৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯
পঞ্চায়েতে দুর্নীতিতে তৃণমূল-বিজেপি দোসর
বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষ
বিশ্বনাথ সিংহ
তৃণমূলের দুর্নীতি আজকাল রাজনৈতিক আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে। তার বড়ো কারণ হলো এর ব্যাপ্তি এবং গভীরতা। রাজ্যের এমন কোনো মানুষ নেই যিনি তৃণমূলের এই দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না। অথচ সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন যে তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দমবন্ধ পরিবেশ। মানুষের বুক ফাটছে অথচ মুখ খোলার সাহস হচ্ছে না। গ্রাম থেকে শহর চলছে লুম্পেনরাজ।
স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে, শিক্ষকের অভাবে ক্লাস হচ্ছে না। অভাব অনটনের মধ্য দিয়েও মা তাঁর সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন অথচ চাকরি নেই। পঞ্চায়েতে নিজের হক পাচ্ছেন না। ১০০ দিনের কাজ করে ন্যায্য মজুরি মিলছে না। কৃষক সুগন্ধি চাল উৎপাদন করে, তার ঘ্রাণ উপভোগ করছেন প্রতিবেশী তৃণমূল নেতার বাড়ি থেকে। একথাগুলো আনাচে কানাচে চলছে, বলছে তৃণমূলীরাই। অবশ্য এই দুর্নীতির কথাগুলিই কয়েকবছর ধরে লাগাতার বামপন্থীরা বলে চলেছেন। আর এখন মানুষ তার অভিজ্ঞতা যাচাই করতে পারছেন। এর ফলে গ্রাম শহরে বামেদের উত্থান হচ্ছে। ট্রেনে বাসে চায়ের দোকানে সর্বত্র একটাই কথা - ‘‘শতগুণে ভাল ছিল বামফ্রন্টের আমল’’।
হাটমনি গ্রামের দিলীপ ঘোষের কথাটা খুব আতঙ্কের হলেও খাঁটি সত্যি। রায়গঞ্জ ব্লকের বাহিন গ্রাম পঞ্চায়েতের একটা মাত্র মৌজা যার নাম বিপ্রডাঙ্গি। শুধুমাত্র সেই মৌজা থেকেই সরকারি চাকরির জন্যে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছে তৃণমূলীরা। এটাই বাস্তব ঘটনা, তবে এটাও সত্যি যে, এই গ্রাম থেকে এখনো কারও চাকরি হয়নি। বঞ্চিত যুবকের পরিবার সর্বস্বান্ত। পরিবারে ৪ জন পুরুষ এখন অভাব মেটাতে ভিন রাজ্যে গেছে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে। হন্যে হয়ে টাকার জন্যে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সামান্য কিছু মিলেছে। তবে এর বেশি আর কিছু বলতে গিয়ে চোখে মুখে ফুটে উঠছে আতঙ্কের ছাপ।
এটা শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই। ছন্দপতন ঘটলো পঞ্চায়েত ভোটের পরেই। ২০১৩ সালে জেলা পরিষদ দখল নিল বামফ্রন্ট। থমকে গেল দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। যদিও অল্প সময়ের জন্যে। নানান প্রলোভন। কোটি কোটি টাকা, বিলাসবহুল গাড়ি। বেদখল জেলা পরিষদ। সরকারি সার্কিট হাউসে প্রায় প্রতিদিন তৃণমূলের নেতৃত্বের কলকাতা থেকে আসা যাওয়া। প্রায় ডেইলি প্যাসেঞ্জার তৃণমূলের তৎকালীন ২ নম্বর নেতা সাংসদ মুকুল রায় এবং ৩ নম্বর নেতা শুভেন্দু অধিকারী। দুজনেই উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় দলের অবজারভার। তাদের হাত ধরে শুরু হলো গোপন কারবার। চোপড়ার অর্থনৈতিক বনিয়াদ চা বাগানে দেদার লুট শুরু হলো যা এখনো চলছে। পাঞ্জিপাড়ার চর্ম শিল্প মুখ থুবড়ে। পাট্টা পাওয়া জমি বেদখল হতে লাগল। জেলা পরিষদ বেদখলের পরে দুর্বল হলো বামপন্থীরা। সেই সুযোগে হাত পাকালো আরএসএস। গ্রাম গঞ্জে গজিয়ে উঠলো সরস্বতী, বিদ্যাসাগর, নেতাজি, সারদা, বিবেকানন্দ, রামমোহন ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ছোটো ছোটো স্কুল। মাত্র ৭ বছরে সংখ্যাটা প্রায় ২০০। সেই সব স্কুলে বিএড, ডি এড পাশ করা বেকার শিক্ষিত যুবকেরা ফ্যাকাল্টি। এখন রামনবমীর মিছিলে ছাত্র শিক্ষক অবিভাবকের ভিড়ে জমজমাট। ‘‘দাঙ্গা বাঁধাতে আসলে মাথা গুড়িয়ে দেব’’ এখন আর বলার সাহস কেউ দেখাবে না। ফলে অসীম সাহসে অবাধে ধর্মীয় রাজনীতির শেকড় পৌঁছে গেছে দিনাজপুরের জনপদে।
বিজেপি’র আধিপত্য শুরু আর পঞ্চায়েতে শুরু বেলাগাম দুর্নীতি। শীতগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতে ২৭ লক্ষ টাকার গাছ ছাগলে মুড়িয়ে খেয়েছে! লক্ষ লক্ষ টাকার সার মাটি দেওয়ার পরেও গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই! ১০০ দিনের প্রকল্পে গাছ লাগানো হলেও বাস্তবে নেই একটিও গাছও! এদিকে করণদিঘি ব্লকের বাজারগাও দোমহনা আলতাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পর শীতগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের চাঞ্চল্যকর খবরে শোরগোল পড়েছে। তথ্য জানার অধিকারে জানা গেছে, তৃণমূল পরিচালিত রায়গঞ্জ ব্লকের ৭নং শীতগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতে কাগজে কলমে ২৭ লক্ষ টাকার গাছ রোপণ করা হয়েছে, অথচ বাস্তবে একটিও গাছ নেই। অভিযোগ উঠেছে চারাগাছ রোপণই হয়নি। অথচ গাছ লাগাতে ২৭ লক্ষ টাকারও বেশি খরচ হয়ে গেছে বলছে! সত্যি খবর উঠে এসেছে সরকারি ওয়েবসাইটে।
এদিকে অস্তিত্ববিহীন পুকুর কাটার কাজে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ! তদন্ত হলো। পঞ্চায়েতের দুর্নীতির তদন্ত সাপেক্ষে দোষী সাব্যস্ত হলো। টাকা ফেরতের নিদান দিল জেলা প্রশাসন। এনআরইজিএস প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রধান ও পঞ্চায়েতের মেম্বাররা। মানুষের অভিযোগ প্রমাণিত। ঘটনা রায়গঞ্জ ব্লকের ২নং জগদীশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের। তাও আবার শিক্ষা দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী এলাকার প্রধান। শাস্তির বিধান দিল প্রশাসন। আত্মসাতের ৪ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা ফেরতের নির্দেশ জেলা প্রশাসনের। প্রশাসনের এই নির্দেশে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না অভিযোগকারীরা।
চোপড়া, বিন্দোল, দোমহনা, আলতাপুর, রানিগঞ্জ, গোয়াগাঁও ২, করণদিঘি গ্রাম পঞ্চায়েতে বিকোর গ্রামে অস্তিত্ববিহীন পুকুর খনন না করেই কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। রায়গঞ্জ ব্লকের জগদীশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানকে টাকা ফেরতের নিদান।
বামপন্থীদের দাবি টাকা ফেরত সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। পঞ্চায়েতের আইন মোতাবেক গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
একের পর এক তৃণমূলের দুর্নীতি যখনই সামনে আসছে, তখনই তাকে আড়াল করতে বিজেপি অন্য ইস্যুর জিগির তুলে মানুষের নজর ঘোড়াতে ব্যস্ত থাকছে। তৃণমূল আর দুর্নীতি এখন যেন সমার্থক শব্দ। বিজেপি আর তৃণমূল একে অন্যের পরিপূরক। লোক দেখানো নাটক চলছে। প্রধানমন্ত্রীর পাঞ্জাবির মাপ কত আমজনতা না জানলেও, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিত জানেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এই জেলায় খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে মাত্র ১৪.৭ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে। আর প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা এবং রাজ্য সরকারের সড়ক যোজনায় বাড়ি পেয়েছেন মাত্র ৩৫.১ শতাংশ পরিবার। বীজের কেন্দ্র আছে মাত্র ৫.২ শতাংশ পঞ্চায়েতে। বাস্তবে বঞ্চিত পরিবার এবং গ্রামের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
তাই নতুন বর্ষে নতুন বাংলা গড়তে হলে বিজেপি-কে তাড়াতে হবে, তৃণমূলকে হারাতে হবে - এই দাবি তুলে সিপিআই(এম) উত্তর দিনাজপুর জেলাজুড়ে আন্দোলন শুরু করেছে। এই দাবি জোরালো হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে।
তৃণমূলের দুর্নীতি আর অপশাসন এই সময়ের রাজনীতিতে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠায় গ্রাম বাংলা জুড়ে মানুষের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। আগামী পঞ্চায়েত ভোটে এরই প্রতিবিধানে জেলায় এখন মানুষও জোট বেঁধে তৈরি হচ্ছেন।
চা বাগান বেদখলের প্রতিবাদে বাগানের শ্রমিকদের পদযাত্রা শেষে লালবাজারে সভায় বক্তব্য রাখছেন জেলা বামফ্রন্ট আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক।