৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০
জাতীয় গরিমা প্রচারের আড়ালে গণতন্ত্রের নিধন
প্রসূন ভট্টাচার্য
নিউজক্লিক-এর ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত নাকি বিশ্বগুরুর মর্যাদা লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় এমনটাই প্রচার করছে ভারত সরকার। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় এবং তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের যুগ্মসভায় মোদি ভাষণ দিয়ে দাবি করেছেন, ভারতই নাকি গণতন্ত্রের জননী, ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসি’। মোদির দাবি, গণতন্ত্র সম্পর্কে ভারতের অন্য দেশের থেকে শেখার কিছু নেই, ভারতের থেকেই অন্যদের শেখার আছে। কারণ হিসাবে মহাভারত এবং বেদের থেকে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তিনি বলেছেন, প্রাচীন ভারত থেকেই নির্বাচিত নেতৃত্বের হাতে শাসনভার দেওয়ার প্রচলন ছিল। শুধু শাসনকাঠামোতেই নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছিল ভারতে, অতএব ভারতের দর্শন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’।
ভারতবাসী হিসাবে এসব শুনতে আমাদের হয়তো বেশ লাগে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্দেশ্যে মোদির এই প্রচার তা কি আদৌ বিশ্ববাসীর মনে দাগ কেটেছে? সত্যিই কি মোদি সরকারের কার্যকলাপে বিশ্বের দরবারে ভারতের মানমর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে? বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব প্রতিপত্তি কি বৃদ্ধি পেয়েছে?
বিখ্যাত সমীক্ষক সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের গত আগস্ট মাসে প্রকাশিত একটি সমীক্ষার তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাক। ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ সহ ১৯টি দেশের মানুষের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে তারা দেখেছে যে, মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন ভারতের শক্তি ও প্রতিপত্তি মোদির আমলে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন নয় যে, এই বিদেশিরা ভারতের প্রতি বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন। বরং সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৬ শতাংশই ভারতের প্রতি সমর্থনমূলক মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু মোদি বিশ্বের জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছেন এমনটা আদৌ মনে করেন না। এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ৫১ শতাংশ মানুষ ভারতের প্রতি সমর্থনমূলক মনোভাব রাখলেও প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন মাত্র ২১ শতাংশ। মোদিভক্তদের বিশ্বাস করানোও কঠিন হতে পারে, কিন্তু সমীক্ষা বলছে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি মার্কিন নাগরিকদের ৫৯ শতাংশ নরেন্দ্র মোদির নামই শোনেননি। পুতিন, শি জিন পিং, নেতানিয়াহু, জেলেনেস্কি, ম্যাঁক্র, পরিচিতির নিরিখে সবাই মোদির থেকে অনেক এগিয়ে।
সোজা কথায়, বিশ্বগুরু প্রচার অথবা মাদার অব ডেমোক্র্যাসি প্রচার যাই হোক না, বিশ্বের দরবারে ভারতের প্রভাব প্রতিপত্তি, শক্তি এবং মর্যাদা বৃদ্ধির কোনোটাই বাস্তবে ঘটেনি। এমনকী সমীক্ষা রিপোর্ট ছাড়াই আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই যে, বৃদ্ধির বদলে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েই চলেছে ভারতের। সাম্প্রতিক কানাডার সঙ্গে বিরোধেও সেটা দেখা গেছে। অতীতে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে সেখানে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে মুখ খুলেছিলেন মোদি যা ভারতের মর্যাদাকে বিশ্বের দরবারে ক্ষুণ্ণ করেছিল। এখন আমেরিকার হোয়াইট হাউসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পরে সাংবাদিক বৈঠক করতেও আপত্তি করেছিলেন মোদি। মার্কিন রাষ্ট্রপতির চাপে শেষপর্যন্ত এই শর্তে সাংবাদিক বৈঠক করেন যে মাত্র দু’টি প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক মার্কিন নাগরিক সাবরিনা সিদ্দিকি সাংবাদিক বৈঠকে মোদিকে প্রশ্ন করেছিলেন ভারতের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও মানবাধিকার নিয়ে। এরজন্য মোদিভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়াতে ওই সাংবাদিককে এমন ট্রোল করেছে যে, আমেরিকা জুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে। দিল্লিতে সদ্য জি ২০ সামিট অনুষ্ঠিত হলো বটে, মোদি তা নিয়ে ব্যাপক প্রচারও করলেন বিপুল খরচে। কিন্তু রাশিয়া এবং চীন দু’টি দেশের শীর্ষ নেতারা এলেনই না সামিটে। জি ২০ সামিটে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন যখন ভারতে এলেন, মোদির সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছিলেন তিনি। তখনও বাইডেনকে দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করতে দেওয়া হয়নি। পরদিন ভারত ছেড়ে ভিয়েতনামে নামেন বাইডেন। এবং প্রথম সুযোগেই সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়ে দেন ভারতে মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের অধিকার নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছেন মোদির কাছে। এটাই যদি বিশ্বের চোখে ভারতের মর্যাদা হয়ে থাকে তাহলে ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসি’ কিংবা ‘বিশ্বগুরু’ প্রচারে লাভ কী? মোদি ক্ষমতায় বসার আগেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ভারতকে ‘উদীয়মান নয়, ইতিমধ্যেই উত্থিত দেশ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। মোদি এখন বিশ্বের আঙিনায় ভারতের মর্যাদা আদৌ বাড়ালেন কই!
তাহলে মোদির এই প্রচারকে কি নিষ্ফলা বলে দেওয়া যায়? কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, না। প্রচার আন্তর্জাতিক আঙিনায় হলেও আসলে তা হচ্ছে ভারতের অভ্যন্তরীণ জনমত তৈরির লক্ষ্যে, এবং ভারতের জনমতে তার প্রভাবও পড়ছে। মোদি এবং তাঁর হিন্দুত্বের রাজনীতির হাত ধরে ভারত অর্থনৈতিকক্ষেত্রে কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আদৌ শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারলেও, বৈদেশিক মিত্র বাড়াতে না পারলেও ভারতবাসীর মনে হচ্ছে সেটাই যেন ঘটছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের পূর্বোল্লেখিত সমীক্ষাতেই দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ ভারতবাসীই মনে করছেন মোদির হাতে দেশের আন্তর্জাতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়েছে। ২০২৩ সালেই ‘সিএসডিএস লোকনীতি’র সমীক্ষাতেও তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। অর্থাৎ মোদির আচরণ বিদেশের মাটিতে হলেও প্রচার আসলে হচ্ছে এদেশের ভিতরেই, ভারতবাসীর মতামত গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
বিষয়টা খুবই গুরুতর রকমের বিপজ্জনক। বাইরে যখন ঝড়বৃষ্টি -সাইক্লোন বাড়ছে তখন আপনি মনোরম আবহাওয়া কল্পনা করে প্রাতঃভ্রমণে বেরোচ্ছেন। কারণ গোদি মিডিয়া আপনাকে সেরকমই জানাচ্ছে, শেখাচ্ছে।
অথচ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, বৈদেশিক নীতিতে ভারতের অতীত এমন নয়। সদ্য স্বাধীন ভারতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীরা ভারতকে উন্নয়নশীল দেশগুলির আশা আকাঙ্ক্ষায় নেতৃত্বের মর্যাদায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। যখন বিশ্ব রাজনীতিতে ঠান্ডা লড়াই চলছিল সোভিয়েত এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন দুই শিবিরে, তখন ভারত দুই শিবিরের কোনোটাতেই যোগ না দিয়ে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে শামিল করতে সফল হয়েছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের পরিচয় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ থেকে কিউবা, ভিয়েতনাম, প্যালেস্তাইন, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের সংগ্রামে সংহতি ও সহমর্মিতা জানানোর জন্য। পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমি দেশগুলির ওপরে নির্ভরতার বদলে প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্বের পথে শক্তি অর্জন করা, উন্নয়নশীল দেশগুলির পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিশ্ব শান্তির জন্য উদ্যোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাফল্যের কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে জওহরলাল নেহরুর নাম। এরজন্য জওহরলাল নেহরুকে ‘বিশ্বগুরু’ সাজার মতো কোনো ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিতে হয়নি। ভারতের মর্যাদা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রকৃতপক্ষেই বেড়েছিল। বামপন্থীরা ভারত সরকারের বহু নীতির বিরোধিতা করেছে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, কিন্তু দীর্ঘদিন ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতিকে প্রকাশ্যে সমর্থনই জানিয়েছে। আর আজকে পশ্চিমি বিশ্বের কথা বাদই রাখলাম, ভারতের ছোটো ছোটো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও ভারত সরকারের প্রতি সন্দেহ বাড়ছে, ভারতের ওপরে নির্ভরতার বদলে তারা অন্য পথ বেছে নিলে সেটা কি ভারতের সুরক্ষার পক্ষেও ভালো হবে?
আসলে মোদি ঠিক সেটাই প্রচার করতে চাইছেন যা অসত্য। যা তিনি প্রচার করছেন আর যা তিনি করছেন দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে গত ২৫ জুন জরুরি অবস্থার বার্ষিকীতে মোদি ট্যুইট করে বলেছিলেন, ‘যে সব সাহসী মানুষ জরুরি অবস্থাকে প্রতিহত করেছিলেন এবং আমাদের গণতান্ত্রিক ভাবনাকে শক্তিশালী করতে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের সকলের উদ্দেশে আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমাদের ইতিহাসে জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলির সবসময়ই উল্লেখ থাকবে, যা আসলে আমাদের সাংবিধানিক মূল্যবোধের বিপরীত।’ সেই মোদিই ভারতে সাংবাদিকতার ওপরে এমন নতুন আক্রমণ নামিয়ে এনেছেন যা জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী থেকে সাংবাদিক, মোদি সরকারের সমালোচনা করলেই একের পর এক আইনি ধারার অপপ্রয়োগে কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারই সর্বশেষ নিদর্শন ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম নিউজক্লিকের ওপরে আক্রমণ। দু’শো পুলিশ কর্মীকে নিয়োগ করে মোদি সরকার কয়েকদিন আগেই দিল্লি সহ পাঁচ শহরে নিউজক্লিকের ৪৬ জন সাংবাদিকের বাড়ি ও কর্মস্থলে তল্লাশি চালিয়েছে। গ্রেপ্তার করেছে নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং সংস্থার ম্যানেজমেন্ট আধিকারিক অমিত চক্রবর্তীকে। ৪৮ বছর আগে, প্রবীর পুরকায়স্থ তখন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জরুরি অবস্থার সময়ে। গ্রেপ্তারির এই পুনরাবৃত্তি যেন জরুরি অবস্থারই সতর্কবার্তা দিচ্ছে। দ্য হিন্দু পত্রিকার প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক এন রাম বলেছেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিদিনই নতুন করে তলানিতে নামছে। তলানি থেকে আরও তলানিতে। আমার মনে হয় এটা জরুরি অবস্থার সঙ্গেই তুলনীয়।
ভারতে এখন মানবাধিকার আক্রান্ত, বিরোধী রাজনীতিক সহ সমস্ত প্রতিবাদীরা আক্রান্ত, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আক্রান্ত। ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে যতই চিৎকার হোক, ভারতে এখন গণতন্ত্রই আক্রান্ত। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে প্রেস স্বাধীনতার মান উল্লেখ করে তালিকা প্রকাশ করে। গত কয়েকবছর ধরে ওই তালিকায় ভারতের স্থান নামতে নামতে এখন ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১ নম্বরে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থায় গণতন্ত্র রক্ষায় আক্রান্ত সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের প্রতি সংহতি জানানো এবং প্রতিবাদই প্রত্যাশা নাগরিক সমাজের কাছে। কারণ, স্বাধীন সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ। সেই স্তম্ভ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সাংবাদিকদের নয়, সমগ্র জনসমাজের। রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমের ডিরেক্টর রামসুস ক্লিস নিয়েলসন কয়েকবছর আগেই খেদোক্তি করে বলেছিলেন, ভারতের মিডিয়া নিঃশব্দে মাথা নিচু করে ফেলেছে শাসকের কাছে। মিডিয়ার স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিক এবং জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে হয়। নিজেদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের বলে গর্ববোধ করার কোনো অধিকার আপনার নেই যদি তাকে রক্ষা করার জন্য সক্রিয় না থাকেন। ভারতের পূর্ববর্তী প্রজন্ম ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সেই দৃষ্টান্ত দেখাতে পেরেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মকেও সেরকমই কোনো লড়াই করতে হবে মিডিয়ার নুইয়ে পড়া মাথাকে ওপরে তোলার জন্য।