E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা / ১৩ নভেম্বর ২০২০ / ২৭ কার্ত্তিক ১৪২৭

ফিরে চল মাটির টানে

বনবাণী ভট্টাচার্য


তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মনরে আমার
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি নারে মন, মনরে আমার।।


বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, পিছুটান, ক্ষয়ক্ষতির মায়ায় গভীর নস্টালজিয়ায় মানুষের মনের ভিতরটা বোধহয় এরকমই নিজের সাথে নিজে কথা বলে ওঠে। এভাবেই বোধহয় নিজের সাথে আজ বোঝাপড়া করতে চাইছে রাশিয়ার ঠকে-যাওয়া মানুষগুলো, একদিন যাঁরা গ্লাসনস্ত-পেরে‍স্ত্রৈকার মোহে হাতের মুঠি থেকে হীরে ফেলে, দু’মুঠো করে ধুলো তুলে নিয়েছিল।

তখনও শতবর্ষ পূর্তি হয়নি নভেম্বর বিপ্লবের। ২০১৬ সালের মস্কোকেন্দ্রিক লেভাদা সেন্টারের সমীক্ষা জানিয়েছে - জনগণের ৫০ শতাংশ মনে করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ে তাদের ক্ষতি হয়েছে - ভালো হয়নি। ২৮ শতাংশ এই বিপর্যয়কে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন এবং ১৬ শতাংশ দ্বিধান্বিত - ভালো-মন্দর ওজন মেপে দেখতে পারেননি। ১৬ সালের পরে বহু জল গড়িয়ে গেছে ভল্গা থেকে। রুশীয়রা কি এই চার-পাঁচ বছরে সমাজতন্ত্রহীন রাষ্ট্রের এমন কোনো সুখী জীবনের স্পর্শ লাভ করেছেন, যে জীবন ও সমাজ ‍‌দেখে নোয়াম চমস্কি একান্ত উচ্ছ্বাসে বলে উঠেছিলেন পুঁজিবাদের বল্গাহীন ভয়ঙ্করতার প্রেক্ষিতে -‘‘কমিউনিজমকে স্বর্গের মতো সুন্দর বলে মনে হয়।’’ যদিও এই মন্তব্যের ভিত্তি সোভিয়েত সমাজতন্ত্র সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অভিজ্ঞতা মাত্র - সাম্রাজ্যবাদী সমাজ নয়।

১৯১৭ সালে ৭ নভেম্বর মহা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নবীন সেই রাষ্ট্রে যে সমাজ জন্ম নিলো, তার কোনো রূপ-কল্পনা গোটা পৃথিবীর কেউ করতে পারেনি। কিন্তু গড়পরতা রাশিয়ানদের থেকে ছোটোখাটো, খুবই সাধারণ চেহারার ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন রুশ জনগণকে নিয়ে যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ স্থাপন করলেন, তা আক্ষরিক অর্থেই ‘ভূতলে অতুল’।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুনের মধ্যে রুশ সমাজতন্ত্রের জন্ম হলো। যে রাশিয়ার সাধারণ জীবন ছিল ইয়োরোপীয় দেশগুলির মধ্যে এক্কেবারে সর্বশেষ ধাপে, সেই শোষণ-জর্জরিত, দারিদ্র্যের বোঝা বইতে বইতে নুয়ে পড়া পিঠের মানুষগুলো কি করে পিঠটান করে, মাথা তুলে কয়েক বছরের মধ্যে সারা পৃথিবীর সামনে নিজেদের হাজির করতে পারল, বিশ্বের মানুষ ধাক্কা খেল প্রথম সেইখানে। কুৎসা এবং নানা অপপ্রচার তো ছিলই, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের অন্ত ছিল না এই সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে। অন্যান্য দেশের তুলনায় পঞ্চাশ একশো বছর পিছিয়ে-পড়া দেশটা কোন্‌ যাদুতে এমন দ্রুতগতিতে সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলো, তা তো রহস্যজনক এবং অবিশ্বাস্য! তাই সোভিয়েত দেশটা হয়ে উঠেছিল অনেকের কাছে ‘‘স্বপন দেশের সুন্দরী’, ‘রহস্যের রঙমহল’ ইত্যাদি। ওই রহস্যটা একটু একটু করে উন্মোচিত হয়েছে। ওই রহস্যটা যাদু নয়, ভৌতিক নয় - নয় ঐশ্বরিক - সোভিয়েত সমাজের দুরন্ত অগ্রগতি, বিপুল সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হলো একটা যুগান্তকারী মতাদর্শ, অল্প কয়েকটা পাতার মধ্যে যা সংহত হয়েছিল প্রথমে ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে। কার্ল মার্কস যদিও ভেবেছিলেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই প্রথম সমাজ বদল ঘটবে, কিন্তু প্রথম সমাজ বিপ্লব রূপ নিলো রাশিয়ার মতো একটা কৃষিপ্রধান দেশে, যেখানে প্রধানত ছিল কৃষক সম্প্রদায় এবং বুদ্ধিজীবীরা। সেভাবে কোনো শ্রেণি আন্দোলন ছিল না - বুদ্ধিজীবীদের মুক্ত চিন্তাই ছিল তখন বিপ্লবী আন্দোলন। কার্ল মার্কসের অবশ্য রুশ দেশের সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী এবং পরবর্তীকালের বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ ছিল, কারণ মার্কস-এঙ্গেলসের রাশিয়ার দানবীয় জার শাসনের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ছিল। এটা একেবারেই কাকতালীয় যে, মার্কসের ‘জার্মান ভাষায় লেখা দাস ক্যাপিটাল, সর্বপ্রথম রাশিয়ান ভাষাতেই অনূদিত হয় এবং ১৮৭২ সালে বইটি প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে সেন্ট পিটার্সবার্গে ৯০০ কপি বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল - সাম্যবাদ অর্থনীতির প্রভাব এদেশে তখন এতটাই ছিল। এই দর্শন, এই অর্থনীতিকেই মাটিতে রূপ দেবার জন্য ভি আই লেনিন বলশেভিকদের নিয়ে কখনও সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে, কখনও আত্মগোপনে দেশান্তর থেকে কুখ্যাত জার শাসন উপরে ফেলে সোভিয়েত গড়ে একটা নতুন রাষ্ট্র গঠন করলেন, যার পরিচালনায় থাকল সর্বহারা শ্রেণি।

চিরকালই শাসনক্ষমতায় যারা থাকে তারা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থই রক্ষা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকশ্রেণিও তাই-ই করেছে। তারা নিচের তলার মানুষের স্বার্থেই তাদের রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করে প্রয়োগ করেছে। আর তা করেছে বলেই ওই দেশটাই পৃথিবীতে সব পেয়েছি দেশের রিহার্সাল দিয়ে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে সর্বস্বান্ত রাশিয়া - অনাহারে হাড় জিড়জিড়ে শিশুর মতো, অর্থনীতি ভেঙে পড়া, বাইরে শত্রুর ক্ষুধার্ত চোখ, ভিতরে বিদ্রোহী কৃষক, প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা - মেনশেভিক ও শ্বৈত সৈন্যের ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাস। সেই উপোসী-বিশৃঙ্খল দরিদ্র রাশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান স্থপতি ভি আই লেনিন ১৯১৮ সালেই ঘোষণা করলেন খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলার লক্ষ্যে যে, খাদ্যের উপর একমাত্র অধিকার আছে রাষ্ট্রের। মুনাফার জন্য খাদ্য মজুত যারা করবে, তাদের প্রাপ্য হবে কঠোর শাস্তি - তারা গণশত্রু। গ্রামের জমিদার-ধনী কৃষক বিপ্লবী সরকারের সাথে চরম অসহযোগিতায় শুধু খাদ্য মজুতই করেনি লুকিয়েও ফেলত। খাদ্যশস্য সংগ্রহে লেনিন সেনাবাহিনীকেও নিয়োগ করার নির্দেশ দেবার পরেও, সরকারের কোনো একটি বিভাগের দুর্বলতার প্রেক্ষিতে পিপলস কমিশার এবং তাঁর অত্যন্ত প্রিয় সহযোদ্ধা ভি পি মিলিয়্যুতিনকে একটি সভাতে ভর্ৎসনা করে যা বলেছিলেন, মিলায়্যুতিন তা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন - ওই সভাপতিমণ্ডলীকে আটক করে শুধু জল আর রুটি দেওয়া উচিত - এমনকি রুটিও বাদ দিয়ে শুধু জলই। দুর্বলতা বাড়লে তাদের জলেও ডুবিয়ে দেওয়া যেতে পারে - রুটি তো বিলাসিতা। লেনিন খাদ্যের জন্য এক আপসহীন দুধর্ষ যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন শ্রমিকশ্রেণিকে। কারণ শেষ ব্যাখ্যায় ওই যুদ্ধটা আসলে লেনিনের কাছে পক্ষী শাবককে পক্ষী মায়ের সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করার মতোই শিশু সমাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। পূর্ব রণাঙ্গণে দখলদার জার্মানির সাথে যুদ্ধাবিরতির চুক্তি বিপ্লবীয়ানার মোহে না করলে সোভিয়েতের মৃত্যুদণ্ডে স্বাক্ষর করতে হতো, লেনিনের এই দূরদর্শিতা রক্ষা করেছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে।

আর সেই সমাজতন্ত্রটাই ছিল বলে রাশিয়াটা স্বর্গ হয়েই উঠেছিল - রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লিখলেন -‘‘জানি প্রকাণ্ড একটা বিপ্লবের উপরে রাশিয়া এই নবযুগের প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু এই বিপ্লব মানুষের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও প্রবল রিপুর বিরুদ্ধে বিপ্লব - এ বিপ্লব অনেকদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্তের বিধান।... নব্য রাশিয়া মানবসভ্যতার পাঁজর থেকে একটা বড়ো মৃত্যুশেল তোলবার সাধনা করেছে, যেটাকে বলে লোভ।’’ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল যে, এখানে অর্থ সঞ্চয় করা নিষিদ্ধ। আসলে নিষিদ্ধ নয়, মানুষ সঞ্চয় করে না, সঞ্চয়ের জন্য ঝোঁকই নেই। কারণ সন্তান-সন্ততির ভরণপোষণ এবং বৃদ্ধ বয়সে নিজের জন্য খাওয়া-পরার দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রই নেয়, তবে সঞ্চয়ের দরকার কি? আর সঞ্চয় কর‍‌তে না হলে লোভই বা দেখা দেয় কি করে? অন্যকে বঞ্চনা করে আত্মসাৎ করার তো প্রশ্নই নেই।

প্রবীণ রাশিয়ানদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে যে, তৃতীয় সন্তানের দায়িত্ব বাবা-মা ও রাষ্ট্রের সমান সমান এবং পরবর্তী সন্তানদের সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই থেকেছে। অশিক্ষার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া দেশটায় ১৬ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের শিক্ষাটা সর্বহারার নেতৃত্বের সরকার বাধ্যতামূলক করেছিল। রুশ ছেলেমেয়েদের তিন রকমের শিক্ষা দেওয়া হতো - (১) সংস্কৃতিমূলক, (২) শরীর বিষয়ক, (৩) বত্তিমূলক। বৃত্তিমূলক শিক্ষাও বাধ্যতামূলক - উচ্চশিক্ষা না নিলে সময় নষ্ট না করে সরাসরি কাজে লেগে যাওয়ার কারণেই এই ব্যবস্থা। কাজের জন্য কাউকে উৎকণ্ঠা নিয়ে ছুটতে হয় না। কাজ জোগাড় করতে হয় না। রাষ্ট্র বৃত্তিমূলক শিক্ষার সার্টিফিকেট দেখেই উপযুক্ত কাজ দিতে বাধ্য। ১৯৪১ সালেই বাঙালি এক প্রাবন্ধিক প্রবর্তকে লিখলেন - ‘‘সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র রাশিয়ার অভিধানেই বেকার শব্দের উল্লেখ নেই, তাছাড়া সর্বত্রই এর অস্তিত্ব সমাজের অঙ্গে দুষ্ট ক্ষতের মতো পীড়া দিচ্ছে।’’ রাশিয়ায় সেই সময়ে সর্বোচ্চ বেতন ছিল ২০০০ রুবল যা বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিক-শিল্পী-সাহিত্যিকরাই পেতে পারতেন এবং নিম্নতম হলো ১৭৫ রুবল।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কতগুলো চিহ্ন এই শিক্ষা এবং বেতন ইত্যাদি। প্রকৃত অভিজ্ঞান হলো এই রাষ্ট্রের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষগুলো। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এক সময়ে বলেছিলেন, আমাদের ছেলেরা এমএ, এমএসসি পাশ করার পর জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা লাভ করে। রাশিয়ায় শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে ওই ১৬ বছর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা এত সহজ ও সুন্দর অথচ গভীর ও ব্যাপক যে, তারপরেই তারা সত্যিকারের জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হয় - যা বিস্ময়কর। আসলে সমাজতন্ত্র মানুষ গড়েছে - মানুষের মতো কোনো প্রজাতিকে নয়। স্বার্থহীনতা-ন্যায়বোধ আর দেশপ্রেমের রসায়নে যে মনুষ্যত্ব ক্ষীর হয়ে জমে ওঠে, সমাজতন্ত্রের মানুষগুলো সেই অমৃতের স্বাদ পেয়েছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে দায়িত্বশীল আধিকারিকদের বিচার ও শাস্তিদানের লিনচিন কমিটি সম্পর্কে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন - এক স্কুল পরিদর্শিকার কাজের কৈফিয়তে এই কমিটি যখন সন্তুষ্ট, তখন তার বান্ধবী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন - ‘‘আমি জানি একদিন কাজের সময়ে ইনি আমার বাড়িতে বসে গল্প করে কাটিয়েছেন।’’ এই নির্ভীকতা-কুণ্ঠাহীনতা ও সততা মনে করিয়ে দেয় বন্ধুর চেয়ে, না পার্টি না, দেশ বড়ো। এই মানসিকতা সমাজতন্ত্রের মাটিতে জন্মায়।

সমস্ত মানুষের মর্যাদাদান সমাজতন্ত্রের সৃষ্টি। বৈজ্ঞানিক-সাহিত্যিক-শিল্পী - সব সমাজেই সমাদৃত, এখানেও। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের কথা, বিনোদনের কথা কে কবে ভেবেছে? রাশিয়ায় ১৯২৭/২৮ সালে ৭৪ হাজার স্যানিটোরিয়ান এবং সাড়ে চার লক্ষ রেস্টরুম, ১৯৩৮ সালে যথাক্রমে সাড়ে পাঁচ লক্ষ এবং ১৯ লক্ষের বেশি সৃষ্টি হয়েছিল শ্রান্ত-ক্লান্ত শ্রমিকদের শরীর ও মনের শুশ্রুষার জন্য। বিশ্রামের জন্য অনেক পার্কের মধ্যে একটি বিশিষ্ট পার্কও প্রতিষ্ঠিত হলো - ‘স্টাখানোভাইট দিগের উদ্যান সম্মিলিন।’ স্টাখানোভ, কোনো গবেষক বা শিল্পী-সাহিত্যিক নয়, একজন সাধারণ শ্রমিক, নিজের জ্ঞানবুদ্ধি-শ্রমে উৎপাদন বৃদ্ধির পথ খুঁজে পায়। তাঁর এই পথে যাঁরা সফল হয়েছে, তাঁদেরকেই স্টাখানোভাইট বলা হয় এবং তাঁরই নামাঙ্কিত ওই প্রতিষ্ঠানে আলোচনা চলতে পারে লোহা লক্কর সম্পর্কিত নয়, একেবারে সংস্কৃতিবানদের সামনে অন্যান্য দেশে যে আলোচনা হয়, সেই সঙ্গীত সম্পর্কেও। আর সোভিয়েত নারী তো সারা বিশ্বের লাঞ্ছিত নারীর কাছে স্বপ্নের মতো যারা সেদেশের চিকিৎসকদের ৬৮ শতাংশ, শিক্ষকদের ৭২ শতাংশ, বিচারদের ৩৭ শতাংশ এবং নির্বাচিত সোভিয়েতে অর্ধেকের বেশি সংখ্যায়। বিপ্লবী ক্রুপস্কায়া, কোলোনতাই থেকে ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভারা গোটা বিশ্বের নারী সমাজের আইকন এবং সত্যিই স্বপ্ন সুন্দরী - অধিকারে এবং মর্যাদায়।

আর এই নতুন চেতনার মানুষকে নিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর মহা-প্রলয়ের মধ্যে জোসেফ স্তালিন সমাজতন্ত্রের ভেলা বেয়েই তরঙ্গক্ষুব্ধ সমুদ্র পার হয়ে রক্ষা করেছেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্র - রক্ষা করেছেন ফ্যাসিস্ত শক্তিকে চুরমার করে এই গ্রহটাকে। দু’কোটি মানুষ নিঃস্বার্থে প্রাণ দিয়েছে নিজের দেশের জন্য নয়, মানবসভ্যতাকেই বাঁচিয়ে রাখতে। মানুষ বেঁচেছে - সভ্যতা রক্ষা পেয়েছে ধ্বংসের হাত থেকে। আর সেই দেশ, দু’টো বেশি জিনস্‌-দু’বোতল বেশি ভৎকার আশ্বাসে - মনুষ্যত্বের হীরের টুকরোগুলো ছুঁড়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলল সমাজতন্ত্র নামের জীবনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা।

তাই আজ রাশিয়ায় হাহাকার। বেকারের লাইন - হোটেলে মধ্যরাতে সুবেশা তরুণীর বন্ধ দরজায় করাঘাতের আওয়াজ তোলা জীবিকার জন্য। মেয়ে জন্মালে এক রুবল - ছেলে জন্মালে পাঁচ রুবল রাষ্ট্রের পারিতোষিক। এই জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছে রাশিয়ায় ক্রমে ক্রমে। আওয়াজ উঠছে ফিরে চলো মাটির টানে, যে মাটি সমাজতন্ত্রের, যে মাটিতে চাষ হয় মনুষ্যত্বেরই। মানুষ কান পেতে আছে নদীর জলে, পাতার মর্মরে আর ফুলের ভাষায়। আর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে সমাজতন্ত্রে ফিরে চলার পথ খুঁজে চলেছে একা অথবা অনেকে।