রেণির এই অবস্থানগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পর্বে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথ থেকেই সরে আসা, অর্থনীতির উদারীকরণ ও নয়া-উদারবাদের পথ গ্রহণ করা এবং আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদের উত্থান লক্ষ করা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্ট্র্যাটেজিক বোঝাপড়া এভাবে অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। সেহেতু নরসিমা রাও-এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার থেকে বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার এবং মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার থেকে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার - সকলেই শাসক শ্রেণির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে স্ট্র্যাটেজিক বোঝাপড়া করবার নীতিকেই বলবৎ করেছে। তবে পার্থক্য এখানেই যে, বিজেপি যখন সরকারে থেকেছে তখন তারা সাম্রাজ্যবাদের প্রতি বেশি আনুগত্য এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ থাকবার জন্য বাড়তি উৎসাহ দেখিয়েছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক বোঝাপড়া আমাদের দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী, স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র, মিডিয়া এবং অন্যান্য প্রভাবশালী অংশকে খুশি করেছে। এদের মধ্যে যে অংশ অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল তারাও একথা বলছে যে, সীমান্তে চীনের আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের এহেন অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু পরিস্থিতির নিবিড় পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, বিষয়টি এইরকম নয়।
চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই ভারত-মার্কিন সামরিক সম্পর্ক মজবুত করার প্রতিটি পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। ২০১৭ সালে ডোকলামে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা লক্ষ করা যায়। কিন্তু তার আগেই ২০১৬ সালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তি ‘Logistics Supply Agreement (LEMOA)’ স্বাক্ষরিত হয়।
জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা ঘটবার আগে এবং সাম্প্রতিক সীমান্ত সমস্যার আগেই ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তি BECA সংক্রান্ত কথাবার্তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্পের ভারত সফরের সময়ে যৌথবার্তায় বলা হয়েছেঃ ‘‘সামরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিগুলি যার অন্যতম Basic Exchange and Cooperation Agreement, সেগুলি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতারাই ভূমিকা পালন করবেন।’’
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলি ক্রমশ সামনে চলে আসছে।অতীতে দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রীপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক (২+২) বৈঠক বিদেশ ও বাণিজ্য দপ্তরের মন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো। ২০১৭ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদীর কাছে প্রস্তাব দেন যে, বাণিজ্যমন্ত্রকের বদলে প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রীদের এই বৈঠকে বসানো হোক। বাণিজ্য এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে এইভাবে গুরুত্বহীন করে দিয়ে সামরিক ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে ভারতের শেষ যে দ্বিপাক্ষিক (২+২) বৈঠক হয়েছে সেখানে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন যে নেতিবাচক পদক্ষেপগুলি নিয়েছে অর্থাৎ ভারতীয় পণ্যকে বিশেষ সুবিধা না দেওয়া এবং H1B ভিসার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জারি করার বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।
মোদী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই সামরিক সম্পর্ক তৈরি করেছে যা কিনা মার্কিনী নেতারা বারেবারেই চীনের বিরুদ্ধে পরিচালিত বলে উল্লেখ করেছেন। আর চতুর্দেশীয় জোট ‘কোয়াড’-এর সামরিক চরিত্র সম্পর্কে কোনরকম রাখঢাক করেনি মার্কিন প্রশাসন।
১৯৯১-৯২ এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কালপর্ব যে সময়ে নয়া-উদারবাদী নীতি সূচনা হয়, হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান ঘটে (বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়) এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে স্ট্র্যাটেজিক ও সামরিক বোঝাপড়া শুরু হয়। মোদীর রাজত্বে এই ত্রিবিধ প্রবণতা শীর্ষে পৌঁছেছে।
গত ২০অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব মার্ক টি এসপার ভারতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করবার আগে আটলান্টিক কাউন্সিলের সামনে বলেনঃ ‘‘এই শতাব্দীতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হয়ে উঠবে।’’ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সহযোগী হয়ে উঠে মোদী সরকার ভারতের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছেন।