E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯

তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় দুর্নীতি - ১


আমফান থেকে আবাস যোজনা, কয়লা থেকে করোনার কিট, পঞ্চায়েতের লুট থেকে গরু পাচার, নারদ থেকে নিয়োগ, সারদা থেকে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ (এসজেডিএ) - এই ধরনের বহু কেলেঙ্কারি পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে, ঘটে চলেছে ১২ বছরের তৃণমূল জমানায়। পাহাড় থেকে সাগর পর্যন্ত জালের মতো বিস্তৃত দুর্নীতি এরাজ্যে যেন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস একা নয়, পশ্চিমবঙ্গের এই দুর্নীতির সমবায় পরিচালনায় ‘সততার প্রতীকে’র দলের আপাতত অনুজ সহযোগী বিজেপি। কিন্তু বাংলার মানুষ এই জাল ছিঁড়তে চাইছেন। প্রতিকার চাইছেন। জীবন-জীবিকার সমস্ত ক্ষেত্রগ্রাসী এই দুর্নীতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে তাঁদের। তৃণমূল-বিজেপি এই প্রতিবাদী মানুষদের সাম্প্রদায়িক হিংসার কানা গলিতে ঠেলে দিয়ে আখের গোছাতে উন্মুখ। আর করপোরেট-রাজনীতিবিদ-আমলা-পুলিশের অবৈধ আঁতাতের চক্র ধান্দার ধনতন্ত্রে চিত্রনাট্য অনুযায়ী রাজনীতি সম্পর্কে অনীহায় অভ্যস্ত করতে চাইছে রাজ্যের মানুষদের। ভুলিয়ে দিতে চাইছে বামপন্থী বিকল্পের ও বিকেন্দ্রীকরণের পরিসরকে। এই প্রেক্ষাপটেই রাজ্যের গত এক যুগের দুর্নীতির ছবি তুলে ধরতে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন।

________________________________________

শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ) কেলেঙ্কারি

এসজেডিএ প্রকল্পে নয়ছয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সরকার বদলের পর ২০১১ সালের ২৫ জুন সংস্থার সভাপতি পদে তৃণমূলী বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যকে বসানো হয়। প্রকল্পের মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান নিকাশি পরিকাঠামো তৈরি করা, বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানোর কাজ, জোড়া পানি নদীর সংস্কারের কাজ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে শাসক দলের পান্ডারা কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরেছে বলে অভিযোগ। ই-টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পাসওয়ার্ড ফাঁস করার ঘটনায় বিপুল দুর্নীতি ও বেনিয়ম হয়েছে। সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবি করা হয়। অডিট রিপোর্টে কোটি কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা ধরা পড়ার পর প্রাক্তন সভাপতি রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যকে কমিটিতে রেখে সংস্থার সভাপতি পদে বসানো হয় তৃণমূলেরই মন্ত্রী গৌতম দেবকে।

শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার হিসেবে কে জয়রামন এই দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোচ্ছে। এই প্রকল্পের তৎকালীন কার্যনির্বাহী আধিকারিক আইএএস কিরণ কুমার গোদালাকে ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করে শিলিগুড়ি পুলিশ। তিনি তখন মালদহের জেলাশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমাদের রাজ্যে কোন কর্মরত জেলাশাসক এই প্রথম গ্রেফতার হয়। আশ্চর্যজনকভাবে ৩০ নভেম্বর বিকেলেই গোদালার সমর্থনে এগিয়ে আসেন স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। তিনি বলেন পুলিশ কমিশনার এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছেন। জানা যায়, গোদালাকে গ্রেফতারের অনুমতি বারবার চাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হচ্ছিল না। ঐদিনই শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়।

এর আগে চার দিনের জন্য গোদালার পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেছিলেন শিলিগুড়ি আদালতের এসিজেএম। কিন্তু কলকাতায় মুখ্যসচিবের ঘোষণার পর ১ ডিসেম্বর বিকেলে আবার বিশেষ আদালত বসে তার জামিন মঞ্জুর করে।

চিটফান্ড কেলেঙ্কারিঃ সারদা-রোজভ্যালি ও অন্যান্য সংস্থার প্রতারণা

২০১১ সালের পর থেকে প্রায় ১৭০০ টি সংস্থা প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি মূলত এরাজ্য সহ পুর্ব এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মানুষদের থেকে তুলে প্রতারণা করেছে। সর্বস্বান্ত করেছে ফেরত না দিয়ে। সারদা তুলেছে দশ হাজার কোটি টাকা আর রোজভ্যালি’র তোলা টাকার পরিমাণ অন্তত ৩০ হাজার কোটি। এই বিশাল কেলেঙ্কারি সূচনা থেকেই পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি প্রথম জানতে পারেন রাজ্যে চিটফান্ডের রমরমার জেরে প্রায় এক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তার এই মিথ্যে পরে ধরা পড়ে যায়। ২০১৩ সালের ৪ মে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে সারদা জালিয়াতি সংক্রান্ত হলফনামা জমা দিয়ে তৃণমূল সরকার জানায়, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ২০১২ সালের অক্টোবর মাসেই রাজ্যের অর্থ সচিবকে পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় চিটফান্ডের বিভিন্ন অসদুপায়ের অভিযোগের বিষয়ে সতর্ক করেছিল তখন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে? মমতা ব্যানার্জি।

সারদা সহ সমস্ত সংস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের টাকা ফেরত দিতে হবে, শাস্তি দিতে হবে এই মূল অগ্রাধিকারের জায়গায় না গিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে তিনি সমস্ত রাজ্যবাসীর ওপর বাড়তি কর বসিয়ে তহবিল তৈরি করেন, গঠন করেন একটি কমিশন।

২০১৩ সালেই সুপ্রিম কোর্টে চিটফান্ড কাণ্ডের টাকা উদ্ধার, দোষীদের শাস্তির দাবিতে জনস্বার্থ মামলা সংগঠিত করা হয় কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান এবং বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের উদ্যোগে। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্ত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরাও চেয়েছিলেন যে সিবিআই এই তদন্ত করুক। এর বিরোধিতা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সিবিআই তদন্ত রুখতে কোটি কোটি টাকা খরচা করে মামলায় অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ শুনানির পর সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালে রায় দেয় এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে সিবিআই। শীর্ষ আদালত সিবিআই-কে দেওয়া তদন্তের নির্দেশে বলেছিল, বৃহত্তর চক্রান্ত খুঁজে বার করতে এবং কারা বেনিফিশিয়ারি (সুবিধা প্রাপক) তাদের খুঁজে বার করতে হবে। এই তদন্তে গ্রেফতার হয় তৃণমূলের একাধিক সাংসদ থেকে মন্ত্রী। জিজ্ঞাসাবাদ জেরা করা হয় বহু নেতা, সাংসদ-মন্ত্রীকে।

আদালতে সিবিআই জানায়, সারদা রোজভ্যালি টাওয়ার গ্রুপ সহ আরো কয়েকটি চিটফান্ডের বিপুল টাকা লেনদেন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের সঙ্গে। সেই লেনদেনের তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। লক্ষণীয়ভাবে চেকের মাধ্যমে লেনদেনও হয়েছে। চিটফান্ড কাণ্ডে যোগসাজসের অভিযোগে রাজ্য পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কুনাল ঘোষ যিনি বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর দলের মুখপাত্র তিনি একাধিকবার বলেছেন, চিটফান্ড থেকে সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীর নাম মমতা ব্যানার্জি। ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত হবে, দোষীদের শাস্তি হবে, সে সবকিছু হয়নি। ২০১৯ সালেও একই কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

আমফানের ক্ষতিপূরণ কেলেঙ্কারি

ভুয়ো মাস্টাররোল দেখিয়ে টাকা তোলা, জব কার্ড হাতিয়ে নেওয়া, প্রকল্প না হলেও কাগজে-কলমে তা দেখিয়ে টাকা তোলা এসব রাজ্যের প্রতিটি জেলায় এখন স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমফানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে হুগলিতে দুর্নীতির কৌশলে তাক লেগে গেছে ক্ষুব্ধ মানুষের। হুগলির চণ্ডীতলা দু’নম্বর ব্লকের গরলগাছা গ্রামে আমফানের পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা তৈরি হওয়ার পর শুরু হয় হইচই। সেখানে শাসক ঘনিষ্ঠ থেকে পঞ্চায়েত প্রধানের স্ত্রী, আত্মীয় এমন অনেকেরই নাম রয়েছে। যাদের সকলেরই রয়েছে পাকা বাড়ি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় চোখ বোলালে দেখা যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নাম, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর, আইএফএস কোড নম্বর ভিন্ন হলেও সবার শেষ কলমে থাকা মোবাইল নম্বর ক্ষতিগ্রস্তদের সবার ক্ষেত্রেই আশ্চর্যজনকভাবে এক। জানা যায়, নম্বরটি গরলগাছা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূল নেতা মনোজ সিংহের। অর্থাৎ আমফানে ক্ষতিপূরণ হিসেবে যার অ্যাকাউন্টে সরকারের তরফে ২০ হাজার টাকা ঢুকবে, সেই মেসেজ এলার্ট যাবে তৃণমূল পঞ্চায়েত প্রধানের মোবাইলে। এই তালিকা কীভাবে অনুমোদিত হলো তার উত্তর নেই প্রশাসনের কাছেও। পরে প্রবল প্রতিক্রিয়ার মুখে প্রশাসন বাধ্য হয় সেই তালিকা বাতিল করতে। শোনা গেছে এই ‘মোবাইল নম্বর মডেল’ অন্য বেশ কয়েক জায়গায় চুরির ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।

________________________________________

শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ) কেলেঙ্কারি

আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ - প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

কীভাবে দুর্নীতি - ই-টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পাসওয়ার্ড ফাঁস করার পরপর ঘটনায় বিপুল দুর্নীতি ও বেনিয়ম হয়েছে।

মূল অভিযুক্ত এবং অন্যরা - তৎকালীন কার্যনির্বাহী আধিকারিক আইএএস কিরণ কুমার গোদালা ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর গ্রেফতার হন। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম কোনো কর্মরত জেলাশাসক (মালদহে দায়িত্বে ছিলেন) গ্রেফতার। সংস্থার সভাপতি তৃণমূলী বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কোর্ট।

পরিণতি - তদন্তকারী আধিকারিক শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার কে জয়রামন অপসারিত হন। ছাড়া পান কিরণ কুমার গোদালা।

চিটফান্ড কেলেঙ্কারিঃ সারদা-রোজভ্যালি ও অন্যান্য সংস্থার প্রতারণা

আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ - ১,৭০০টি সংস্থা প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা তোলে। সারদা দশ হাজার কোটি টাকা আর রোজভ্যালি’র তোলা টাকার পরিমাণ অন্তত ৩০ হাজার কোটি।রাজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১ কোটি মানুষ।

মূল অভিযুক্ত এবং অন্যরা - সুদীপ্ত সেন, গৌতম কুণ্ডু সহ চিট ফান্ড মালিকরা যারা অধিকাংশই জেলে বন্দি। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সময় জেল খেটেছেন কুনাল ঘোষ (৩৪ মাস), মদন মিত্র (৬২৯ দিন), সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (সাড়ে চার মাস), সৃঞ্জয় বসু (৭৫ দিন), তাপস পাল (১৩ মাস)।

অভিযোগ - চাপ দিয়ে টাকা আদায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, টাকা নয়ছয় এবং বেআইনি ভাবে আর্থিক সুবিধা নেওয়া।

আমফান ত্রাণ কেলেঙ্কারি

আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ - অভিযোগ, কয়েকশো কোটি টাকা লুট-নয়ছয় হয় এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ত্রাণ থেকে। সিএজি হিসেবের গরমিলের অভিযোগ আনে।