৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯
তৃণমূল-বিজেপি’র ঘৃণ্য রাজনীতি রুখতে ঐক্য সম্প্রীতির মহামিছিলে শামিল অগণিত মানুষ
হুগলিতে সম্প্রীতির মহামিছিল। রয়েছেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্যসহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে কলকাতা মহানগরীর রাজপথ, হুগলির কোন্নগর থেকে উত্তরপাড়া এবং হাওড়ার বালিখাল থেকে পিলখানা অভিমুখী লাল পতাকার মহামিছিল জনস্রোতে উত্তাল হলো। ধর্মীয় উৎসবে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ঘটানোর অপচেষ্টা বন্ধ করতে; বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ৮ এপ্রিল কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের ডাকে পার্কসার্কাস থেকে ধর্মতলা,৯ এপ্রিল হুগলি এবং ১০ এপ্রিল হাওড়া জেলায় বিভিন্ন বামপন্থী দলের ডাকে তিনটি মহামিছিল সংগঠিত হয়। এই তিনটি মহামিছিল থেকেই শান্তি-সম্প্রীতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতাকে ধিক্কার জানানো হয়েছে।
একই সঙ্গে ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি যেভাবে কুৎসিত রাজনীতির মধ্যদিয়ে মানুষকে বিভাজিত করে হিংসার রাজনীতিতে মত্ত হয়েছে,তার প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেছে বামপন্থী দলগুলি। রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও এমন সম্প্রীতির মিছিল সংগঠিত করেছেন বামপন্থীরা।
রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন, গত ৩০ এপ্রিল আরএসএস-বিজেপি'র ডাকে রাম নবমীর মিছিলের নামে হাওড়ার শিবপুরে কীভাবে মিশ্র বসতি এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, হিংসা, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির আগ্নেয়াস্ত্র সহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে উন্মত্ত মিছিল করা সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের ছিল নির্বিকার ভূমিকা। হাওড়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২ এপ্রিল হুগলি জেলার রিষড়ার শ্রমিক অধ্যুষিত মিশ্র এলাকায় প্রায় একই রকমভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। হাওড়ার আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি হবার পরেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে রিষড়ায় ধর্মীয় মিছিল করতে দেওয়ার পিছনে কোনো গভীর অভিসন্ধি ছিল কিনা সেই প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়। এই সূত্রেই বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এই রাম নবমীর দিন রামের নামে মিছিলকে কেন্দ্র করে উত্তর দিনাজপুর জেলার ডালখোলায় শুধুমাত্র লুটপাট, সংঘর্ষের ঘটনাই ঘটেনি, একজনের প্রাণও গেছে। এই সমস্ত ঘটনার মধ্যদিয়ে এটাই প্রকট হয়ে উঠছে যে, তৃণমূলের শাসনে ওদেরই প্রশ্রয়ে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি কীভাবে রাজ্যে ক্রমশ শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে। একইভাবে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, রাজ্যের সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশ এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের সময়ে যা ছিল কল্পনারও অতীত।
তৃণমূল-বিজেপি তাদের কপট সহযোগিতামূলক রাজনীতির স্বার্থে এভাবে মানুষকে ভাগ করে মারাত্মক খেলায় মত্ত হলেও বামপন্থীরা মানুষের ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে রাস্তায় নেমেই প্রতিরোধের লড়াই জারি রেখেছেন। তাই সাম্প্রতিক তিনটি মহামিছিলই জনকল্লোলে উত্তাল হয়েছে। মিছিলগুলি থেকে সোচ্চারে আওয়াজ উঠেছে - ‘দাঙ্গা নয়, শান্তি চাই’; ‘বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নেই’; ‘রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে’ ইত্যাদি।
তবে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, হাওড়ায় ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র নিয়ে আরএসএস মদতপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদী বাহিনী প্রকাশ্যে মিছিলের নামে হিংস্র তাণ্ডব চালালেও, তা রুখতে পুলিশ প্রশাসনকে কোনো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। অথচ গত ১০ এপ্রিল সেই হাওড়াতেই যখন ঐক্য-সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা নিয়ে বামপন্থী দলগুলি মিছিল নিয়ে নির্দিষ্ট অভিমুখে যাত্রা করে, তখন মমতা সরকারের পুলিশ সেই মিছিল আটকাতে মারমুখী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, পুলিশ তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের মতো লাঠি দিয়ে মিছিলের সামনে থাকা ট্যাবলো গাড়ির কাঁচ ভাঙে। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তবুও সেদিন রোখা যায়নি মিছিল। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে কয়েকশো কর্মীকে নিয়ে পিলখানায় পৌঁছে যান মহম্মদ সেলিম। এদিকে সালকিয়া চৌরাস্তায় বসে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর নেতৃত্বে অবস্থান চালিয়ে যান বাকি মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা। সালকিয়ায় পুলিশের ধাক্কাধাক্কিতে মিছিলকারীদের অনেকেই আহত হন। বামপন্থীরা যাতে এখানে মিছিল করতে না পারে সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। ১৪৪ ধারাকে মেনে উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা বাদ দিয়েই মিছিলের কথা জানানো হয় পুলিশকে। তা সত্ত্বেও বামপন্থীদের মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ। তবে পুলিশের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন জেলার মানুষ।
এদিন হাওড়ার মিছিলে অংশ নেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, রবীন দেব, দেবব্রত ঘোষ, কল্লোল মজুমদার, দিলীপ ঘোষ, পরেশ পাল সহ বামফ্রন্ট ও অন্যান্য বামপন্থী দলের নেতৃবৃন্দ। পরে সালকিয়া চৌরাস্তা এবং পিলখানায় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
৯ এপ্রিল হুগলির কোন্নগর থেকে উত্তরপাড়া পর্যন্ত মিছিলে অংশ নেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, দেবব্রত ঘোষ, সিপিআই নেতা তিমির ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, আরএসপি নেতা মৃন্ময় সেনগুপ্ত, সিপি আই(এমএল) লিবারেশন নেতা কার্তিক পাল সহ এসইউসি(সি), আরসিপিআই, এমএফবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বলশেভিক পার্টি ইত্যাদি ১০টি বামপন্থী দলের অগণিত নেতা, কর্মী ও সমর্থক। এছাড়াও এদিনের এই মিছিলে বামপন্থী ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক, কর্মচারী ও শিক্ষকরা অংশ নেন। মিছিল শেষে উত্তরপাড়ার গৌরী সিনেমা হলের সামনে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নেতৃবৃন্দ।
৮ এপ্রিল কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের মিছিলে অংশ নেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, পার্টি নেতা নিরঞ্জন চ্যাটার্জি, কল্লোল মজুমদার, অনাদি সাহু, সিপিআই নেতা প্রবীর দেব, আরএসপি নেতা দেবাশিস মুখার্জি, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা জীবন সাহা, আরসিপিআই নেতা প্রবীর অধিকারী, এমএফবি নেতা আশিস চক্রবর্তী সহ বিভিন্ন দলের নেতা ও কর্মীরা। এই মিছিলে লাল পতাকা সহ বিভিন্ন দলের ব্যনার, ফেস্টুন নিয়ে অংশ নেন অসংখ্য মানুষ।
হাওড়ার বিক্ষোভ সমাবেশে বিমান বসু বলেছেন, এ রাজ্যে নানা ভাষা, ধর্মের মানুষের বাস। এই মাটিতে দাঙ্গাবাজদের ঠাঁই নেই। ধর্মের নামে বিভাজন মানুষের সর্বনাশ ঘটাবে। কাজেই আমাদের ঐক্য ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ধর্ম নিজ নিজ বিশ্বাসে, ধর্মস্থানে থাকুক। কিন্তু ধর্মকে রাস্তায় নামিয়ে অন্য ধর্মকে আক্রমণ করা চলবে না। তিনি বলেছেন, চাকরি চুরি, পাচার, সব কিছু থেকে নজর ঘোরাতে, মমতা ব্যানার্জি ইডি-সিবিআই থেকে বাঁচতে বাংলাকে জুয়ায় বাজি রেখেছে। আমরা বাংলার সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে বিনষ্ট হতে দেব না।
তৃণমূলের দুর্নীতি, অপশাসন এবং বিজেপি'র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে রুখতে এখন এই বার্তা নিয়েই রাজ্যজুড়ে লাল ঝান্ডার প্রতিরোধ, বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমশ দুর্বার হয়ে উঠছে।