E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯

জেলাঃ নদীয়া

দুর্দশা থেকে মুক্তি চান নদীয়ার গ্রামীণ মানুষ

সুপ্রতীপ রায়


ভূমিকা

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় মধ্যবর্তী স্থানে ভাগীরথীর অববাহিকা অঞ্চলে নদীয়া জেলা অবস্থিত। জেলার প্রায় সমস্ত অংশেই গঙ্গা নদী ও তার শাখা প্রশাখা হতে উদ্ভূত বেলে দোঁয়াশ মাটি সমন্বয়ে গঠিত সমতলভূমি। এই জেলার প্রশাসনিক সদর কর্মকেন্দ্র জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত কৃষ্ণনগর। নদীয়া জেলা কৃষি প্রধান। কল্যাণী শিল্প প্রধান অঞ্চল হলেও সংগঠিত শিল্পগুলি ধারাবাহিকভাবে বন্ধ হয়ে চলেছে।

দেশভাগের সময় নদীয়া জেলা খণ্ডিত হয়। স্বাধীনতার সময় নদীয়া জেলার লোক সংখ্যা ছিল প্রায় সাত লক্ষ। ওই সময় জেলার চাষযোগ্য জমির সিংহভাগ ছিল বড়ো জমিদার ও জোতদারদের হাতে। দেশভাগের পর পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নদীয়াতে আসতে থাকেন। ১৯৬১ সালের মধ্যে নদীয়ার লোকসংখ্যা ১৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষের বেশিরভাগ ছিলেন কৃষিজীবী। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু সমস্যা এখানে তীব্র ছিল। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বামপন্থীরা।

স্বাধীনতার পর নদীয়া ছিল খাদ্যে ঘাটতি জেলা। খাদ্যের জন্য নির্ভর করতে হতো পাশের জেলা বর্ধমান ও হুগলির উপর। স্বাধীনতার পর এ জেলার ভাগচাষি, খেতমজুর, দিনমজুর এদের কাজ প্রায় ছিল না বললেই ছিল। ক্রয় করার ক্ষমতা ছিলনা। জল সেচের ব্যবস্থা প্রায় ছিলনা বললেই ছিল। ফলে কৃষি ছিল প্রকৃতি নির্ভর। ফলে খরা বা বন্যার সময় গ্রামের মানুষের কাজ থাকত না। তাই বেশিরভাগ মানুষের অর্ধাহার, অনাহার ছিল নিত্যসঙ্গী। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত নদীয়া জেলার বেশিরভাগ মানুষকে কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। বুভুক্ষু গ্রাম শহরের লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষকে অসহায়ভাবে দিন কাটাতে হয়েছে। নদীয়া জেলার উৎপাদিত খাদ্যে, নদীয়া জেলার মানুষদের ৩/৪ মাস চলত।

১৯৭৮ সালে নির্বাচিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অবস্থার পরিবর্তন ঘটালো।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালের নির্বাচিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা আগের অবস্থার পরিবর্তন ঘটালো। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিনীতি, কৃষিনীতি গ্রামজীবনের রূপান্তর ঘটালো। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ খাসজমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত খাসজমি বিলির পরিমাণ ১৭১১৫.৫৩৪ একর, পাট্টা প্রাপকের সংখ্যা ৭০৭১১ জন।

১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর কৃষিনীতি কৃষিক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন সূচিত করে। জমিতে সেচ ব্যবস্থা প্রসারিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের মধ্যেই ১৩৫২টি মৌজায় বিদ্যুদয়নের কাজ সম্পন্ন হয়। বামফ্রন্ট পরিচালিত নদীয়া জেলা পরিষদের উদ্যোগে সমস্ত মৌজাতে গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ সম্পন্ন হয়। এছাড়া কৃষকদের উৎপাদনবৃদ্ধির জন্য নানাভাবে সহায়তা করা হয়। একফসলা জমিগুলি দোফসলা, তিন ফসলাতে পরিণত হয়। এক সময়ের ফলে খাদ্যে ঘাটতি নদীয়া জেলা উদ্‌বৃত্তে পরিণত হয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ রাস্তার হাল ছিল খুবই করুণ এবং ১৯৭৮ সালের বন্যায় যেটুকু রাস্তা ছিল তাও ধ্বংস হয়। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামীণ রাস্তার প্রভূত উন্নতি হয়। কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প,জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প, গৃহ পুনর্নির্মাণ প্রকল্প, গ্রামীণ ভূমিহীন কর্মসংস্থান প্রকল্প ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের সময় নদীয়ার গ্রামগুলির পরিবর্তন ঘটে। কৃষির বৈচিত্র্যকরণ হয়।

নদীয়া জেলার গ্রামান্নোয়ন ও মানবোন্নয়ন বামফ্রন্ট পরিচালিত পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে ইতিহাস তৈরি হয়েছে। সর্বশিক্ষা অভিযানে নদীয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। গ্রামীণ শিক্ষার পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৬৫৯টি, সহায়ক ও সহায়িকার সংখ্যা ১৪২৬টি, শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫১,০১০, মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা ১০৩, সম্প্রসারক-সম্প্রসারিকার সংখ্যা মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে ছিল ৫৩৬ জন, মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৪৮৫০ জন। ২০১১-তে বামফ্রন্ট সরকার চলে যাবার আগে পর্যন্ত এই সংখ্যা বাড়তে থাকে।

সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি থেকে বিপুল মানুষ সহায়তা পান। ২০০৩ সাল পর্যন্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য চালু হওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডে চালু হওয়া উপভাক্তার সংখ্যা ছিল ৯২৪৫০ জন। ১০০ দিনের কাজে আলোচ্য সময়ে সাফল্য আসে।

স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গঠনে নদীয়া জেলা রাজ্যের মধ্যে অগ্রণী জেলায় পরিণত হয়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত ৩২ হাজার স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গঠিত হয়, ১৮৩ গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্লাস্টার কমিটি গঠিত হয়, ১৭টি ব্লকে ফেডারেশন গঠিত হয়, ৩০ হাজারেরও বেশি স্বরোজগারি বিভিন্ন পেশার দক্ষতা বাড়ানোর ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করে।

তৃণমূলের প্রতিহিংসার রাজনীতি বাধা সৃষ্টি করল গ্রামীণ উন্নয়নে

২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নদীয়া জেলা পরিষদে গরিষ্ঠতা অর্জন করে বামফ্রন্ট। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে এল। নির্বাচিত জেলা পরিষদকে কাজ করতে দেওয়া হলো না। পঞ্চায়েত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নদীয়া জেলা পরিষদের আর্থিক ক্ষমতা সরকারের নির্দেশে কেড়ে নিয়ে জেলা শাসকের কাছে দেওয়া হয়। ফলে জেলা পরিষদ এবং ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভিত্তিতে পরিকল্পনা রচনা, রূপায়ণ, জনগণের অংশগ্রহণ এবং উন্নয়ন প্রকল্প সবগুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২০১২ সালের ২৬ মার্চ জেলা পরিষদের সাধারণ সভা আহ্বান করা হয় বাজেট প্রস্তাবকে অনুমোদনের জন্য। জেলা পরিষদের সাধারণ সভায় অতীতে রাজ্য সরকারের কোনো অফিসারকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। কিন্তু ওইদিনের সভায় যুগ্মসচিব পর্যায়ের এক অফিসার উপস্থিত ছিলেন। জেলার রাষ্ট্রমন্ত্রী সভায় উপস্থিত না থেকে জেলা পরিষদ ভবনে উপস্থিত ছিলেন, সভায় বিরোধীদের পক্ষ থেকে বিতণ্ডা শুরু করে দেওয়া হয় যাতে বার্ষিক বাজেট পাশ না হয়। এর পরেই জেলা পরিষদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে জেলা শাসকের কাছে দেওয়া হয়। স্তব্ধ হয়ে পড়ে উন্নয়ন। চালু প্রকল্পগুলির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দখলদারি

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করা হয়। জেলা পরিষদ কেন্দ্রগুলির গণনার দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা এগিয়েছিলেন। তৃতীয় রাউন্ডের গণনায় বামফ্রন্টের গণনা প্রতিনিধিদের গণনাকেন্দ্র থেকে বার করে দিয়ে গণনাকেন্দ্র দখল নেয় তৃণমূলীরা। অবশ্য হাঁসখালি ব্লকের গণনা কেন্দ্র ভোর বেলাতেই তৃণমূলীরা দখল নেয়।

২০১৩ সাল থেকে নদীয়ার পঞ্চায়েতগুলি লুটের পঞ্চায়েতে পরিণত হয়। ২০১৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত হাঁসখালি ও রানাঘাট ব্লক ২-এর পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতাদের স্বাভাবিক কাজ করতে দেওয়া হয়নি।

দুর্দশা থেকে মুক্তি চান নদীয়ার গ্রামীণ মানুষ

এখন পঞ্চায়েতের লুটের ভাগ নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব। যা থেকে প্রাণহানি ঘটছে। কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস থেকে রামনগর-বড়চুপরিয়া ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের নেতা আমোদ আলির খুনের পিছনের কারণ পঞ্চায়েতের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব। আর লুটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার অপরাধে সিপিআই(এম) কর্মী দিনমজুর বাবুলাল বিশ্বাসকে খুন করা হয়। শাসক দলের এই সমস্ত দুর্নীতি, অবিচার, অপশাসনের বিরুদ্ধে এখন মানুষ এলাকায় এলাকায় জোট বাঁধছেন। এই লক্ষ্যে বুথে বুথে চলছে আলাপ আলোচনা আর প্রতিরোধ গড়ার কাজ। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের নামে শাসক দলের সন্ত্রাস আর ভোটলুটকে কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না তাঁরা। তাই এখন সবারই লক্ষ্য - নিজের নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দুর্নীতি-লুটের অবসান ঘটিয়ে মানুষের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠা করা।