E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০

কামদুনি - রাজ্য সরকার কি দোষীদের শাস্তি চায়?

মিনতি ঘোষ


২০১৩ সালের ৭ জুন। আকাশ মেঘলা। বিষণ্ণ মধ্যবেলায় কামদুনি গ্রামের প্রথম প্রজন্মের তৃতীয় বর্ষের এক কলেজ ছাত্রী ডিরোজিও মেমোরিয়াল কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তের ফলে একা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি ফিরতো না। ছোটো ভাই সাইকেলে বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসতো।

২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর সামাজিক জীবনের পরিবর্তন বলতে মূলত অপরাধীদের সংগঠিত হওয়া। দুষ্কৃতীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করে।

বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রামে ফেরার রাস্তার দু’ধারে ভেড়ি, কারখানা তৈরি করার জন্য পাঁচিল ঘেরা সংরক্ষিত বিরাট জমি। ভেতরে ছোটো ঘর। দশ বছর আগের চিত্র।

ওই রাস্তা পেরোতে গ্রামের অল্প বয়সি মেয়ে-বৌ’রা সদা সন্ত্রস্ত। রাস্তার ধারে লম্পট মাতালদের ঠেক।

সেদিন মেয়েটিকে একা পেয়ে নয়জন নৃশংস নারী মাংসলোভী অমানুষেরা সেই সুযোগকে কাজে লাগায়। ছোটো ঘরে নয়জন মিলে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে দুই পা চিরে পাঁচিলের অপর পাড়ে ফেলে দিয়েছিল। ধর্ষকদের পৌরুষ তৃপ্তি পেল একটি ফুটফুটে মেয়ের জীবন কেড়ে নিয়ে - যে স্বপ্ন দেখেছিল লেখাপড়া শিখে চাকরি করবে, সংসারকে বাঁচাবে।

গ্রামের মানুষ, পরিবার খুঁজে পেল জীবন্ত নয় ভয়ঙ্কর অত্যাচারিত ক্ষতবিক্ষত মেয়েটির লাশ। শিউরে উঠেছিল গোটা রাজ্য, দেশ।

গর্জে উঠেছিল কামদুনি। সেই গর্জনের অভিঘাত আছড়ে পড়লো সারা রাজ্যে। উত্তাল আন্দোলনে দিশাহারা মমতা সরকার। বিদ্বজ্জন, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মীরা রাস্তায়।

তৃণমূল কংগ্রেস দল, সরকার ঘটনাকে লঘু করার চক্রান্তে মাঠে নামলো। তাদের নেতারা ফুটবল প্রতিযোগিতা, পিকনিকের আসর বসালেন। মানুষ যখন জেগে ওঠে তখন কোনো চিত্তাকর্ষক নাটক তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। মানুষে-পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ। মৃতদেহ নিয়ে পুলিশে-মানুষে টানাটানি প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলার জনতা।

প্রবল বিক্ষোভকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে ময়দানে অবতীর্ণ স্বয়ং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তাঁকে দেখে আগুনে ঘৃতাহুতি পড়লো। কামদুনি সহ আশপাশের প্রতিবাদীরা ঘিরে ধরেছে তাঁর গাড়ি। ধর্ষিতার দুই বান্ধবী টুম্পা কয়াল, মৌসুমী কয়াল, মাস্টারমশাই প্রদীপ মুখার্জি সহ সবাই তখন বিচার চায় - শাস্তি চায়। প্রতিবাদীদের মাওবাদী, সিপিআই(এম) বলে দাগিয়ে দিলেন তিনি। অবরুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন যে, ১৫ দিনের মধ্যে অপরাধীরা চরম সাজা পাবে। সাথে নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি।

তবুও মানুষ মন থেকে কামদুনির নির্যাতিতার লাশ না পারল জ্বালিয়ে দিতে, না পারল মাটি চাপা দিতে।

ফলত, অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তির দাবিতে মিছিল, মিটিং, অবস্থান, কনভেনশনের পাশাপাশি প্রতি মাসের সাত তারিখে কামদুনির রাস্তায় জমায়েত হয়েছেন নাগরিক সমাজ। ধীরে ধীরে তাঁদের সংখ্যা হ্রাস পেলেও বামপন্থী মহিলা সংগঠন কিন্তু ধারাবাহিকভাবে অস্থায়ী শহিদ বেদিতে মালা দেওয়া, ঘটনাস্থলে মোমবাতি জ্বালানোর কাজটি করে গিয়েছে। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটি আইনি সহায়তার চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন কর্মসূচি সংগঠিত করেছে।

কবি শঙ্খ ঘোষের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে অগণিত প্রতিবাদী জনতার মহামিছিল। অসুস্থ কবি মানবতার দাবিতে রাস্তায়, পতাকাবিহীন সেই মিছিল প্রত্যক্ষ করেছে তিলোত্তমা কলকাতা।

আইনি লড়াই চলতে থাকল। তিন বছর পর ব্যাঙ্কশাল কোর্টে রায় ঘোষণা। নৃশংস, বিরলতম ঘটনায় বিচারক সঞ্চিতা সরকারের তিনজনের ফাঁসির সাজা, তিনজনের আমৃত্যু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তিতে।

অভিযুক্তরা প্রভাবশালী। ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তারা হাইকোর্টে গেল। এই সময়কালে ১২ জন সরকারি আইনজীবী বদল, ১৬ বার কৌসুলির পরিবর্তন, ৫৫ জন সাক্ষীর বয়ান যথাযথ না নেওয়া, নথিবদ্ধ না করার মতো কাজটি চলতে থাকলো। তথ্য প্রমাণ লোপাটের সাথে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, মেডিক্যাল রিপোর্ট বিকৃত করা হলো। সিআইডি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পুলিশের ভূমিকা অন্যান্য কেসের মতো এখানেও অপরাধীদের পক্ষে।

এই বিরলতম মামলাটির প্রতি রাজ্য সরকারের ‘ইচ্ছাকৃত’ চরম উদাসীনতা সরকারকে আজ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

এখন গোড়া কেটে আগায় জল দেবার নাটক করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে সরকার।

২০২৩ সালের ৬ অক্টোবরের এই রায়ে সবাই স্তম্ভিত। একজন ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামীর বেকসুর খালাস হয় কী করে? অপর এক ফাঁসির আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, একজনের ফাঁসির পরিবর্তে ৭ বছরের জেল। যেহেতু ইতিমধ্যে তারা দশ বছর ‘জেলে’ কাটিয়েছে অতএব তারাও বেকসুর খালাস।

এই ‘একুশে আইন’ আবার বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। কারণ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের রায়কে প্রায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলেছে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অপরাধীদের রক্ষা করতে মমতা ব্যানার্জি সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, অথচ এই কেসটি অদক্ষ আইনজীবীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সিআইডি-পুলিশ-সরকারি আইনজীবী-সরকারি কৌসুলিদের যৌথ পরিকল্পনায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘অহং’ রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু নির্যাতিতা বিচার পেল না!

দিল্লিতে ‘নির্ভয়া’ কিন্তু বিচার পেয়েছে। নিম্ন আদালতের রায় হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে বহাল থেকেছে।

এই রায়ের পর আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০২ সালের ৩ মার্চ আহমেদাবাদের কাছে রন্ধিকপুর গ্রামে বিলকিস বানো নামে ২১ বছরের একজন তরুণী অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ, মা এবং বোন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। গোধরার ঘটনায় উত্তপ্ত গুজরাট। গুজরাট থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তার তিন সন্তান নিহত হয়। ১১ জন মিলে ধর্ষণ করে। মামলাটি গুজরাটে হয়নি। ২০০৮ সালের ২১ জুলাই মুম্বাইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।

এই ঘটনায় উত্তাল হয়েছিল সারা দেশ। স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর উদ্‌যাপনে ‘অমৃত মহোৎসবে’ মেতে উঠেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই আনন্দ উদ্‌যাপনে ১১ জন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে গোধরার সাবজেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশ। ‘হাথরস’ও বিচার পায়নি।

কি আশ্চর্য সমাপতন! মোদি-দিদির দুই রাজ্যে অপরাধীরা মুক্ত বিহঙ্গ। দু’জনেরই রাজনৈতিক পাঠশালা নাগপুর। সাধারণ মানুষ বিশেষত কামদুনির মানুষ আতঙ্কিত। প্রশ্ন এখানেই! ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামী কীভাবে বেকসুর খালাস পায়?

ফুলের মালা পরে বিজয়ীর বেশে ধর্ষণকারীরা বাইরে বেরিয়ে এসে বীরের সম্মান পায়, আবার নজিরবিহীনভাবে এই রাজ্যে খালাসপ্রাপ্তরা কোর্ট চত্বরের ভেতরে রাখা এসইউভি গাড়ি চেপে উধাও হয়ে যায়। কারোর কি বুঝতে বাকি থাকে কোন প্রভাবশালীরা ধর্ষকদের পক্ষে? পুলিশ কী করছিল? জবাব মিলবে না।

যে রাজ্যে ধর্ষিতার রেটচার্ট বেঁধে দেওয়া হয়, পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় ধর্ষিতাকে ক্লায়েন্ট বলে সম্বোধন করেন মাননীয়া সাংসদ, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ‘ছোট ঘটনা’ ‘সাজানো ঘটনা’, ‘ছোটো ছোটো দুষ্টুদের কাজ’ বলে ধর্ষকদের পক্ষে দাঁড়ান, সে রাজ্যে ধর্ষিতা বিচার পাবে না। অথচ প্রতিদিন ঘটে চলেছে এমন ঘটনা।

পুরুষতন্ত্র আজ দেশ ও রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। নারীদের হীন প্রতিপন্ন করার দর্শন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাজ করছে। অর্থ শক্তি, পেশি শক্তি আজ রাজনীতির নীতি নৈতিকতাকে গ্রাস করছে।

‘‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে,
মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।’’


কবি লিখেছিলেন হতাশা থেকে।

আমাদের জীবনে হতাশার কোনো স্থান নেই, নারী নিরাপত্তা, নারী অধিকারের দাবিতে আমরা রাস্তায় ছিলাম, আছি, থাকবো।

আমরা কামদুনির সাধারণ মানুষের, পরিবারের, প্রতিবাদীদের সর্বাত্মক নিরাপত্তা চাই। চাই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।