৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০
ইজরায়েল-গাজা ভূখণ্ডে যুদ্ধ
চাঞ্চল্য বিশ্বজুড়ে
অর্ণব ভট্টাচার্য
গত ৭ অক্টোবর ভোরে অভাবনীয় ঝটিকা আক্রমণে ইজরায়েলের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্যালেস্তাইনের যোদ্ধারা। গত ৭৫ বছরে এই প্রথম ইজরায়েলের ভূখণ্ডে এই রকম সামরিক সংঘাত ঘটছে। গাজা থেকে হামাসের নেতৃত্বে এই নজিরবিহীন সামরিক অভিযানের পরপরই পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সামরিক শক্তিতে অনেক দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এবং বিরাট ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ইজরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে হামাসের এই অভিযানে দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ট্যাঙ্ক, মোটর সাইকেল, ট্রাকে, এমনকী আকাশপথেও, প্যারাগ্লাইডিং করে প্রায় এক হাজার প্যালেস্তিনীয় যোদ্ধা গাজার উত্তর প্রান্তের সীমানা দিয়ে ইজরায়েলি বাহিনীকে হতচকিত করে ঢুকে পড়ে। বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানের সীমান্ত প্রাচীর। ইজরায়েলি সেনাদের ট্যাঙ্ক দখল করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গাজা থেকে কয়েক হাজার রকেট ছোঁড়া হয় ইজরায়েলকে লক্ষ করে।
প্রাথমিক আঘাত কাটিয়ে ওঠার পর অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ গাজা এলাকায় ইজরায়েলের বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণে এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। বাসস্থান, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি ধ্বংস হয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে গাজার অনেক জনপদ। বিদ্যুৎহীন গাজায় খাদ্য, ওষুধের প্রবল সংকটের মধ্যেও সেখানে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ত্রাণ পৌঁছাতে দিচ্ছে না ইজরায়েল। দু’পক্ষের সংঘর্ষে এখনও পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। অপহৃতের সংখ্যা শতাধিক, আহত বহু মানুষ।
কেবল গত একবছরে ইজরায়েলি সেনারা পূর্ব জেরুজালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৩০০ প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে। জেরুজালেমের প্রসিদ্ধ আল- আকসা মসজিদ ইজরায়েলি সেনারা কার্যত দখল করে নিয়েছে। এখন পূর্ণ মাত্রা চলাকালীন ইজরায়েলের হিংসাত্মক আক্রমণ আরো বিধ্বংসী চেহারা নিয়েছে। অন্যদিকে একথা সহজেই অনুমান করা যায় যে, ইজরায়েলের লাগাতার দখলদারি, নিত্যনৈমিত্তিক হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মস্থান পর্যন্ত দখল করে নেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই মরিয়া প্রত্যাঘাত করেছে প্যালেস্তাইনের গাজা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণকারী হামাস গোষ্ঠী।
প্যালেস্তাইনের প্রত্যাঘাত যে গাজা থেকে শুরু হয়েছে তা ২০০৫ পর্যন্ত সরাসরি ইজরায়েলি সামরিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। লাগাতার আন্তর্জাতিক চাপ এবং প্যালেস্তিনীয়দের লড়াইয়ের মুখে তারা সরে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে গাজাকে ‘দখলীকৃত এলাকা’ বলে চিহ্নিত করা হয় কেননা গাজাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। গাজার মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত, আকাশপথ ইজরায়েলের দখলে। প্যালেস্তাইনের অন্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গাজার মানুষকে যেতে হয় ইজরায়েলের অনুমতি নিয়ে। প্রতিনিয়ত সেখানে হামলা চালায় ইজরায়েলি বাহিনী।
যুদ্ধের এই বাতাবরণে যথারীতি ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলকে সহায়তা করার জন্য রণতরী পাঠিয়েছে। মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারও মার্কিন লেজুড়বৃত্তি করে কেবল ইজরায়েলের ওপর হিংসার নিন্দা করে তাদের পাশে থাকার কথা বলেছে। সাম্প্রতিক সংঘাতের পরে প্যালেস্তিনীয়দের কেবল ‘আক্রমণকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের একটানা প্রচার চলছে। আমাদের দেশের করপোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম একই কাজ করছে। অথচ ইজরায়েলের এত বছরের দখলদারি ও লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা সম্পর্কে নির্লজ্জ নীরবতা! এমনকী চলতি বছরেও যে আড়াইশ’ প্যালেস্তানীয়কে হত্যা করেছে ইজরায়েল তারও কোনো উল্লেখ নেই।
গাজায় হামাস এবং ইজরায়েলি বাহিনীর মধ্যে আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো। ৮ আগস্ট এক বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো হামলা এবং পালটা হামলার কড়া ভাষায় নিন্দার পাশাপাশি ভারত সরকার সহ রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে অবিলম্বে এই সংঘর্ষ বন্ধ এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাব রূপায়ণ সুনিশ্চিত করার আহ্বানও জানিয়েছে।
সংঘর্ষের জন্য ইজরায়েলের চরম দক্ষিণপন্থী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের সমালোচনা করে পলিট ব্যুরো বলেছে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক সহ প্যালেস্তাইন জুড়ে বেআইনি দখলদারি চালানো হচ্ছে। শনিবারের সংঘর্ষ শুরুর আগে, চলতি বছরে ৪০ জন শিশু সহ ২৪৮ জন প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে ইজরায়েলের দখলদার বাহিনী। পলিট ব্যুরোর দাবি, প্যালেস্তিনীয়দের জন্মভূমিতে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে। প্যালেস্তাইন জুড়ে থাকা অবৈধ ইজরায়েলি দখলদারদের হঠাতে হবে। এরই সঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানসূত্র অনুযায়ী ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী, প্যালেস্তাইনের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম শহর।
এরই পাশাপাশি, ভারত সরকার সহ রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর আহ্বান, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে রাষ্ট্রসঙ্ঘে গৃহীত ওই প্রস্তাব রূপায়ণ সুনিশ্চিত করতে হবে।
ইজরায়েলের বামপন্থী কোয়ালিশন হাদাস উভয় পক্ষেই রক্তপাতের নিন্দা করেই বলেছে, ‘‘আমাদের তরফে আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল নেতানিয়াহু সরকার প্যালেস্তিনীয়দের বিরুদ্ধে যে মনোভাব নিয়েছে তার এই রকম বিপর্যয়কর ফল হবে।’’
চীন উভয় পক্ষকেই সংযত হবার আবেদন জানিয়েছে। চীনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেছেন, বারংবার সংঘাত ঘটছে। এর থেকে প্রমাণিত হচ্ছে শাস্তি প্রক্রিয়াকে স্থগিত রাখা চলে না। এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার মৌলিক সূত্র হলো দুই রাষ্ট্রের সমাধানসূত্র। স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলের উচিত হবে দ্রুত শান্তি আলোচনা শুরু করা।
স্মরণে রাখা দরকার যে, ১৯৩০ এর দশক থেকে ব্রিটিশ শাসকদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ডে বিভিন্ন দেশের ইহুদিদের পুনর্বাসন শুরু হয়। এর আগেও ইহুদিরা এখানে থাকতেন, কিন্তু পরিকল্পিতভাবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ইহুদিদের নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির যে সিদ্ধান্ত ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে গৃহীত হয় তা থেকেই এ অঞ্চলে যাবতীয় সমস্যার সূত্রপাত। ১৯৪৮ সালের মে মাসে নবগঠিত ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী প্যালেস্তাইনের আরব অধ্যুষিত গ্রামগুলি আক্রমণ করে হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয়কে বাস্তুকরে এবং তাদের জমি ও সম্পত্তি দখল করে নেয়। এই ভয়ংকর ঘটনাকে প্যালেস্তানীয়রা গত ৭৫ বছর ধরে ‘‘নাকবা’’ (আরবি ভাষায় এর অর্থ বিপর্যয়) বলে স্মরণ করছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেব অনুযায়ী ইজরায়েলি আগ্রাসনের জন্য ৫০ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। গত ১৫মে রাষ্ট্রসংঘ ‘‘নাকবা’’র ৭৫ বর্ষ পূর্তি স্মরণ করে পুনরায় প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং ইজরায়েলি দখলদারির অবসানের লক্ষ্যে বার্তা দিয়েছে। যদিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদত পুষ্ট ইজরায়েল প্যালেস্তাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে নারাজ। জায়নবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল তার দখলদার ভূমিকা বজায় রেখেছে এবং আরব বংশোদ্ভূতদের নির্বিচারে হত্যা ও দমন করার পথ থেকে তারা কোনোভাবেই সরে আসতে চায় না। সাম্প্রতিকতম সামরিক সংঘর্ষ তাদের আত্মবিশ্বাসে কিছুটা চিড় ধরাতে পারলেও যতদিন না আন্তর্জাতিক উদ্যোগে প্যালেস্তাইনের মানুষের অধিকার এবং প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করা সম্ভব হবে ততদিন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি অধরা থাকবে।