৬১ বর্ষ ১০ সংখ্যা / ১৩ অক্টোবর, ২০২৩ / ২৫ আশ্বিন, ১৪৩০
পার্টি ও গণসংগঠনের সম্পর্কে মৌলিক ধারণা ও তার বাস্তবায়ন
(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
নৃপেন চৌধুরী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব - ২
গণফ্রন্ট পরিচালনায় পার্টির ভূমিকা
পার্টি প্রতিষ্ঠিত নিয়ম পার্টি গণসংগঠনগুলিকে পরিচালনা করবে সেই ফ্রন্টের পার্টি সাব-কমিটি/ফ্রাকশন/পার্টি টিম প্রভৃতির দ্বারা। পার্টি কমিটি সরাসরি গণসংগঠন সম্পর্কে নির্দেশ দেবে না। সম্মেলনের সময় ফ্রাকশন/সাব-কমিটি পরামর্শ সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট পার্টি কমিটি শুধুমাত্র সম্পাদক, সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। সাব-কমিটি এবং ফ্রাকশন কমিটি বাকি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যান্য পদাধিকারী নির্বাচন করার ক্ষেত্রে গণফ্রন্টের সাব-কমিটি, ফ্রাকশন ঠিক করবে এবং সেই স্তরের গণসংগঠনের বিদায়ী কমিটির অনুমোদন নিয়ে বিদায়ী কমিটির প্রস্তাব সম্মেলনে উপস্থিত করা এটাই প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। অনেক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। গণসংগঠনের কর্মকর্তামণ্ডলীর সদস্য কে হবেন সেই ক্ষেত্রে পার্টি হস্তক্ষেপ করবে না। এগুলি গণসংগঠনের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের পরিপন্থী।
সাধারণত ফ্রাকশন/সাব-কমিটির আহ্বায়ক ওই সংগঠনের সম্পাদকই হয়ে থাকেন। পার্টির পক্ষ থেকে সংিশ্লষ্ট কমিটির একজন সদস্য ওই সাব-কমিটি/ফ্রাকশন কমিটি/টিম দেখভাল করার দায়িত্বে থাকেন । আবার কোনো গণসংগঠনের রাজ্য, জেলা ও ব্লকস্তরের কমিটির ফ্রাকশন অর্থাৎ ওই কমিটির পার্টি সদস্যদের আহ্বায়ক ওই সংগঠনের সম্পাদক পার্টি সদস্য হয়ে থাকেন এটাই চিরাচরিত নিয়ম। ওই গণফ্রন্টের ফ্রাকশন কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে ওই গণফ্রন্টের কাজের দুর্বলতা, পার্টি সদস্যদের ভূমিকা, আন্দোলন সংগ্রামের পর্যালোচনা ও পার্টি সদস্যদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনিই উত্থাপন করতে পারবেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফ্রাকশন সভার সঙ্গে সঙ্গেও গণসংগঠনের কমিটির সভা করে ফ্রাকশনের সভার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিবদ্ধ করে নেওয়া হয়। কারণ কমিটির সভার সদস্য সবাই পার্টি সদস্য। বাস্তব হচ্ছে এটাই যে, রাজ্য থেকে অঞ্চল স্তর পর্যন্ত কমিটিগুলির সদস্য পার্টির নেতৃত্ব এবং পার্টি সদস্যের সিংহভাগ হয়ে গিয়েছে।
এইভাবেই গণসংগঠনগুলি পার্টি প্রসারিত অংশের পর্যবসিত হয়ে পড়ে। এটা গণসংগঠনের বৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ক্ষতি করেন।
The Kolkata plenum noted the continuing erroneous trend of the Party directly inter-vening in the running of mass organisations and asserted that this hampers their inde-pendent functioning and broadbasing them. The need to follow the 1981 snd 2004 documents of the party on mass organisation was reiterated by the Kolkata Plenum.
But violation of these two docoments continue even today. There are Party committees which insist on nominating all the committee members of the trade unions. The concerned fraction committee are not consulted and/or their opinion is not given due weight, before deciding the three major posts of the concerned union committees. Such tendencies strengthen the impression that the unions are only appendages of the Party, resulting in the alienation of common workers from the unions led by us.
এই ভুল ঝোঁকগুলির উৎস হচ্ছে পার্টি সংগঠন পরিচালনায় বিপ্লবী লক্ষ্য সম্পর্কে সর্বস্তরের পার্টি ইউনিটগুলির উপলব্ধির ঘাটতি এবং তারই প্রতিফলন ঘটে চলেছে পার্টি সদস্য যারা গণসংগঠনে কাজ করেন তাদের কাজের ধরনের উপর। এখন আমাদের কাজকর্মের ধরন এবং দৃষ্টিভঙ্গির বদল সর্বস্তরেই ঘটাতে হবে এবং তা ঘটাতে হবে উচ্চতর কমিটি থেকেই। “গণসংগঠনে আমাদের কাজকর্মের ধরন এবং দৃষ্টিভঙ্গির বদল শুরু হওয়া উচিত পার্টির উচ্চতম নেতৃত্ব থেকেই। যার উল্লেখ আছে ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে - “পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি কখনোই দাবি করতে পারে না যে ঐ ধরনের ঘাটতি শুধুমাত্র রাজ্য কমিটি ও তারও নিচুস্তরের মধ্যে রয়েছে। পার্টির মধ্যে গেঁথে যাওয়া ভ্ৰান্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভ্যাস বদলে কেন্দ্রীয় স্তরেও কোনো সংঘবদ্ধ উদ্যোগ বা ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করা হয়নি”। (গণসংগঠনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে - সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় গৃহীত, ২৯-৩১ অক্টোবর ২০০৪) তাহলে গণসংগঠন বিস্তারের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক ঝোঁকগুলির উৎসস্থল গণসংগঠন পরিচালনার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে উপলব্ধির ঘাটতি ও ভ্রান্ত অভ্যাস । এই ঘাটতি কাটানোর জন্য সংগঠিত ও ধারাবাহিক উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
কলকাতা প্লেনাম এই সমস্যার উৎসস্থল কি, কাজকর্মের ধরন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছে। গণসংগঠনের কাজের পর্যালোচনায় প্রায়ই বেরিয়ে আসে যে, সর্বস্তরের কমিটিগুলির কমিটি সভা হচ্ছে না। বিশেষ করে নিচুস্তরের কমিটিগুলির। অনেকক্ষেত্রে সম্মেলনের দিনের পর থেকে অনেকক্ষেত্রে কমিটির অনেক সদস্য কমিটি সভায় উপস্থিত হন না। এক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে -
(ক) কমিটির গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের অভাবে সদস্যরা উৎসাহ হারান। খোলামেলা আলোচনার অভাব এটা একটা কারণ। আমাদের মনে রাখা উচিত পার্টির গণতান্ত্রিক কার্যক্রম, গণতান্ত্রিক নীতির দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু গণসংগঠনগুলির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেই সংগঠনের গঠনতান্ত্রিক নিয়মকানুন ও লক্ষ্যের দ্বারা পরিচালিত হবে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পার্টির গণতান্ত্রিক কার্যধারা ও গণসংগঠনের কার্যধারার মধ্যে পার্থক্য আছে সেটা আমরা অনেকসময় ভুলে যাই। গণসংগঠনের কমিটিগুলি বসেই খোলামেলা আলোচনার ভিত্তিতে সংগঠন এবং আন্দোলন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। উপর থেকে পার্টির পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। নীতিগত প্রশ্নে অবশ্যই পার্টির ভূমিকা থাকবে।
বাস্তবক্ষেত্রে পার্টি সদস্যরা বা ওই এলাকার পার্টির নেতা গণসংগঠনের নেতৃত্বদায়ী সদস্য হয়ে থাকেন এবং তাদের কার্যধারার মধ্যে গণসংগঠন পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গিগত ভুল-ভ্রান্তি থাকে। তারা অনেক সময় গণসংগঠনের কমিটিগুলির সভাতে উপস্থিত থাকার বিষয়ে গুরুত্ব দেন না এবং পার্টি প্রদত্ত অন্য কাজে নিয়োজিত থাকেন। অনেকসময় তাদের কাজের ধারা গণসংগঠনের গণতান্ত্রিক কার্যধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়না। ফলে গণসংগঠনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কমিটির সব সদস্যদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে জড়তা থাকে। তাদের মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হয় না, ফলে তারা কমিটি সভায় উপস্থিত থাকার উৎসাহ হারান এবং সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন না। পার্টির বিভিন্ন দলিলে বলা হয়েছে পার্টির নেতৃত্ব যারা গণসংগঠনের মূল দায়িত্বে আছেন তাদের পার্টির কাজকর্ম কমিয়ে দিতে হবে। এই নির্দেশও যথাযথ কার্যকর হয় না ফলে গণসংগঠনের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংশ্লিষ্ট পার্টি কমিটিগুলিকে দায়িত্ব বন্টনের সময় বিষয়টি ভাবা দরকার।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার মূল বৈশিষ্ট্য ধর্ম ও জাত-পাতের ভিত্তিতে বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতির ফলে একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক ও জাত-পাতের মধ্যে দাঙ্গা ও বিভেদের রাজনীতি প্রসারিত হচ্ছে, গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ ও স্বৈরতান্ত্রিক ঝোঁকও বাড়ছে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং ক্রমে ক্রমে সংবিধানের উপর আক্রমণও কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, গ্রাম শহরে কাজের অভাব, গরিবের খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা প্রভৃতি বিষয়গুলি সর্বস্তরের প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে জ্বলন্ত সমস্যা সৃষ্টি করছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উপর অসন্তোষও বাড়ছে। পার্টির বৃত্তের বাইরে লক্ষ লক্ষ অসংগঠিত গরিব মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ বাড়ছে। তেমনই বামপন্থী গণসংগঠনগুলির কাজকে প্রসারিত করার সুযোগ এবং বিপ্লবী কাজকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও বেড়েছে।
উপরে বর্ণিত সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির মারফত ব্যাপক ভিত্তিতে গণসংগঠনগুলির বিস্তার ও শ্রেণি সংগঠনগুলির গণআন্দোলন বৃদ্ধি ও গড়ে তোলার বাস্তবতা রয়েছে। পার্টির ও গণসংগঠনগুলির যৌথ আন্দোলনের সুযোগও বেড়েছে। গণভিত্তি বাড়াতে হবে। আমাদের সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধির উপরই বিভিন্ন অংশের শোষিত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং আন্দোলনে শামিল করানোর মধ্য দিয়েই তা সম্ভব। এই প্রশ্নে গণসংগঠনগুলির গণচরিত্র ও গণতান্ত্রিক কার্যক্রম পার্টির রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। অতএব পার্টিকে গণসংগঠনগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে গণসংগ্রাম বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট গণসংগঠনের দাবিগুলি রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে জনগণকে সংগ্রামে টেনে নিয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি করে দেয়। গণসংগঠনের স্বাধীন কর্মসূচি সেই কারণেই প্রয়োজন। জনগণের জমায়েত বৃদ্ধি গণসংগঠনের স্বাধীনসত্তার প্রাথমিক ভিত্তি।
২৩তম পার্টি কংগ্রেস গণ লাইনের মাধ্যমে পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান দিয়েছে। সর্বঅংশের শোষিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই এইকাজ করা সম্ভব। এই ক্ষেত্রেও গণসংগঠনের কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমান এই পরিস্থিতির বিচারে গণসংগঠনগুলির মধ্যে যেসব পার্টি সদস্য কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট গণসংগঠনের ক্ষেত্রে তাদের কাজের ধারাকে উন্নত করার দাবি অবশ্যই সময়ের দাবি।
(সমাপ্ত)