৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০
হিমালয়ে মনুষ্যকৃত বিপর্যয়
তপন মিশ্র
গত ১৮ সেপ্টেম্বর মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশে বলেন যে, দেশের হিমালয় অঞ্চলের ‘বহন ক্ষমতা’ (carrying capacity)-র উপর একটি ‘‘সম্পূর্ণ এবং ব্যাপক’’ অধ্যয়ন পরিচালনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। এই বিশেষজ্ঞ কমিটি পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে আদালতকে জানাবে যে, ইতিমধ্যে হিমালয় তার ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করছে কি না? উন্নয়নের নামে হিমালয়ে যে সমস্ত কর্মকাণ্ড চলছে তাকে সহ্য করার ক্ষমতা হিমালয়ের আছে কি না? সম্ভবত আমাদের দেশে সর্বোচ্চ আদালতের ইতিহাসে দেশের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পরিবেশরক্ষা সম্পর্কে এই ধরনের নির্দেশ প্রথম। যেখানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন সাম্প্রতিক সময়ে বিধ্বংসী ঘটনাসমূহের সৃষ্টি করেছে, মাননীয় আদালত মনে করছে যে, এটি একটি ‘‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা’’। ভারতীয় হিমালয় অঞ্চলে যে ১৩টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত সেগুলি হলো - পশ্চিম হিমালয়ের জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ। পূর্ব হিমালয়ের রাজ্যগুলি অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, ত্রিপুরা, আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ। এই অঞ্চলের পুর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃতি প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার।
ধারণ ক্ষমতা বা ক্যারিং ক্যাপাসিটি কী?
আমাদের সামনে খুব পরিচিত একটি বিতর্ক হলো - পরিবেশ রক্ষা বনাম উন্নয়নের দ্বন্দ্ব। কেউ কেউ মনে করেন এই দ্বন্দ্ব সমাধানযোগ্য নয়। যুক্তি ও বিজ্ঞানের পদ্ধতির উপর যারা ভরসা রাখেন, তাদের দৃঢ় ধারণা হলো এটি একটি সমাধানযোগ্য দ্বন্দ্ব। সম্ভবত সেই কারণেই মাননীয় সর্বোচ্চ আদালতের এই গবেষণাধর্মী এক সমীক্ষার নির্দেশ।
এটি একটি সাধারণ ধারণা যে, যদি পৃথিবী বা পৃথিবীর কোনো অংশে মানুষের কর্মকাণ্ড ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করে তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য। কিন্তু ধারণ ক্ষমতার সঠিক ব্যাখ্যা এখনও অমিল। অতি সহজ করে বললে দাঁড়ায়, “বহন ক্ষমতা হলো সর্বাধিক জনসংখ্যার আকার যা একটি বাস্তুতন্ত্রকে অবক্ষয় ছাড়াই টিকিয়ে রাখতে পারে।”
কিন্তু জনসংখ্যার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের তারতম্য এই সময়কালে একটি বড়ো প্রশ্ন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই বিভাজন ধারণ ক্ষমতার এই সংজ্ঞা দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। উন্নয়ন যদি কতিপয় মানুষের জন্য হয়, তাহলেই পরিবেশ রক্ষা বনাম উন্নয়নের দ্বন্দ্ব এক অন্য মাত্রা নেবে। প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা পরিবেশ রক্ষা বনাম উন্নয়নের বিতর্ক-কে সমাধানের অযোগ্য বলে মনে হয়। কিন্তু বামপন্থীরা মনে করে যে, এই দ্বন্দ্ব সমাধানের যোগ্য যার প্রাথমিক শর্ত হলো বাস্তুতান্ত্রিক সম্পদের (ecological resource)-এর সমবণ্টন।
আলমোড়ার জি বি পন্থ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হিমালয়ান এনভায়রনমেন্ট ইতিমধ্যে ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে একটি পদ্ধতি তৈরি করেছে বলে মাননীয় উচ্চ আদালতকে জানানো হয়েছে। এই পদ্ধতি কতটা সর্বজনগ্রাহ্য তা বিজ্ঞানীদের বলতে হবে। তবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে অনেক দক্ষ পরিবেশ এবং বিশেষকরে বাস্তুতন্ত্র বিশেষজ্ঞ আছেন তাঁদেরও এই কাজে যুক্ত করা জরুরি।
ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ মালথস (Thomas Robert Malthus) ১৭৯৮ সালে ‘Principles of Population...’ নামে একটি বই লিখে প্রমাণ করতে চান, যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবী তার ধারণ ক্ষমতা হারাবে। কিন্তু কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস মালথসের এই অনুমান খণ্ডন করেন। মালথসের ২০০ বছরের পরও তাঁর তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত হয়নি। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৮৩৮ সালে ধারণ ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে বেলজিয়ান গণিতবিদ ভারহুলস্ট (Pierre François Verhulst) একটি সমীকরণ প্রবর্তন করেন। তিনি তাঁর অনুমান প্রমাণ করার জন্য বেশ কয়েকটি দেশের, বিশেষকরে বেলজিয়ামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য ব্যবহার করেন। ভারহুলস্ট- এর এই সূত্র ১৯২০ সালের আগে কেউ ব্যবহার করেনি। ১৯২০ সালে এই সূত্র পুনরাবিষ্কৃত হয়। এই সূত্র কেবল কোনো একটি নিদিষ্ট অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এবং সে কারণে যে crowding effect (যেখানে কেবল একটি প্রজাতির সংখ্যার ভিত্তিতে হিসেব করা হয়)-কে বিবেচনার মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পর্যটন ইত্যাদি সহ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন জল, বায়ু, মৃত্তিকা, অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন উপাদান (উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণ), অরণ্যের উপর নির্ভরশীল মানুষ, গবাদি পশুচারণের চাপ, হিমালয়ের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের বিশেষত্ব, পরিবর্তনশীল কৃষি পদ্ধতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি আলোচিত হবে তখন এই সূত্র কীভাবে কাজ করবে তা গবেষণার বিষয়। ২০১৮ সালে চীনের এস এফ ওয়াং সহ আরও তিনজন গবেষক বাস্তুতান্ত্রিক ধারণ ক্ষমতা (ecological carrying capacity)-র কয়েকটি পদ্ধতির উল্লেখ করেন এবং সেগুলির কার্য়কারিতার বিচার করেন। এই সমস্ত গবেষণা হয়েছে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে। কিন্তু মানুষের বিভিন্ন অত্যুৎসাহী কর্মকাণ্ডের প্রভাব সম্পর্কিত ধারণ ক্ষমতার গবেষণা কি হবে সেটাই একটি প্রশ্ন। আবশ্যকতা ছিল ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টস) বা পরিবেশ অভিঘাত কতোটা হবে তা হিসাব করে উন্নয়নের পরিকল্পনা করা।
হিমালয় নিয়ে সরকারি দ্বিচারিতা
হিমালয় জুড়ে থাকা দেশের ১৩টি রাজ্যে, বিশেষকরে পশ্চিম হিমালয়ের জোশিমঠের মতো শহর বা জনপদগুলিতে যে মনুষ্যকৃত বিপর্যয় আমরা লক্ষ করছি তাতে মানুষের সম্পদ ও জীবনহানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সিকিমে সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি, ধস এবং জীবনহানি হিমালয়ে প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর মানুষের খবরদারির আর এক উদাহরণ। অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে কী হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা এই লাগাতার বিপর্যয়গুলি। মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের এই সম্পর্কিত আদেশ যদি সফলভাবে কার্যকর করা যায় তাহলে আমাদের এই জটিল বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে।
পাহাড়ের উপর যেখানে সেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ, চারধাম অল ওয়েদার রোড নামে নির্দয়ভাবে একটি নবীন এবং ভঙ্গুর পর্বতমালা কেটে রাস্তা তৈরি, আইন না মেনে বহুতল তৈরি ইত্যাদির কারণে হিমালয়ের সহ্য শক্তি অতিক্রান্ত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, নানান অজুহাতে চারধাম প্রকল্পের জন্য কোনো ইআইএ করা হয়নি।
সিমলার প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র টিকেন্দ্র সিং পানওয়ারের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানা যায় যে, এক সময়ে ভূমিসংস্কারের ফলে সাধারণ কৃষক এবং বনবাসীদের জীবনে অনেকটাই সুরাহা হয়। এর ফলে টেকসই উন্নয়নের আবহ তৈরি হয়। কিন্তু উদারীকরণের যুগ শুরু হওয়ার পর পরিবেশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর আর্থিক সংস্কার পার্বত্য রাজ্যগুলিকে আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের নিজস্ব সম্পদ তৈরি করতে বাধ্য করা হয়। কী এই সম্পদ? বন, জল, পর্যটন এবং হিমালয়ের জিপসাম আহরণ করে সিমেন্ট উৎপাদন ইত্যাদি। এর সাথে ছিল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির দ্রুত নির্মাণ কাজ। ফলে প্রায়শই নদী এবং তাদের বাস্তুতন্ত্রের লাগাতার ক্ষতি হতে থাকে। এই সমস্ত কাজ করার আগে সঠিক ভূতাত্ত্বিক এবং পরিবেশের অভিঘাত মূল্যায়ন (ইআইএ) ছাড়াই পাহাড়ের উপর রাস্তাগুলি প্রশস্ত করা, জমির ব্যবহারের পরম্পরাগত পদ্ধতির পরিবর্তন করা, সিমেন্ট কারখানাগুলির সম্প্রসারণ এবং বেশি বেশি করে অর্থকরী ফসলের দিকে ঝোঁক পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে দেয়।
ধ্বংসলীলা ও চার-ধাম প্রকল্প
উত্তরাখণ্ডের চার-ধাম সড়ক প্রকল্প মোদি সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি এক্সপ্রেসওয়ে। প্রকল্পটি ১০ মিটার প্রশস্ত এবং যমুনেত্রী, গঙ্গোত্রী, বদ্রীনাথ ও কেদারনাথকে যুক্ত করছে। প্রকল্প এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনেক ক্ষেত্রেই নদীর ঢাল বরাবর শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্যের মধ্যদিয়ে তৈরি হচ্ছে। রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য নির্মমভাবে গাছপালা কেটে জীববৈচিত্র্য এবং আঞ্চলিক পরিবেশকে বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, ঢাল তৈরির জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে না। কোথাও কোথাও ঢাল থাকছে প্রায় ৭০ ডিগ্রিরও বেশি। নদীর ঢালের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে উদ্ভিদ আবরণের উপর কারণ, শিকড় মাটি ধরে রাখে। কিন্তু ধর্মের সুরার নেশা এতোটাই যে পরিবেশরক্ষার সাধারণ নিয়মগুলিকে অস্বীকার করে পাহাড়ে চলছে ধ্বংসলীলা।
'ডাউন টু আর্থ' পত্রিকায় সুনীল প্রসাদ লিখছেন যে, উদ্ভিদের আবরণ থাকলে বর্ষায় জলপ্রবাহের প্রতিরোধী শক্তি বৃদ্ধি পায়, জলের চাপ হ্রাস পায়, আর্দ্রতা শোষণ করে মাটির ভরের ওজন হ্রাস করে, মৃত্তিকা পৃষ্ঠের রান-অফ হ্রাস করে ইত্যাদি। এই পাহাড়ে সাধারণ অরণ্যের তুলনায় বিভিন্ন প্রজাতির বৃশ্চিকের পরিমাণ বেশি। উত্তরাখণ্ডে দুটি বিরল প্রজাতি সহ কমপক্ষে ১৭টি প্রজাতির বৃশ্চিক রয়েছে। এই প্রজাতিগুলির মৃত্তিকার খাদ্য-শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে কারণ সেগুলি পোকামাকড়ের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে পোকামাকড়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা কৃষির জন্য ক্ষতিকর। ইঁদুর, কাঠবিড়ালি এবং খরগোশের মতো ছোটো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আবাসস্থল ব্যাপকভাবে ক্ষতি হওয়ার ফলে এরা বিপদের মুখে এবং এদের জনসংখ্যা লাগাতার হ্রাস পাচ্ছে। সম্মিলিতভাবে এই সমস্ত কিছু হিমালয়ের ধারণ ক্ষমতার ক্ষয় করে দেবে।
এই বছরের বর্ষা মরসুমে আকস্মিকভাবে বন্যা হিমাচল প্রদেশে জীবন ও সম্পদ উভয়েরই অভূতপূর্ব ক্ষতি করেছে। মৃতের সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে, এবং আনুমানিক মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০,০০০ কোটি টাকা। এবছর উত্তরাখণ্ডে মৃতের সংখ্যা ১০। ডিজাস্টার মিটিগেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কেবল উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ৬০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক বৃষ্টিপাতের জন্য এই আকস্মিক বন্যা বলে কেউ কেউ বলছেন কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে মানব প্ররোচিত বিপর্যয়গুলি এই ধরনের বিশাল ক্ষতি ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।