E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০

পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের আহ্বান

লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পীদের বাঁচাতে হবে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ভোগবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োজিত সরকারি ব্যবস্থা। লোকশিল্পকে রক্ষা করা বৃহত্তর লড়াই আন্দোলনের অঙ্গ। বিপন্ন লোকসংস্কৃতিকে বাঁচাতে লোকশিল্প, লোকশিল্পীদের বাঁচাতে হবে। এই আহ্বানকে সামনে রেখে ১ ও ২ অক্টোবর সলাবৎ মাহাতো নগর (পুরুলিয়া) উমেশ চন্দ্র মাণ্ডি মঞ্চে (শ্যাম ধর্মশালায়) অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘের ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলন। সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিতে ৭৯ জনের রাজ্য কমিটি গঠিত হয়েছে। সভাপতি হিসেবে মনো সরেন, সম্পাদক শের আলি এবং কোষাধ্যক্ষ কমলেশ্বর ভট্টাচার্য নির্বাচিত হয়েছেন।

৩০ সেপ্টেম্বর বর্ণাঢ্য স্থানীয় রাস মেলা প্রাঙ্গণে প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সম্মেলন। লোকশিল্পীরা মিছিল করে সমাবেশে যাবার প্রস্তুতি শুরু করলে ভয়ংকর বর্ষণ শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টি প্রকাশ্য সমাবেশকে বিলম্বিত ও বিঘ্নিত করলেও তাঁরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে অতিক্রম করে, হাজারো সংখ্যায় সম্মেলন মঞ্চের কাছে সমাবেশ স্থলে জড়ো হন। রণপা, বাউল, ঝুমুর, সঙ্গে ছৌ-নাচের বেশ কয়েকটি দলের বিভিন্ন আঙ্গিকের প্রায় ৩০টি দল, তিন হাজার আদিবাসী শিল্পী মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। পোশাক ও মুখোশ জলে নষ্ট হবার ভয়ে সাধারণ পোশাকেই ছৌ-নাচের শিল্পীরা মিছিলে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। সমাবেশস্থলের চারিদিকে পায়ের পাতা ডোবা জল দাঁড়িয়ে গেলেও তা শিল্পীদের উৎসাহকে দমাতে পারেনি।

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ হেমব্রম। সমাবেশের মূল বক্তা ছিলেন মালিনী ভট্টাচার্য। প্রকাশ্য সমাবেশে মালিনী ভট্টাচার্য বলেন, আজকের এই দেশব্যাপী সংকটের সময় লোকসংস্কৃতি ও লোকসংগীত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। লোকশিল্পীদের আজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। লোকশিল্পকে বাজারের পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং সেটাই সবচেয়ে বড়ো আঘাত। এই আঘাতে শিল্পী ও শিল্প দুই বিনষ্ট হচ্ছে। বাঁচাতে হবে লোকশিল্পী এবং শিল্পকে। তবেই লোকসংস্কৃতি বাঁচবে। দেশ বাঁচবে।

এরপর সমাবেশ স্থলে বহু শিল্পী অনুষ্ঠান করেন। দুটি মঞ্চে দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে লোকশিল্পীদের বিভিন্ন আঙ্গিকের নানা অনুষ্ঠান।

১ অক্টোবর পতাকা উত্তোলন এবং শহিদ বেদিতে ফুল দেওয়ার মধ্যদিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। পতাকা উত্তোলন করেন মালিনী ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার এবং খেতমজুর ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদক নিরাপদ সরদার সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুধী প্রধান পুরস্কার প্রাপ্ত ঝুমুর শিল্পী বিদ্যাধর কর্মকার। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রাদেশিক কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার। তিনি বলেন, কৃষক সভার উদ্যোগেই গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘ। আমরা লড়াই করি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। গানের মধ্য দিয়ে সমস্যার কথা তুলে ধরে মানুষের মনকে জয় করে নিতে হবে।

সম্মেলন পরিচালনার জন্য সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয় রণজিৎ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক শংকর মুখার্জি।

প্রাণোচ্ছল পরিবেশে সঙ্গীত ও লোকশিল্পীদের নানা উপস্থাপনার আবহে সম্মেলন ক‍‌ক্ষে প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে আসে লোকশিল্প এবং শিল্পীদের সংকট এবং তা অতিক্রম করে উত্তরণের বিভিন্ন দিক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামীণ কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষই আমাদের শ্রোতা, দর্শক এবং আমাদের পৃষ্ঠপোষক। গ্রামীণ শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে লোকশিল্পীদেরও জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।

প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় উঠে আসে মাটির সঙ্গে যোগাযোগ না বাড়াতে পারলে অগ্রগতি হবে না। দেওচা পাচামি আন্দোলনের শিল্পীদের অংশগ্রহণের কথা, পরিচয়পত্র না থাকায় শিল্পীদের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা, ব্লক স্তরে চর্চা কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার কথা। লোকশিল্প এবং লোকশিল্পীদের বাঁচানোর বিভিন্ন দাবি উঠে আসে সম্মেলন থেকে। তার মধ্যে রয়েছে ১৮ বছর ও তার উর্ধ্বে সক্ষম আদিবাসী, অ-আদিবাসী প্রকৃত লোকশিল্পীদের প্রত্যেককে পরিচয়পত্র, ভাতা এবং সরকারি অনুষ্ঠান দেবার কথা, প্রবীণ লোকশিল্পীদের অবসর ভাতা প্রদান এবং উপযুক্ত সাম্মানিকের বিনিময়ে প্রশিক্ষক হিসাবে কাজে লাগানো, সব ব্লকে ‘লোকশিল্প চর্চা কেন্দ্র’ নির্মাণ, লোক উৎসবের আয়োজন, পর্যটন কেন্দ্রে লোকমঞ্চ নির্মাণ, সবধরনের সরকারি পরিবহণে যাতায়াতের ভাড়ায় ছাড়, চিকিৎসায় সহায়তা এবং বিমাভুক্ত করার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র, পোশাক, মুখোশ ইত্যাদি প্রস্তুতকারীদের জন্য সরকারি অনুদান ও কর ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় স্বার্থে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র সরকারি প্রকল্পের প্রচারমূলক গান, নাচ নয়, স্ব-স্ব আঙ্গিকের গান-নাচের অনুষ্ঠান করার স্বাধীনতা লোকশিল্পীদের দিতে হবে।

সম্মেলন মঞ্চে মালিনী ভট্টাচার্য বলেন, একটা সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। কৃষি ও কৃষক যেমন সংকটগ্রস্ত আমাদের শিল্পও সমানভাবে সংকটগ্রস্ত। ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতিকে। সবদিক গুলিয়ে দিতে চাইছে। মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে সংস্কৃতিকে ভাগ করতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।

সম্মেলন থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ, পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে, এবং কৃষি সংকটের বিরুদ্ধে মোট চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

আগামী কর্মসূচি হিসেবে সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে যে বিষয়গুলি উল্লিখিত ও গৃহীত হয়েছে তা হলো, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিবিধ উপকরণ লোকশিল্পীদের মধ্যে বিদ্যমান। তাদের জাগিয়ে তোলাটাই হোক সংগঠনের মূল লক্ষ্য। সংগঠনের কার্যধারা, কর্মসূচিগুলির মূল শক্তি হয়ে উঠুক শিল্পীদের উঠোন। তাই সংগঠনকে শিল্পীদের এই উঠোনকে ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহার করা জানতে- শিখতে হবে। যত ব্যবহার করা যাবে তত শক্তি বৃদ্ধি হবে সংগঠনের। আত্মসমালোচনার সুরে সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র লোকশিক্ষকের ভূমিকাই পালন করা নয়, আমাদের নিজেদের মধ্যে যে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, অজ্ঞানতা আছে তা দূর করে নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলার কাজও আমাদের করতে হবে।

দ্বিতীয় দিন অধিবেশন শুরু হয় শের আলির সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে।

সম্মেলন মঞ্চে প্রবীণ ছৌ শিল্পী ভগবান দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

জবাবি ভাষণ দেন শের আলী। সম্মেলন থেকে ৭৯ জনের নতুন রাজ্য কমিটি এবং। ৭ জনের উপদেষ্টামণ্ডলী গঠিত হয়।