৫৮ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা / ১৩ নভেম্বর ২০২০ / ২৭ কার্ত্তিক ১৪২৭
জে বি এস হলডেন স্মরণে
তপন মিশ্র
জে বি এস হলডেন এবং প্রশান্ত মহলানবিশ।
আজ থেকে ৯০ বছর আগেকার কথা। দুই স্বনামধন্য ইংরেজের মধ্যে চিঠির লড়াই ইয়োরোপের বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। এই দু’জনের মধ্যে একজন হলেন আর্নল্ড লুন (Arnold Henry Moore Lunn) এবং অন্যজন জে বি এস হলডেন (John Burdon Sanderson Haldane)। আর্নল্ড লুন ছিলেন নাইট উপাধি প্রাপ্ত একজন পর্বতারোহী এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রচারক। অন্যদিকে হলডেন ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী, রয়াল সোসাইটির ফেলো এবং যুক্তিবাদের প্রচারক। চিঠির লড়াই শুরু হয় হলডেনের বিবিসি (British Broadcasting Corporation)’তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। পরস্পরের দিকে আঘাত করা পত্রবাণের সবগুলিই পাওয়া যায় ‘Science and the Supernatural’ নামে এক প্রকাশনায়। চিঠিগুলি এতো বড়ো যে, কিছু নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা ছাড়া উপায় নেই। হলডেনের সাক্ষাৎকারের পর ক্ষুব্ধ লুন হলডেনকে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে চিঠি লেখেন। নিচে দ্বিতীয় চিঠিটির একটি অংশ তুলে ধরা হলো যেখানে লুন লিখছেনঃ “Dear Haldane, I shall not quarrel with you over your enthusiasm for scientific thought, for I agree with you that most of our secular troubles are due to lack of scientific thinking... My real quarrel with the majority of scientists is that they refuse to apply the scientific method to religion”। হলডেনকে সম্বোধন করে লুন লিখছেনঃ এটা ঠিক যে, আমাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তার অভাবে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার ঘাটতি দেখা যায়; কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানী ধর্মে বিজ্ঞানের পদ্ধতির প্রয়োগ করেন না।
ঠিক পরেই এই চিঠির উত্তরে হলডেন লিখছেনঃ “Dear Lunn, A still more important part of scientific method is the devising of experiments or observations to test a hypothesis. I would go further and say that, from the scientific point of view, a hypothesis which cannot be tested by the fact that it enables us to predict a previously unpredictable phenomenon is a mere set of words. Some very great scientists, such as Faraday and Pasteur, have been predominantly experimenters rather than inferrers of general laws”। চিঠিতে অনেক উদাহরণ দেওয়ার পর হলডেন লিখছেন যে, বিজ্ঞানের ধর্ম হলো কোনো অনুমান (hypothesis)কে পরীক্ষার মধ্যদিয়ে তার সত্যাসত্য যাচাই করা। তিনি মাইকেল ফ্যারাডে এবং লুই পাস্তুরের উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, কোনো অনুমান বা সূত্র পরীক্ষণীয় না’হলে তা কেবল কথার কথা থেকে যায়, বিজ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছায় না।
প্রায় তিন বছর ধরে দু’জনের মধ্যে যে পত্রালাপ চলে সেই আলাপে বিজ্ঞানের পদ্ধতি এবং এক বিশাল সময়ের বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক মূল্যবান ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৫৭ সালে অর্থাৎ ৬৫ বছর বয়সে হলডেন ভারতে এসে এদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, এই বয়সে এদেশে কলকাতার বরানগরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এ যে গবেষণার কাজ শুরু করেন, সেই গবেষণার জন্য ভারতে জৈবকলনবিদ্যা (Biometry)’র জনক হিসাবে পরিচিত হন।
নভেম্বর মাস তিন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর জন্ম মাস। ১৮৬৭সালের ৭নভেম্বর পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন মাদাম মেরি ক্যুরি। ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর ভারতের তামিলনাডুতে জন্মালেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন এবং অপেক্ষাকৃত বয়সে ছোটো জে বি এস হলডেনের জন্ম হয় ব্রিটেনে ১৮৯২সালের ৫নভেম্বর। আমাদের আলোচনা জে বি এস হলডেনকে নিয়ে। রাজনৈতিক পরিসরে তিনি জ্যাক হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং গবেষণাগারেও তাঁর এই নাম জনপ্রিয় ছিল।
কমিউনিস্ট হলডেন
১৯৩০ সালে হলডেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। প্রায় ২৭ বছর ধরে তিনি কেবল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন তাই নয়, লন্ডন থেকে প্রকাশিত পার্টির পত্রিকা “Daily Worker”-এর সম্পাদনার কাজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। এই রাজনৈতিক দায়িত্বের কারণে তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার কাজে কোনো ঘাটতি ছিলনা। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয় মূলত সোভিয়েত বিজ্ঞানী লাইসেঙ্কোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার বিজ্ঞানী লাইসেঙ্কো বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, মেন্ডেলের জেনেটিক ইনহেরিটান্স (জিনবাহিত উত্তরাধিকার)-এর তত্ত্ব ভুল। জীবের উপর পরিবেশের যে প্রভাব পড়ে সেটাই জীবের সমস্ত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
সোভিয়েতের সাইবেরিয়া অঞ্চলে শীতের পর ভার্নালাইজেশন (Vernalization) প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে গম চাষে প্রায় ১৫শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া লাইসেঙ্কো প্রবর্তন করেন। এই অঞ্চলে প্রবল শীতের পর গমের ফলন খুব ভাল হতো না। এখানকার কৃষকদের একটি পরম্পরাগত কৃষিপদ্ধতির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে লাইসেঙ্কো এই অঞ্চলে গমের ফলনের যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন তা সোভিয়েতে প্রশংসিত হয় এবং সেখান থেকে তিনি রাজনৈতিক সুবিধাও পান। কিন্তু মেন্ডেলের সুত্রগুলির অন্ধ বিরোধিতা করায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লাইসেঙ্কোর বিজ্ঞানের পদ্ধতির প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে যায়।
লাইসেঙ্কোর ধারণা যেমন বিজ্ঞান গ্রহণ করেনি তেমনই আবার কেবল জিনবাহিত বৈশিষ্ট্য নয় জীবের উপর পরিবেশের প্রভাবেরও যে গুরুত্ব রয়েছে তাও অস্বীকার করার নয়। বিজ্ঞানে গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। সেই কারণে এক বিশাল দেশের খাদ্য উৎপাদনে এক অভাবনীয় আবিষ্কারের (ভার্নালাইজেশন) বিশ্বজোড়া খ্যাতি সত্ত্বেও বিজ্ঞানী লাইসেঙ্কোর মেন্ডেলের তত্ত্বের বিরোধিতা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নিন্দিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। এই ঘটনা একথাই প্রমাণ করে যে, বিজ্ঞানচর্চায় গোঁড়ামি থাকলে সামগ্রিকতার বিচারের ঘাটতি অনিবার্য। হলডেন এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন এবং লাইসেঙ্কোকে অন্ধ সমর্থনের জন্য ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কিন্তু স্পেনে যখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহযুদ্ধ চলছিল তখন তিনি তিন বার স্পেনে যান এবং পরামর্শ দেন।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ১৮৮৩ সালে একটি বই লেখেন যার নাম ‘Dialectics of Nature’। বইটির প্রথম ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে, বইটির মুখবন্ধ লেখেন হলডেন। মুখবন্ধে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সঙ্গে হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্বের মিল এবং সেই সম্পর্ক এবং এঙ্গেলসের বাখ্যার বর্ণনা বইটিতে একটি নতুনমাত্রা যুক্ত করে। মুখবন্ধে তিনি লিখছেনঃ “Had Engels’ method of thinking been more familiar, the transformations of our ideas on physics which have occurred during the last thirty years would have been smoother. Had his remarks on Darwinism been generally known, I, for one would have been saved a certain amount of muddled thinking. I, therefore, welcome wholeheartedly the publication of an English translation of “Dialectics of Nature”, and hope that future generations of scientists will find that it helps them to elasticity of thought”। মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, বিভিন্ন কারণে বইটি ছেপে জনসমক্ষে আসার জন্য প্রায় ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
বিজ্ঞানী হলডেন
বিজ্ঞান গবেষণায় অবদানের জন্য হলডেন যে কেবল রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন তাই নয়, তিনি ১৯৫২ সালে ডারউইন মেডেল এবং ১৯৫৮ সালে ডারউইন-ওয়ালেস মেডেল পান। ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত জৈবরসায়ন বিজ্ঞানী ওপারিন (Alexander Ivanovich Oparin)-এর সঙ্গে প্রাইমোডিয়াল সুপ (Primodial soup) তত্ত্বের বাখ্যা করেন। তাঁদের মতে ৩৭০-৪০০ কোটি বছর আগে সমুদ্রের জলে অজৈব রাসায়নিক পদার্থের সমন্বয়ে জৈব অণু তৈরি হয়। সেই সময়ে পৃথিবী পৃষ্ঠে আজকের মতো বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছিল না এবং তার পরিবর্তে ছিল হাইড্রোজেন এবং কার্বন মনোক্সাইডের আধিক্য। তাঁর বই 'The Origin of Life' (১৯২৯)-এ তিনি লিখছেন When ultra-violet light acts on a mixture of water, carbon dioxide, and ammonia, a vast variety of organic substances are made, including sugars and apparently some of the materials from which proteins are built up... before the origin of life they must have accumulated till the primitive oceans reached the consistency of hot dilute soup। এর পর আমেরিকার বিজ্ঞানী Harold Urey and his student Stanley Miller পরীক্ষাগারে এই বিখ্যাত পরীক্ষাটি সাফল্যের সঙ্গে করেন। জীবনের বস্তুগত ভিত্তি প্রমাণিত হয়ে যায়। ডারউইনের সঙ্গী প্রাণীবিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলের সঙ্গে তাঁর জীববিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন বিষয়ে তথ্যের আদানপ্রদান ছিল। মানুষের ‘এক্স’ ক্রোমোজোম (X-Chromosome)-এ রক্তের হিমোফিলিয়া রোগ এবং ‘রঙ চিনতে না’ পারার কালার-ব্লাইন্ডনেস রোগের জিনের অবস্থান নির্ধারণ করেন হলডেন। পৃথিবীতে নব-ডারউইনবাদ (Neo Darwinism) অর্থাৎ আধুনিক জিন গবেষণার আলোকে ডারউইন তত্ত্বের বাখ্যার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন অগ্রগণ্য গবেষক।
ভারতে হলডেন
১৯৫৬ সালে ব্রিটেনের সুয়েজ নীতির বিরোধিতা করে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতার আইএসআই’তে বায়োমেট্রি (Biometry) বিভাগে যোগ দেন। বায়োমেট্রি হলো জীববিজ্ঞানের গবেষণায় গণিত ও কলন (Statistics) বিদ্যার প্রয়োগ। এর মধ্য দিয়ে পপুলেশন জেনেটিক্স (Population genetics) কারণ তিনি খুঁজতে সক্ষম হন।
একবার বিভিন্ন দেশের উপর মার্কিনি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি অনশনে নামলে আইএসআই’র অধিকর্তা প্রশান্ত মহলানবিশের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য হয়। বিভিন্ন কারণে এই মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। ফলে তিনি আইএসআই ত্যাগ করে ভুবনেশ্বরে আর একটি গবেষণাগারে যুক্ত হন, যেখানে তিনি আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তাঁর দেহে কোলনে কর্কট রোগ ধরা পড়ে। ১৯৬৪ সালের পয়লা ডিসেম্বর ভুবনেশ্বরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর দেহ তিনি চিকিৎশাস্ত্রের জন্য দান করে যান। বিশিষ্ট লেখক গ্রফ কঙ্কিন তাঁকে যথার্থ অর্থেই ‘Citizen of the World’ হিসাবে বর্ণনা করেন।
আজীবন বামপন্থী হলডেন ১৯৩৯ সালে লেখা তাঁর বই ‘The Marxist Philosophy and the Sciences’এ লেখেনঃ “Above all, dialectical materialism insists on the reality of change. It claims to go back beyond Plato and Socrates to Heraclitus, and in particular it welcomed the new developments of physics which seemed to some to spell the end of materialism, and which undoubtedly were the end of the very narrow forms of materialism current in many scientific circles at the end of the nineteenth century, and still current in some of them.”