৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯
চলছে হিসেব বুঝে নেবার প্রস্তুতি
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
জলপাইগুড়ি
১১ মার্চ সকালে যখন জলপাইগুড়িতে নামি তখন বিক্ষোভ চলছে আলুর বন্ড নিয়ে। চলছে অবরোধ। জেলার মাত্র ২০টা হিমঘরে যত আলু উৎপাদিত হয়েছে তা রাখা সম্ভব নয়। ফলে বন্ড নিয়ে টানাটানি। কালোবাজারির অভিযোগ। বন্ড দেওয়া শেষ হয়ে গেলেও বহু কৃষক বন্ড পাননি। ওইদিনই শিলিগুড়ির ভালুকগাড়ায় কৃষক সভার নেতৃত্বে চলছে আলুর দাম না পাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ। কৃষকসভার অভিযোগ, বন্ড নিয়ে কালোবাজারি চলছে। শিলিগুড়িতে পঞ্চায়েত ভোট না থাকায় সরকার আলুচাষিদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিচ্ছে না। যা হওয়া উচিত কমপক্ষে ১০ টাকা। অথচ সরকার সাড়ে ৬টাকা দর বেঁধে দিয়েছে। আর ওইদিনই প্রশাসন ব্যস্ত এপ্রিলের জি-২০ বৈঠকে আগত বিদেশি অতিথিদের চাঁদনি রাতে চা পাতা তোলা দেখানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে।
দোমোহনির মোড়ে চায়ের দোকানে তখনও জ্বলজ্বল করছে ডিএ-র দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটের ব্যানার। জোর আলোচনা চলছে ধর্মঘটের সাফল্য নিয়ে। বহিরাগতকে তাঁরা বিশেষ আমলই দিলেন না। বরং বেশ জোর গলাতেই কোনো কোনো জায়গায় ধর্মঘট প্রায় একশো শতাংশ সফল হয়েছে তার ধারাবিবরণী চলছিল। অনেকদিন মুখ বন্ধ করে রাখা মানুষ যে এবার মুখ খুলতে শুরু করেছেন সেই ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। বেশ সরস আলোচনা চলছিল নিয়োগ দুর্নীতি, আবাস যোজনার দুর্নীতি নিয়েও। ‘গ্রাম পঞ্চায়েতে গ্রামের মানুষেরই কোনো অধিকার নেই’ বলা তপন রায় জানিয়ে দিলেন, ‘তবে এবার ওইসব খেলা চলবে না। মানুষ এবার নিজের হিসেব ঠিক বুঝে নেবে।’
পঞ্চায়েত সমিতিতে এক বার এবং জেলা পরিষদে তিনবারের নির্বাচিত সদস্য হরিহর রায় বসুনিয়া জানালেন, গ্রামের মানুষের হাতে অধিকার পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে রাজ্যের প্রথম বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে। অথচ তৃণমূল সরকারের প্রথম দিন থেকেই পঞ্চায়েত থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেবার কাজ শুরু হয়। বিরোধীশূন্য করার কাজ শুরু হয়। জনপ্রতিনিধিদের যে গুরুত্ব ছিল তা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ময়নাগুড়ির পাঁচটি পঞ্চায়েতে বামেরা ক্ষমতা পেলেও পুলিশ দাঁড় করিয়ে সেখানে বামেদের বোর্ড করতে দেওয়া হয়নি। জেলা পরিষদে ৩৪টার মধ্যে মাত্র ৩টে পেয়েছিল তৃণমূল। তাও বোর্ড রাখা সম্ভব হয়নি। নির্বাচিত সদস্যদের ভয় দেখিয়ে দল বদলাতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১৮-তে কোনো ভোট করতেই দেওয়া হয়নি। এখন পঞ্চায়েত দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সবাই এখন করে খেতে ব্যস্ত। পঞ্চায়েতে এখন আমলাতন্ত্র চলছে। আমলার সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সংঘাত তৈরি হচ্ছে। এদেরকে না হটালে মানুষের পঞ্চায়েত তৈরি করা যাবে না। আমরা তা করবই। এবারের ভোটেই বুঝতে পারবেন।
জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি দীপ্তি দত্ত জানালেন, এখনকার পঞ্চায়েতে কোনো নিয়ম নেই। সব নিয়মই ‘চিফ মিনিস্টার’ ঠিক করেন। আমাদের সময় আমরা এক খাতের টাকা অন্য খাতে খরচ করার কথা ভাবতেই পারতাম না। এখন এসব জলভাত হয়ে গেছে। কোনো ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট নেই। টাকাপয়সার কোনো হিসেব নেই। গ্রামের প্রশাসন আর গ্রামের হাতে নেই। এমনকী যেদিন ভোট হয় সেদিনও গ্রামের মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়না। সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করা হয়। আইসি দাঁড়িয়ে থেকে ছাপ্পা ভোট করায়। যদিও পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে। এবারের ভোট অন্যরকম হবে। এখন মানুষ দলে দলে আমাদের সঙ্গে আসছেন। ভয়ভীতি অনেক কমেছে। মানুষের মনে তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে এত ক্ষোভ জমেছে যে মানুষ এবার বদল চাইছেন।
সিপিআই(এম)জেলা সম্পাদক সলিল আচার্য জানালেন, লড়াইটা রাজনৈতিক। এটা শুধু এলাকার উন্নয়নের বিষয় নয়। এর সঙ্গে রাজনীতিও আছে। আমরা বিকল্প তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কারণ বিকল্প তুলে না ধরতে পারলে শুধু দুটো দল খারাপ বললে হবে না। সময় এখন পালটেছে। আমরাও নিবিড় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। সময় পালটানোর প্রতিফলন ভোটের বাক্সে ফেলতে হবে।
জেলার মণ্ডলঘাট থেকে সন্ন্যাসীকাটা, মেটেলিহাট থেকে কুমলাই, মাগুরমারি থেকে মৌলানী - প্রায় সব জায়গাতেই সাধারণ মানুষের বক্তব্য একইরকম। গত সাত আট মাস ধরে জেলায় ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। যদিও পঞ্চায়েতের বাইরে হলুদের ওপর কালো রঙ দিয়ে উন্নয়নের খতিয়ান লেখা আছে। জানা গেল, ১০০ দিনের কাজে বকেয়া মজুরি প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। আলুচাষিদের বিক্ষোভ দিয়ে জলপাইগুড়ির লেখা শুরু করেছিলাম। তথ্য বলছে জেলার মাত্র ৮.৫ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। মাত্র ৫.৮ শতাংশ গ্রামে বীজকেন্দ্র আছে।
কোচবিহার
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলা কোচবিহার জুড়ে রাজনৈতিক ডামাডোল। একাধিক হেভিওয়েট দলবদল, রাশি রাশি দুর্নীতির অভিযোগ, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বিজেপি'র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পাশাপাশি চলে মিডিয়ার বাইনারি রক্ষার খেলা। যদিও লোকসভা বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বামশূন্য এই জেলায় নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চলছে বামেদের। অন্যদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে জেলায় বিজেপি'র প্রভাব শেষ কয়েকবছরের তুলনায় অনেকটাই কমেছে একথা স্বীকার করে নিচ্ছেন অনেকেই। যদিও শেষ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের হিসেবে জেলার ৯টি আসনের মধ্যে ৬টি আসন বিজেপি'র দখলে এবং ৩টি আসন তৃণমূলের দখলে।
কোচবিহার জেলার ১২টা ব্লকে মোট গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা ১২৮। জেলা পরিষদের আসন সংখ্যা ৩৪। রাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে জেলায় মোট জব কার্ডের সংখ্যা ৬.৬১ লক্ষ এবং মোট কর্মীর সংখ্যা ১২.৫৫ লক্ষ। যদিও সক্রিয় জব কার্ডের সংখ্যা ৫.৭৭ লক্ষ এবং সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ৮.৯৩। জেলায় ১০০ দিনের কাজ যে দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ তা এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট। শুধু তাই নয়। বিগত সময়ে ১০০ দিনের কাজে কর্মী সংখ্যা কমেছে ৩.৬২ লক্ষ এবং জব কার্ড কমেছে ৮৪ হাজার।
সরকারি তথ্য অনুসারেই ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে শ্রমদিবস তৈরি হয়েছে মাত্র ৭.৩২ লক্ষ। যেখানে ২০২১-২২ আর্থিক বছরে শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছিল ২৪৪.০৬ লক্ষ। সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে ১১ মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত কোচবিহার জেলায় ঘরপ্রতি কাজ পেয়েছেন মাত্র ১৯.০৮ দিন। ১০০ দিনের কাজে বকেয়া মজুরির পরিমাণও ১০০ কোটি টাকার বেশি বলেই অভিযোগ।
পার্টির জেলা সম্পাদক অনন্ত রায় জানালেন, গতবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট করতেই দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও সামান্য কিছু আসনে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা না হলেও আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা স্তরে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। ২৪৭০টি বুথ কমিটির মধ্যে ১৬০০ বুথ কমিটি তৈরি করা হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বামফ্রন্ট কমিটি তৈরি করা হয়েছে। বামফ্রন্টগতভাবে বৈঠক করা হয়েছে। বাস্তব সাংগঠনিক পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে প্রার্থী ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, জেলাপরিষদের আসনের ক্ষেত্রের দলগত শক্তির ভিত্তিতে প্রার্থী ঠিক করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দিক থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে দলবদল করে কেউ আমাদের দিকে এলেও তাদের প্রার্থী করা যাবেনা। সম্ভাব্য প্রার্থীও আমরা ভেবে রেখেছি। পরিবর্তনটা মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। তৃণমূলের প্রতি মানুষের ঘৃণাও ক্রমশ বাড়ছে। বিজেপি প্রকাশ্যে মিছিল জমায়েত খুব একটা করতে পারছে না। কিন্তু এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে বিজেপি'র একটা ভালো নেটওয়ার্ক আছে। যার মূলে আছে আরএসএস। কিন্তু মানুষ যদি আমাদের দিক থেকে ভরসা পায় তাহলে ওই প্রচার কাজে আসবে না। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।
জলপাইগুড়ি হোক বা কোচবিহার কিংবা আলিপুরদুয়ার। উত্তরবঙ্গের এই তিন জেলায় এবার অনেক আগে থেকেই কোমর বেঁধে জমি শক্ত করতে নেমেছে বামফ্রন্ট। বিগত নির্বাচনগুলোতে রাজ্যের মানুষের সামনে ভোট লুটের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে জোর কদমে চলছে ঘর গোছানোর কাছ। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিরোধের বার্তা। রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়লেও এখনও পর্যন্ত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়নি। তবে নির্বাচন যবেই ঘোষিত হোক না কেন, যে বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙার শপথ নিয়ে বাম আমলে রাজ্যের পঞ্চায়েতের যাত্রা শুরু, গ্রামের মাটিতে কান পাতলে সেই ডাক আবারও শোনা যাচ্ছে। মানুষের পঞ্চায়েত মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। লুটেরাদের হাত থেকে গ্রাম বাংলাকে রক্ষা করতে হবে।