E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা / ১৩ নভেম্বর ২০২০ / ২৭ কার্ত্তিক ১৪২৭

সোচ্চার চিন্তা

‘‘মার ঝাড়ু, মার, ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর!’’

পল্লব সেনগুপ্ত


পাড়ার গলিতে ইট দিয়ে উইকেট সা‍‌জিয়ে ছোটোবেলায় আমরা যখন ক্রিকেট খেলতুম, তখন মা‍‌ঝে-মা‍‌ঝেই ঝগড়া বেধে যেত আউট হয়েছে, কি আউট হয়নি - তাই নিয়ে। অধিকাংশ সময়েই ব্যাপারটা ঝগড়ার মধ্যেই থেকে যেত, মারপিট অবধি বিশেষ গড়াতো না। তবে ফয়সালার জন্য প্রায় ক্ষেত্রে আমরা আমাদের সেই ‘ইডেন’ গলির মুখের বাবুদার চা‌য়ের দোকানে বসা কোনো না কোনো কাকু বা জেঠুর (যিনি বেকার থাকার কারণে বাড়ির গঞ্জনা এড়াতে ওখানেই বেশির ভাগ সময়টা কাটাতেন) শরণ নিতুম - ক্যাচটা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা, কিংবা রবারের বলটা উইকেট - ওরফে ইটের পাঁজার কান ছুঁয়েছে কিনা, সেই ফয়সালার জন্য।

তো, এতকাল পার, এই বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে মহামান্য ট্রাম্প সাহে‍বের কাণ্ড-কারখানার খবর পড়ে এবং শুনে সেই বাল্যস্মৃতি আবার ডলফিনের মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল! আমরা যেমন চেঁচাতুম ‘‘দিস ক্যাচ, নট ক্যাচ’’ কিংবা ‘‘দিস টাচ, নো টাচ’’ ব‍‌লে (ক্রিকেট তো! - তা সে যত দীন ভাবেই খেলা হোক না কেন, ইংরে‍‌জিতে ঝগড়া না করলে মান থাকে না কি!) - আর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মতোই ঝন্টু কাকা কি নেপাল জেঠু বা বগা দা ‘হ্যাঁ’ ‘‘না’’ বলে রায় দিতেন ঠিক তেমনভাবেই ‘‘গোমাতা-পরাভব’’ (গো-হারা হওয়ার সংস্কৃতায়ন আর কি! বিজেপি-র রাজত্যি তো!) সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প সাব্‌জি হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচাচ্ছেন ‘‘হারি নি, হারি নি - আমি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে জেতা গ্যারান্টি করব কিন্তু!!’’ ট্রাম্পের এমন ছিঁচকাঁদুনে ‘‘ও পিসিমা ও রাঙাদিদা গো’’ - মার্কা বাহানা শুনে ওটাকে আবার শিশুসুলভ বায়না বলে ভাববেন না কিন্তু!...এমনটা যে হবেই, এটা গত চার বছরে সাড়ে চার হাজারবার মিথ্যে বলা - ধেড়ে খোকাটা বুঝেই ছিলেন। তাই তো, সমস্ত নিয়ম‍‌-টিয়মকে ‘বগ্‌ দেখিয়ে’ নির্বাচন শুরু হবার ক’দিন আগেই নিজের সাঁটের একজন ভদ্রমহিলাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদে নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন উনি। ইংল্যান্ডের কোনো এক সাংবাদিক ট্রাম্পের এখনকার এই ‘ছিট্‌কলামি’ (বা ‘ভিট্‌কলামি) কথাবার্তাকে ভদ্রভাবে ‘‘ইনফ্যান্টাইল ডিজ্‌-অর্ডার’’ (অর্থাৎ, শিশুসুলভ পাগলামি) বলেছেন বটে, তবে পাগলামি যদি হয়ও, তাহলেও সেটার একটা সাজানো-গোছানো পদ্ধতি আছে! যাকে বলে, ‘‘মেথড ইন ম্যাড‍‌নেস!!’’

।। দুই ।।

আমেরিকার ইতিহাসে ভোটের রায় নিয়ে আইনি কুস্তি এর আগেও হয়েছে। তবে এইভাবে ‘‘হাম নেহি ছোড়েঙ্গে’’ - টাইপের গান শুনিয়ে এর আগে কোনো প্রেসিডেন্ট লোক হাসান নি, কেবল একবার ছাড়া। ইতিহাসের বইপত্তরের ধুলো ঝেড়ে যা আবিষ্কার করা গেল, তা হচ্ছে - একবার, মাত্র একবারই পরাজিত প্রেসিডেন্ট এমনটা করেছিলেন। তবে তার পরিণামে তাঁর যা হাল হয়েছিল, তা জান‍‌লে সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের বিখ্যাত সেই ‘‘রামগরুড়ের ছানা’’-ও না হেসে থাকতে পারবে না! ...মা‍‌র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ট্রাম্পের মতোই ডাহা হেরে গিয়েও গদি আঁকড়ে বসে থাকার বায়না ধরেছিলেন। বিজয়ী প্রার্থী টমাস জেফারসনকে গণতন্ত্রের রীতিনিয়ম অনুযায়ী পরের বছরের ৪ঠা মার্চ (তখন, এখনকার মতো ২০ জানুয়ারিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পদ্ধতি চালু হয়নি) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হস্তান্তর করার বদলে, জন অ্যাডামস সপরিবারে এবং ব্যক্তিগত কর্মচারীবৃন্দ সহ হোয়াইট হাউসেই গ্যাঁট হয়ে বসেছিলেন। তখন, প্রধান বিচারপতি জেফারসনকে শপথ নেওয়াচ্ছেন একদিকে, অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের সরকারি কর্মচারীরা অ্যাডামসের ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের যাবতীয় ব্যবহার্য জিনিস - পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে নিজস্ব সমস্ত কিছু বিভিন্ন ঘর থেকে নিয়ে এসে ডাঁই করে রাখছেন হোয়াইট হাউসের বিশাল প্রাঙ্গণে। জন অ্যাডামস নিষেধ করতে গেলে, কেউ তাতে কান দেন নি এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তাও বলেননি! নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে ফেলে রেখে সবাই চ‍‌লে যান নতুন প্রেসিডেন্ট জেফারসনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। এমনকি অ্যাডামস যখন ম্লান মুখে ভাড়াগাড়ি ডেকে সমস্ত মালপত্তর নিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিজন সহ রওনা হচ্ছেন - তখনও প্রথানুযায়ী তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়নি প্রাসাদরক্ষী সৈন্যদের পক্ষ থেকে!

ট্রাম্প য‍‌দি ২১৯ বছরের পুরোনো সেই কুনাট্যের পুনরাভিনয় চান আগামী ২০ জানুয়ারি, তাহলে তিনি মানে-মানে বিদায় না নিয়ে গ্যাঁট হয়েই বসে থাকবেন হোয়াইট হাউসে। এবং অ্যাডামসের মতোই প্রায় গলা ধাক্কা খেয়ে বিতাড়িত হবেন।

এর ফলে, আরও অনেকগুলো ব্যাপার ঘটবে মার্কিনি শাসনব্যবস্থার রীতি মাফিকঃ (এক) দেশের সেনাবাহিনী, পেন্টাগন, এফবিআই, সিআইএ, পদস্থ কেন্দ্রীয় আধিকারিকরা, হোয়াইট হাউসের সমস্ত কর্মচারী তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ নেবেন না; জোর করে নির্দেশ দিলেও অগ্রাহ্য করবেন; অ্যাটর্নি জেনারেল কোনো বিষয়ে পরামর্শ করবেন না; এবং সামান্য কিছু নিরাপত্তারক্ষী ‘প্রাক্তন’ রাষ্ট্রপতির পাহারায় থাকবেন শুধু। অ্যাডামসের চেয়ে একটা ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর কম হেনস্থা হবে - বিমান বাহিনীর একটি ছোটো স্কোয়াড্রন তাঁকে শেষবারের মতো সম্মান জানাবে বিদায় নিতে বাধ্য হবার ঐতিহাসিক (!) মুহূর্তে!! এবং পরমুহূর্ত থেকেই মার্কিন দেশের এবং সারা বিশ্বের নির্লজ্জতম রাষ্ট্রনায়ক ‘হিরো’ থেকে ‘জিরো’ হয়ে যাবেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বারাক ওবামা যে সম্মানটা পান ওদেশে দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে, সেটা তাঁর ক্ষেত্রে যে জুটবে না, এ‍‌ তো বলাইবাহুল্য। তার কারণ তাঁর আগে আর কোনো রাষ্ট্রপতিই ও দেশের মানুষকে এভাবে বিভক্ত করে ফেলেননি।

।। তিন ।।

কিন্তু পুরনো দিনের ‘আলিবাবা’ ফিলিমের সেই ‘‘মার ঝাড়ু, মার ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর’’ গান গেয়ে ট্রাম্পকে না হয় কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়াল মার্কিনি জনগণ, তাতে আমাদের ভালোমন্দ কতটা কী হবে, সেই প্রশ্নও তো এবার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। একথা ঠিকই যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সর্বদোষসম্পন্ন কাউকে আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের তালিকায় হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অনেক কিছু প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও, বিডেন এবং ট্রাম্পের মধ্যে প্রথমজনই যে বেশি গ্রহণযোগ্য - এইটা অধিকাংশ আমেরিকানই বুঝেছেন। কেন গ্রহণযোগ্য, তার মূল কারণ হলো এই ক’টিঃ

১) ‘কোভিড-১৯’-এর সংক্রমণের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন এবং স্বয়ং ট্রাম্পও ওই ভূমারীর বিষয়ে গুরুত্ব দেন নি। বরং, সে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ যাঁরা করেছেন তাঁদেরকে নিজের চেলাচামুণ্ডাবৃন্দ সমেত বিদ্রূপ করেছেন। সেই লক্ষ লক্ষ মৃত মানুষের আপনজনদের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের ঝড় ট্রাম্পকে টলোমলো করে দিয়েছে।

২) ট্রাম্পের আমলে আবার সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠেছে - সরকারিভাবে বর্ণবৈষম্যকে মুখে স্বীকার না করলেও, বস্তুতপক্ষে সেটা উত্তরোত্তর ব্যাপক হয়ে উঠেছে। ফলে, সমীক্ষা অনুযায়ী ‘ব্ল্যাক আমেরিকান’দের ৮৭শতাংশ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।

৩) পরিবেশ-দূষণ সম্পর্কে ট্রাম্পের অবৈজ্ঞানিক মূর্খতার ফলে আগামীদিনে গোটা দে‍‌শের নাগরিকরাই - বিশেষত কলকারখানা অঞ্চলের মানুষেরা বিপন্ন হতে চ‍‌লেছেন যে, এটা শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটাররা বুঝেছেন এবং ট্রাম্পকে তাড়াতে কৃতসংকল্প হয়েছেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, শহরাঞ্চলে - যেখানে দু-লক্ষের বেশি ভোটার সেখানে, ১৬১টি কাউন্টির (অনেকটা আমাদের দেশের ‘ব্লক’-এর মতো) মধ্যে ১২৭টি বিডেন জিতেছেন। ট্রাম্পের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে প্রধানত গ্রামে এবং গ্রাম-ঘেঁষা শহরতলী অঞ্চলে, যেখানে পরিবেশ দূষণের সমস্যা কম। তাছাড়াও গা-জোয়ারি করে ‘প্যারিস-পরিবেশ চুক্তি’ (যার সদস্য পৃথিবীর ১৭৪টি দেশ) থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে আসাটাও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা অপছন্দ করেছেন। কারণ, তাঁদের বৃহদংশই ট্রাম্পের মতো বিজ্ঞান-বিরোধী নির্বোধ নন।

৪) পক্ষান্তরে, বিডেন যে আশ্বাস দিয়েছেন শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার তিনি ফিরিয়ে দেবেন (ট্রাম্প যা কেড়ে নিয়েছিলেন) - এটা শহুরে শ্রমজীবীদেরকে তাঁর পিছনে সংহত করেছে।

৫) উদারপন্থী সাধারণ মানুষেরা ট্রাম্পের মতো মুসলিমবিদ্বেষী নন এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় আসাটা তিনি যেভাবে বন্ধ করেছেন, সেটাও তাঁরা ঘোর অপছন্দ করেছেন। বি‍‌ডেন এখানেও তাঁদের কাছে বেশি পছন্দসই বলে গণ্য হয়েছেন।

৬) ট্যাক্স-সংক্রান্ত নানা বিধান ট্রাম্পের এই চারটে বছরে যা চালু হয়েছে তাতে কর্পোরেট হাউসগুলি, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলি এবং সাধারণভাবে ইংরাজিতে যাঁদেরকে বোঝানো হয় ‘স্টিংকিং রিচ’ (অর্থাৎ, সঞ্চিত অপরিমিত বিত্তের দুর্গন্ধ যাদের গায়ে!) - তাঁরা বিপুলভাবে লাভবান হয়েছেন; মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, ছোটো ব্যবসায়ীরা হয়েছেন উত্তরোত্তর বিপন্ন। এটাও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গেছে।

৭) এইচ ১-বি ভিসার ব্যাপারে কড়াকড়ি করে ট্রাম্প দেশের লোককে ধাপ্পা দিতে চেয়েছিলেন যে, এর ফলে খাস মার্কিনীদের কর্মসংস্থান উছ্‌লে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছে? বিদেশের মেধাবী টেকনোলজিস্টরা যেভাবে মার্কিন অর্থনীতির বনেদ শক্ত করেছে দীর্ঘদিন ধরে, হঠাৎ তাদের ক্ষেত্রে এই কড়াকড়ির ফলে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দ্রুত অবক্ষয় ঘটেছে। এই সূত্রেই, উগ্র কমিউনিস্ট-বিরোধী মনোভাবের জন্য চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ করে, ট্রাম্প বস্তুতপক্ষে মার্কিন বৈদেশিক বাণিজ্যের গোড়ায় কুড়ুল মেরেছেন - যার ফল দেশের মানুষ ভুগছে।

এইসব বড়োসড়ো কারণ ছাড়াও, ছোটোখাটো আরও নানা ব্যাপারে মানুষ ট্রাম্পের ওপর বিরক্ত হয়েছেন। ছোটোবড়ো - এই সমস্ত কিছু কারণের সমাহারেই তেনার পতন হলো।

।। চার ।।

এখানে দু’টো প্রশ্ন উঠে আসবে। প্রথমত, এতসব সত্ত্বেও রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প এত ভোট পেলেন কীভাবে? দ্বিতীয়ত, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বিডেন জেতায়, ভারতের মানুষের লাভ বা ক্ষতি কিসে? পরপর উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।

প্রথম কথা, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে রক্ষণশীল, মধ্যপন্থী এবং উদারপন্থী তিনটি গোষ্ঠীই আছে। উদারপন্থীরা সেভাবে কমিউনিজম, সোশ্যালিজমের নামে আঁতকে ওঠে না। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রথম সারির নেতারা অনেকেই এঁদের মধ্যে আছেন। এটাকেই ধরে ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টি - ‘বিডেন জিতলে চীন জিতবে’ আমেরিকা কমিউনিস্ট হয়ে যাবে এই সব হেউৎ তুলে কিছু আলোড়ন তুলেছিল - যার ফলে একটা বড়ো অংশের নিরপেক্ষ থাকা ভোটাররা ওদিকে হেলে পড়েছেন। কিউবা, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশ থেকে পালিয়ে আসা ‘লাতিনো’ মানুষরা - সংখ্যায় তাঁরা কম নন - তাঁকে এজন্যে ভোট দিয়েছেন - কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সাচ্চা লড়ুয়ে ভেবে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ - যাঁরা করোনার ফলে তুলনায় অনেক, অনেক কম বিপন্ন হয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পের নির্বুদ্ধিতার ব্যাপার তলিয়ে দেখেননি। শহরের মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিকরা বিপন্ন হয়েছেন ট্রাম্পীয় অর্থনৈতিক গা-জোয়ারি এবং পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে, গ্রামীণরা সেভাবে তার আঁচে ছ্যাঁকা খাননি। ‘কালো’ মানুষদের সম্পর্কে এখনও বিদ্বেষ সেখানে ব্যাপকতর। এবং বেশ কিছু ভোটার সর্বত্রই থাকেন, যাঁরা গতানুগতিকতার বাইরে যেতে ভয় পান, পরিবর্তন করতে অনিচ্ছুক হন। এই সব কিছু মিলেই ট্রাম্পের পক্ষেও ভাল ভোট পড়েছে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন - ভারতের কি কিছু লাভ হলো?... বলা কঠিন। তবে, কাশ্মীর এবং ৩৭০ ধারা রদের প্রশ্নে, নাগরিকত্ব আইনের প্রশ্নে,চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে চিরন্তন বিবাদে লিপ্ত থাকার প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের উদারনৈতিক অংশ মোদী সরকারের সঙ্গে একমত নন। বিডেন এবং কমলা হ্যারিসও অনেকবার এসব নিয়ে কথা বলেছেন এমনভাবে, যা বিজেপি’র গেলা কঠিন। তাছাড়াও, আমেরিকায় গিয়ে মোদীবাবুর ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ ইত্যাদি বলাটাও ডেমোক্র্যাটরা - বলাই বাহুল্য ভালভাবে নেয়নি। বৈদেশিক নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হবে না বিডেনের আমলেও। তবে, আমেরিকায় পড়ুয়া ১১ লক্ষ বিদেশি ছাত্রের মধ্যে ২ লক্ষেরও বেশি ভারতীয়। ট্রাম্প তাদের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দেবার কথা ভাবছিলেন। আমেরিকা নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার কারণেই এবার সম্ভবত কিছু নরম এবং ভব্য হবে। এইচ ১বি ভিসার ক্ষেত্রেও হয়তো আগের অবস্থা ফিরতে পারে, ফেরা সম্ভব।প্রত্যাশিতও।

চীনের এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কতটা নতুন মোড় নেবে বলা যাচ্ছে না এখনই। তবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কটা যে বিডেন মেরামত করতে চাইবেন (কতটা পারবেন বলা কঠিন!) - তা যদি হয়, তার প্রভাব কিছুটা ভারত-চীন সম্পর্কের ওপরও পড়বে।

অন্তত, একটা ব্যাপার ঘটবে অবশ্য। বিজ্ঞান-বিরোধিতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, সামাজিক পশ্চাদমুখিনতা এবং গরিবকে মেরে ধনীকে তোল্লাই দেওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে ট্রাম্প এবং মোদী একেবারেই মাতৃস্বসা-তনয়তুল্য। মানে, মাসতুতো ভাই। তো, দেখা যাক, আগামী দিনে প্রতিক্রিয়াশীলতা-নাম্নী সেই মাসিটির কারণে অন্য ভাইটিরও বিদ্যাসাগর মশাইয়ের লেখা বর্ণপরিচয় দ্বিতীয়ভাগের ভুবন নামের ছেলেটির মতো দশা হয় কিনা আগামী নির্বাচনে। আশা তো করব অবশ্যই তার জন্যে ‘আলিবাবা’-র ওই গানটা না হয় হেঁড়ে গলাতেই গাইব তখন!