৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০
বিচার হবে জনতার আদালতে
সুব্রত দত্ত
রাজ্যের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গত দশবছরে যত ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, যারা দুর্নীতি করেছে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সকলে শাস্তি পাবে। আবার জনতার এক অংশের ধারণা হলো এই দুর্নীতিগুলির মূল মাথায় যেহেতু প্রভাবশালী, তাই তাঁদের কিছু হবে না। এই দু’টি ধারণা বা মনোভাবই জনমনে আছে। প্রথম ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক আশা যার সঙ্গে আমরা একমত। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রের মনোভাবের সঙ্গে আরও কতগুলি কথা অবধারিতভাবে চলে আসে তা হলো, শুধুমাত্র প্রভাবশালী বলেই কি তারা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী অফিসারদের আর্থিকভাবে প্রভাবিত করল, নাকি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য তদন্তকে দিশাহীন করল।
প্রথমত, ‘সারদা’ তদন্তের ভার বিকাশ ভট্টাচার্যরা সুপ্রিম কোর্ট থেকে যখন সিবিআই’র হাতে দেবার ব্যবস্থা করল, তখন রাজ্যের গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষ মায় তৃণমূলের মাথারাও ভেবেছিল জেলে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা। মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে মিটিং করলেন, বললেন মুকুল চোর, সজল চোর, কুণাল চোর, টুম্পাই চোর ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা দল, ঘুরিয়ে জনগণের কাছে সাফাই গাইলো। ওদের মনে ভয় ছিল দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছে, যদি দিল্লির সরকার সিবিআই-কে নিয়ন্ত্রণ না করে, যদি সিবিআই আপনগতিতে এগিয়ে যায় তাহলে সারদার সবচেয়ে বড়ো সুবিধাভোগী (Beneficiary) সিবিআই-এর জালে চলে আসতে পারে। প্রসঙ্গত, এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, এবছর আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সংসদের বাদল অধিবেশনে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে (গোড্ডা, ঝাড়খণ্ড) সংসদে বলেন, আমরা সারদা মামলা সিবিআই-কে দেইনি, কংগ্রেস দিয়েছে, তখন আমরা সরকার চালাতাম না। উনি আরও বলেন, নারদাও আমরা করিনি বরং আমাদের নেতা রাজনাথ সিং সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় মমতা ব্যানার্জি আপনার সঙ্গে ছিলেন, মানে বাংলাতে তৃণমূল সরকার তৈরি করতে আমাদেরও ভূমিকা ছিল। ২০১৪ সালে দিল্লিতে সরকার বদল হয়ে গেল, সিবিআই তদন্ত আর এগোলো না। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর অপরাধের সব তথ্যই, তাঁর তৈরি সিআইটি-র দুই গুরুত্বপূর্ণ অফিসার রাজীব কুমার এবং অর্ণব ঘোষ হাওয়া করে দিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষের টাকা হজম করে তৃণমূলের নেতারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটা বড়ো নেতা বেসরকারি হাসপাতালের ভিআইপি স্যুটে কারাবাস করেছে, ব্যাস এই পর্যন্ত। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মমতা বলেছিলেন, সারদার টাকা ফেরত পেতে আমাদের ভোট দিন। তখন একদিন ছিল রাজ্যের মানুষ তাঁদের সব সমস্যা সমাধানের জন্য অবলম্বন মনে করেছিল মুখ্যমন্ত্রীকে, জনতা ভোট দিয়েছিল,কিন্তু সারদার টাকা তাঁদের হাতে ফিরলো না। আমরা বলেছিলাম টাকা মেরেছে তৃণমূল, ওরা টাকা ফেরাতে পারবে না। সারদা থেকে রোজভ্যালি হয়ে এমপিএস’র কোটি কোটি টাকা কর্পূরের মতো উবে গেল। সুদীপ্ত সেন, গৌতম কুণ্ডুরা জেলে রইলো, আর মমতা-শুভেন্দুরা বহাল তবিয়তে নতুন নতুন নাটক নিয়ে আমার আপনার কাছে হাজির হচ্ছেন। ‘আগে যদি জানতাম, তাহলে টিকিট দিতাম না’ - ২০০৬ নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সারা দেশের মানুষ দেখেছে তৃণমূলের নেতারা - তরুণ তুর্কি শুভেন্দু থেকে অপরূপা পোদ্দার হয়ে প্রবীণ সৌগত রায় কীভাবে হাত পেতে টাকা নিচ্ছেন। পা টলে গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর, এবার সামনে ‘লৌহ পুরুষ’ আদবানি। সাংসদরা হাত পেতে টাকা নিচ্ছেন, সংসদের গরিমার প্রশ্ন, অনৈতিক কাজ, তাই প্রয়োজন ছিল সংসদের এথিক্স কমিটিতে এই বিশাল দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করার। কিন্তু বরিষ্ঠ সাংসদ লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বাধীন সেই কমিটি একবারের জন্যও বসলো না! তৃণমূলের সাংসদদের রক্ষায় অবতীর্ণ হলেন লালকৃষ্ণ আদবানি! নারদার তদন্তেও সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। আবার রাজ্যের মানুষ আশায় বুক বাঁধলেন। তাঁদের আশা, এবারের চুরি চোখে দেখা গেছে, তাই দোষীরা ধরা পড়বেই। কিন্তু না, তা হলো না, এখনো অপরাধীরা কেউ ধরা পড়লো না! রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা, সামনে এলো সিবিআই দিয়েও কিছু হবেনা - এই মনোভাব, আর রাজ্যের গণতান্ত্রিক মানুষের স্বপ্নভঙ্গ। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা সমস্ত বিষয়কে নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
পরবর্তীতে অনেকগুলি দুর্নীতি সামনে চলে এলো - কয়লা, গোরু পাচার, চাকরির নিয়োগ দুর্নীতি অন্যদিকে ন্যায্য চাকরি প্রার্থীদের নাগাড়ে ধরনা। আবাস যোজনা, একশ’ দিনের কাজ - সবক্ষেত্রেই দুর্নীতি। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার কেবল কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না তাই নয়, সব দুর্নীতি আড়াল করছে। রাজ্যবাসী দেখছেন একদিকে কলকাতা হাইকোর্ট সবক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে তদন্তের ভার দিয়ে দিচ্ছে, শুধু তাই নয়, তদন্তের অগ্রগতির খতিয়ান কোর্টকে দিতে নির্দেশ দিচ্ছে। এমন নির্দেশ দেওয়া মানে কোর্টের তত্ত্বাবধানে (কোর্ট মনিটরিং) তদন্ত। যতগুলিতে এরকম হয়েছে, সবগুলিতেই রাজ্য সরকার কলকাতা হাইকোর্ট-এর নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে। কেন? কোর্ট তদারকিতে তদন্ত হলে অসুবিধা কোথায়? রাজ্যের শাসকদলের যুবরাজ প্রায় রোজ সুপ্রিম কোর্ট-এ বিভিন্ন বেঞ্চে ঘুরেছেন, রক্ষাকবচের জন্য। কেন? ভয় কোথায়, অসুবিধা কী? আমরা অনেকদিন ধরেই বলছি সেটিং আছে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে না।
প্রথমে বাজপেয়ী ভালো - আদবানি খারাপ, তারপর আদবানি ভালো - মোদি খারাপ হয়ে এখন মোদি ভালো অমিত শাহ খারাপ! এখন জি-২০-এর নৈশভোজে অমিত শাহ – যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে একসাথে বসে রফা করা - কোনোটাই রাজ্যবাসীর চোখ এড়ায়নি। যতো আমরা বলেছি সেটিং আছে, রাজ্য বিজেপি নেতারা তারিখের পর তারিখ বলেছে। সব নাকি জালে চলে এসেছে। শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। করপোরেট মিডিয়াকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে জেমস বন্ডের সিনেমার ঢঙে। ইডি এবং সিবিআই অফিসাররা বিদেশে যাচ্ছে, সেখানে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করছে। ভানুয়াতুতে নাকি বিনয় মিশ্র কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতেই আছে, রাজ্য বিজেপি নেতাদের এইরকমই আচরণ, ভাবটা এমন যেন সবই হাতে, শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। আমরাও বলছি হ্যাঁ অপেক্ষা, কিন্তু কীসের অপেক্ষা। কেউ কেউ ভাবছেন যা বিজেপি তাই টিএমসি। তা নয়, তবে বিজেপি সুবিধাজনক সময়ের অপেক্ষা করে, বাংলার স্বপ্নকে চিতায় তুলতে তৃণমূলকে অক্সিজেন সরবরাহ করছে মোদি-শাহরা।
বিজেপি বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি, আরও নির্দিষ্ট করে বললে কেন্দ্রীয় সরকার অপরাধীদের শাস্তি দিতে চায় না। ওরা চায় কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে দিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করতে। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে একটু অসুবিধা হয়ে গেছে এখানে তদন্ত হচ্ছে কোর্ট মনিটরিংয়ে। আমরা যে কথা বলে আসছিলাম সেটিং আছে সেটিং, এখন বিচারপতিরা অনুভব করছেন। পরপর সিবিআই, ইডি, সিট-এর অফিসার বদল করছেন মাননীয় বিচারপতিরা। গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সপ্তাহে আরএসএস ঘনিষ্ঠ পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে এ রকম ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, রাজনৈতিক কারণেই বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, তাঁর পরিবারের কাউকেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি ছোঁবে না। রাজ্যের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস তৃণমূল মানেই চোর। কিন্তু বিজেপি হাওয়া শেষ, বিজেপি তৃণমূলের জায়গায় আসবে না। তাই এখন তৃণমূলকে আরও অক্সিজেন দাও, আর এই প্রচার নির্মিত করার সুযোগ দাও - তদন্ত তো কিছুই হলো না, ফলত কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু বাদসাধছেন বিচারপতিরা।
কর্ণাটকের ভোটে হেরে যাওয়ার পর দিল্লি সরকার সিবিআই’র ডাইরেক্টর করে এনেছে প্রভীন সুদকে, যিনি ছিলেন বেঙ্গালুরু ও মহীশূরের পুলিশ কমিশনার। এই সুদ বিজেপি’র বিশেষ আস্থাভাজন পুলিশ অফিসার। আরও নির্দিষ্ট করে সিবিআই-কে পরিচালনা করার জন্য এই ব্যবস্থা। গত ডিসেম্বরের আরএসএস ঘনিষ্ঠ পত্রিকার ইঙ্গিত, পরবর্তীতে ডেকান হেরাল্ড, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এমনকী টেলিগ্রাফ পত্রিকাতেও গত ডিসেম্বরের মধ্যভাগে এই সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কোনো স্তর থেকেই কোনো প্রতিবাদ আসেনি। বাংলার মানুষের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হতে শুরু করেছে, বিজেপি তৃণমূলকে কিছু করবে না।
২০২৩–এর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহেও আরএসএস ঘনিষ্ঠ পত্রিকা ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো কেন রক্ষা কবচের জন্য বারবার কোর্টে যাচ্ছে তাতে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে। মানুষ বিশ্বাস করছে নিশ্চয় দুর্নীতি হয়েছে, না হলে বার বার কোর্টে কেন? যেটা লেখা হয়নি, যেটা between the lines-এ আছে তা হলো, জানে তো গ্রেপ্তার হবে না, জানে তো লোক দেখানো, শুধু ভাগ হবে তাও আবার অন্য কর্মসূচির দিন টিআরপি বাড়ানোর জন্য। আর কিছু হবে না জেনেও এই রকম অবিবেচকের মতো ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে, মানুষ এটা ভালোভাবে দেখছে না। জানি না সংঘ পরিবারের এই উপদেশ ব্যানার্জি পরিবারের নবাব শুনবে কিনা। কিন্তু এখানেই কাহিনি শেষ হবে না।
জানি টিএমসি-বিজেপি’র সম্পর্ক অম্লমধুর, সহমত ও সমঝোতার, রাজনৈতিক সেটিংয়ের। জানি, যেকোনোভাবেই হোক করপোরেট কমিউনাল আঁতাত রক্ষা করার রাজনৈতিক স্বার্থের সম্পর্ক থাকবেই। এটাও জানি সত্য সামনে আসবেই, অপরাধীরা শাস্তি পাবেই, হয় আদালতে, না হলে জনতার আদালতে।