৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯
জমির অধিকার ও চাষে বৈচিত্রীকরণঃ আজকের বাস্তবতা
মলয়কুমার সামন্ত
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার - কৃষি বৈচিত্রীকরণের শুরু
পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পরবর্তীতে সিলিং বহির্ভূত জমির বণ্টন, বর্গাদারের অধিকার এবং ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত সঙ্গত এক শক্তিশালী প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক নির্ভর কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। রাজ্যের মোট জমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমির দখলে যায় ক্ষুদ্র কৃষক নির্ভর চাষবাস। ক্ষুদ্র জোতের চাষ নিবিড়তা, উৎপাদনশীলতা এবং চাষে ব্যয়-আয়, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জীবনে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনে। এমনকী ভূমিহীন খেতমজুররা এই পরিবর্তিত লাভজনক কৃষিব্যবস্থায় গ্রামেই স্থায়ী আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। সমসাময়িক সময়ের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা, দুর্বল অংশকে রক্ষা করার নীতিগত অবস্থান, নানা সামাজিক কর্মসংস্থান কর্মসূচি, সমবায় পরিকাঠামো এই পরিবর্তনে যোগ্য সঙ্গত করেছিল।
ক্ষুদ্র কৃষকের জমির মালিকানা পাওয়া বা স্থায়ীভাবে জমি চাষের অধিকার পাওয়া, কৃষকের নিজস্ব শ্রমশক্তি ও উদ্বোধনী ভাবনার প্রয়োগ এক নতুন মাত্রা পায়। গোষ্ঠী মালিকানা বা পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত জল সেচ, সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে বীজ ও রাসায়নিক সারের জোগান এবং মূলত ধানের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা, এইগুলি ক্ষুদ্র কৃষক নির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি হয়। পঞ্চায়েত পরিচালনায়, সমবায় গঠন ও পরিচালনায়, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের সংঘবদ্ধ অগ্রগতি হতে থাকে। গ্রাম্য শিক্ষিত, শ্রেণি সচেতন যুব অংশ এই ব্যবস্থার সাহায্যকারী হয়।
খাদ্যশস্য ছাড়াও ক্ষুদ্র জোতে ‘কাঠা ফসলের’ চাষ অর্থাৎ মূলত সবজির চাষ এক নতুন মাত্রা পায়। বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকেই রাজ্যের নানা প্রান্তে তা শুরু হয়, ক্রমশ ক্ষুদ্র জোতের চাষে সবজি চাষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতেই থাকে। আবার হুগলি, বর্ধমানে আলু, পেঁয়াজ; নদীয়া, হাওড়া, মেদিনীপুরে পান, ফুল; উত্তর দিনাজপুরে আনারস প্রভৃতির চাষও শুরু হয়। আবার গম, সরষে-তিল-বাদাম, ডালের চাষও নতুন মাত্রা পায় প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের হাত ধরে।
মুক্ত বাজার - অসহায় ছোটো জোতের চাষ
কৃষি বৈচিত্রীকরণের এই পর্যায়ে, নতুন ফসলের বাজারে চাহিদা, চাষের লাভ-ক্ষতির হিসাব, বীজ, সার, জলের জোগান ব্যবস্থা, রাজ্যে তৃতীয়-চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থান - সব মিলিয়ে পরিস্থিতি তখনও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের অনুকূলে ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে থাকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। উদারনীতির থাবা ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে এই ক্ষুদ্র কৃষক নির্ভর ব্যবস্থাকে। উৎপাদনের উপাদানের বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে, সরকারি অংশগ্রহণ কমতে থাকে। জল, বীজ, সার, কীটনাশকের দাম এবং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রাম এবং গ্রাম সংলগ্ন জনপদের বড়ো জমির মালিক বা অকৃষি কাজে যুক্ত ধনীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে। সমবায় বা পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। বৈচিত্রীকৃত নতুন ফসলের বীজ, নতুন ধরনের সার-কীটনাশকের দাম কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যেতে থাকে। আবার ছোটো জোতের সবজি বা নতুন ফসলের বিপণন প্রথম থেকেই বাজার নিয়ন্ত্রিত থাকায়, ফসলের দামে ক্রমশ মার খেতে থাকে কৃষক। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই এক কঠিন, অসম লড়াই লড়তে হয়েছে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে। জেলায় জেলায় ‘কাঠা ফসলের’ চাষ অর্থাৎ মূলত সবজি চাষের এলাকা কমতে থাকে। চাষ নিবিড়তা নিম্নগামী হতে থাকে। যদিও পঞ্চম এবং ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পরিস্থিতির অধোগতিতে কিছুটা রাশ টানা সম্ভব হয়েছিল। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গঠন, কৃষি উৎপাদন পরিকাঠামোয় তাদের অংশগ্রহণ, সমবায়ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা। সমবায়কে উৎপাদন উপাদানের ব্যবস্থায় উৎসাহ দেওয়া, সংরক্ষণ পরিকাঠামো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষকের অভাবী বিক্রিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পরিস্থিতির অনুকূল পরিবর্তন করতে পারেনি। উদারবাদী অর্থনীতির চাপ, উৎপাদন দ্রব্যের ক্রমশ দাম বৃদ্ধি, ফসলের লাভজনক দাম না পাওয়া - ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির বিপন্নতা বৃদ্ধি করেই চলছিল।
কৃষি বৈচিত্রীকরণ - কাদের হলো?
অন্যদিকে মাঝারি এবং বড়ো জোতের কৃষকরা এই সময়েই জমির চাষ নিবিড়তা বৃদ্ধি করতে পেরেছিল। আর্থিক সক্ষমতা, নতুন চাষে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, গ্রামীণ কৃষি ব্যবসায় বা অন্যান্য পরোক্ষ আয়ের সুযোগ নিতে পেরেছিল মাঝারি এবং বড়ো জোতের কৃষকরা। সাধারণ শস্য চাষ ছাড়াও নতুন কৃষি উদ্যোগের সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে থাকে এই গ্রামীণ বিত্তশালী অংশ। ফুল, ফলের চাষ, বাগিচা ফসলের চাষ, মাছচাষ ছাড়াও নানা কৃষি ব্যবসায় যুক্ত হতে থাকে এই অংশ। বাজার নির্ভর কৃষিব্যবস্থায় তারা একটু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। ফলত মাঝারি এবং বড়ো জোতের কৃষকদের প্রধান আয় হয়েছিল কৃষি বা কৃষি সংক্রান্ত অন্যান্য উদ্যোগে।
পশ্চিমবাংলায়, তৃণমূল দল মূলত এই মাঝারি ও বড়ো জোতের কৃষকের সমর্থন পাচ্ছিল। ভূমিসংস্কারের ফলে হাতছাড়া হওয়া জমি ফিরে পাবার গোপন বাসনা, নিত্যনতুন লাভজনক চাষের সুফলকে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার রূপ দেওয়া, উদার অর্থনীতির থেকে যে সুবিধাগুলো আসছিল, তা রক্ষা করতে গ্রামের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষমতায়নকে নষ্ট না করলে, এই পুরনো ভূস্বামী শ্রেণি যারা নব্য ধনী আকারে উঠে এসেছিলেন তাদের স্থায়ী ক্ষমতা পাওয়া হচ্ছিল না।
অপরদিকে, প্রান্তিক-ক্ষুদ্র জোতের চাষ ক্রমশ আরও অলাভজনক হওয়ায় এই অংশের বিপন্নতা বাড়াচ্ছিল। তৃণমূলসহ অন্যান্য সহযোগী শক্তি এই বিপন্নতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিল। ক্ষুদ্র কৃষকের জীবনের মূল প্রশ্ন - তাদের পাওয়া জমির অধিকার থাকবে কি থাকবে না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ক্ষুদ্র জোতের চাষ আবার মূলত খাদ্যশস্য-চাষ নির্ভর হতে থাকে। সবজি চাষ কমতে থাকে। নতুন বৈচিত্রীময় ফসলের উদ্যোগ প্রায় নষ্ট হতে থাকে। চাষ নিবিড়তা কমতে থাকে।
রাজ্যে তৃণমূলের সরকার - ক্ষুদ্র জোতের চাষের হালহকিকত
রাজ্যের ছোটো জোতের জমির চাষ যা মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় নব্বই শতাংশ, আরও অলাভজনক হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সংকুচিত হয়েছে, সমবায় ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত-ধান্দার পরিচালন ব্যবস্থায় ক্রমশ অকার্যকরী হয়েছে। চাষের জলের খরচ এবং সময়ে পাওয়ার নিশ্চয়তা ক্রমশ প্রাচীন প্রকৃতিনির্ভর অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প ধ্বংসপ্রায়। ছোটো জোতের মূল চাষ আমন ধান অলাভজনক। চাষি নিজস্ব শ্রমের মূল্যও পাচ্ছে না। সবজি, বোরো ধান, আলু, পেঁয়াজ প্রভৃতির চাষ পুঁজি নির্ভর, উৎপাদন উপাদানের খরচ লাগামছাড়া, প্রকৃতির অনিশ্চয়তা, এইসব ফসলে শস্য বিমা না থাকা, অনিশ্চিত বাজার, তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত ফড়েদের বাজার দখল এখনও টিকে থাকা ছোটো জোতের চাষ বৈচিত্র্যকেও অলাভজনক করে তুলেছে। ছোটো চাষি, তার তৈরি ধানের অভাবী বিক্রি করছে, সরকারি ধান কেনা ব্যবস্থা তৃণমূল-প্রশাসনিক দুর্নীতিগ্রস্ত অংশের দখলে। আবার বিকল্প চাষের ফসল, খোলাবাজারের যাঁতাকলে চাষের খরচ তুলে আনতেই পারছে না।
চাষ করে গরিব চাষির আর তাই দিন চলে না। বর্গার জমি চাষ আরও অলাভজনক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি জোতের উপরে নির্ভরশীল খেতমজুররা কাজ হারিয়েছেন। নানা অকৃষি ক্ষেত্রে অস্থায়ী কাজ, ব্যাপকভাবে পরিযায়ী শ্রমিকের জীবিকা - না হলে চরম দারিদ্র্য, আজ ক্ষুদ্র জোতের কৃষকের অসহায় আত্মসমর্পণ। অনিশ্চিত ২০-২৫ দিনের রেগার কাজ, পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের বাধ্যতামূলক কাজ খোঁজা, ছিটেফোঁটা সরকারি বদান্যতা আজ গ্রামের সিংহভাগ কৃষকের রোজনামচা। জমি এখন গরিব কৃষকের দায় - এমন ভাবনাকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হচ্ছে। বাংলার পরিশ্রমী, উদ্বোধনী শক্তিতে ভরপুর, উদ্যমী কৃষকরা আজ বিপিএলের চাল আর সরকারি দাননির্ভর হতে চলেছেন। সরকার চাষের উপাদানের খরচ কমায় না, নতুন ফসলের চাষ শেখায় না। মাটি-জল-প্রকৃতির রক্ষায় থাকে না। বাজারের দখল বড়োলোক মালিকের, না হলে ফড়েদের। বিপণন পরিকাঠামো যা ছিল, নষ্ট হয়েছে। বার্তা যা দেওয়ার ছিল, তাই হলো - ভূমিসংস্কারের পাওয়া জমি, ছোটো চাষির দখলে থাকা জমি চাষ অধিকার পরিবর্তন। জমি থাকবে কিন্তু চাষ থাকবে না। চাষ থাকলে, লাভ থাকবে না। জমি এখন চাষির সম্পদ নয়, জমি যেন গরিব চাষির দায়।
ফসলের এত বৈচিত্রীকরণ - কোন চাষির লাভ
২০১১ সালের পর মাঝারি এবং বড়ো জোতের কৃষকের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে, তার সুফল তুলছে তারা। চাষ নিবিড়তাভিত্তিক হিসাবে রাজ্যের জমির প্রায় পঁচিশ ভাগ তাদের দখলে। আর্থিক সক্ষমতা, প্রযুক্তির সুবিধা তাদের চাষকে এখনও লাভজনক রেখেছে। এখনও তাদের আয়ের মূল অংশ কৃষিকাজ। কৃষি উপাদানের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এই অংশের বেশি। নব্য ধনী এই কৃষকরা ঝুঁকি নির্ভর নতুন নতুন ফসল চাষের মাধ্যমে লাভ করছেন। বেশি জোতের, একসাথে বেশি উৎপাদনকে একসাথে বাজারজাত করার সুবিধা পাচ্ছেন। আবার পাশাপাশি ক্ষুদ্র জোতের কৃষকের জমি লিজ নিয়ে তারা চাষের এলাকা বাড়াচ্ছেন। কৃষি যন্ত্রপাতির প্রয়োগ হচ্ছে। এমনকী ‘চুক্তি চাষে’ যুক্ত হয়ে অনেক ক্ষেত্রে লাভজনক দাম পাচ্ছেন। রাজ্যের তৃণমূল সরকার ২০১৪ সালেই এই ‘চুক্তি চাষে’র আইনি স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে। আলু থেকে পেঁয়াজ, উত্তরবঙ্গের সমতলে চা বাগান বাড়ছে - ছোটো চাষির জমির লিজ দখলের মধ্য দিয়ে। পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় লোনা জলের ভেড়ি - সবই একই জমি দখলের কারবার। মাছ চাষ বাড়ছে, চা চাষ বাড়ছে, দিনাজপুরে গমের বদলে ভুট্টার চাষ, নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-২৪ পরগনায় কলা-আম-লিচুর চাষ। আবার কোথাও ড্রাগন ফ্রুট বা মালটা লেবুর চাষ - গল্পটায় গরিব চাষির নাম দলিলেই থাকছে। জমির চাষ দখল নিচ্ছে মাঝারি এবং বিত্তশালী বড়ো চাষিরা। আবার কিছু করপোরেট বা অতি বিত্তশালী শহুরে মুনাফাসন্ধানী কারবারিরা। এদের দালালের কাজ করছে গ্রামের তৃণমূলী সুযোগসন্ধানী ঘুষখোররা কিংবা আরও লাভের আশায় থাকা বড়োলোক চাষিরা। পঞ্চায়েত-প্রশাসন চালকরা ঘুষ আর কাটমানির লোভে এদের সুযোগ্য সঙ্গত করছে।
কৃষি বৈচিত্রীকরণ - জমির দখল - পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ ক্ষমতায়নের সম্ভাব্য পুনঃবিন্যাস
জমি সম্পর্ক, চাষ নির্ভর আয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম্য অর্থনীতিতে ধারাবাহিক প্রভাব রেখেছে। গ্রাম্য অর্থনীতি স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরির ভিত্তি হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার ও ভূমি আন্দোলন - ক্ষুদ্র কৃষক নির্ভর কৃষি অর্থনীতি, সাযুজ্যপূর্ণ ফসল বৈচিত্রীকরণ ও চাষের লাভ, প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা সৃষ্টি করেছিল। আবার একথাও বলা যায়, ২০০৭-২০০৮ সাল সময় থেকে ক্ষুদ্র জোতের অলাভজনক চাষ পরিস্থিতি, চাষ নিবিড়তার ক্রম হ্রাস এবং প্রতিক্রিয়াশীল তৃণমূল শক্তির কৃষককে জমির মালিকানা সম্পর্কে সন্দিহান করার অপচেষ্টাই - নতুন গ্রামীণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরি করেছিল। পুরনো জমির মালিকরা, যারা ভূমিসংস্কারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সুযোগের পূর্ণ সুবিধা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক অংশের ক্ষুদ্র জোতের অলাভজনক চাষ, আর্থিক অনিশ্চয়তা এই নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রধান সহায়ক হয়েছিল। এখানে অবশ্যই উল্লেখ প্রয়োজন, সমকালীন বামফ্রন্ট সরকারের অকৃষি ক্ষেত্রে গ্রামীণ শ্রমশক্তির ব্যবহার সন্ধান, রাজ্যে শিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে কৃষির উপর চাপ কমানোর প্রচেষ্টা অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। কাজবিহীন, আয়বিহীন গ্রামীণ শ্রমশক্তিকে তৃণমূলের মতো প্রতিক্রিয়াশীল দল ব্যবহার করে নিতে পেরেছিল।
আজকের সময়ে ক্ষুদ্র জোতের চাষির অলাভজনক চাষ আরও গভীর সংকটে। অকৃষি আয় ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু তার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। শিল্পনির্ভর শ্রম ব্যবহার, কৃষির উপর চাপ কমানোর কোনো পরিস্থিতিই নেই। জমি মালিকানা থাকলেও, জমির থেকে আয় নেই।
নিজস্ব শ্রমশক্তির বাধ্যতামূলক ব্যবহার করার জন্য শুধু জমি আছে, না হলে জমি থেকে কিছু পাবার নেই। এমনকী সম্পদ হিসাবেও গ্রাম্য জমির মূল্য কমছে। আবার মাঝারি আর বড়ো চাষিরা বৈচিত্রীকৃত নানা ফসল চাষ করে লাভ করছে। আশপাশের ছোটো জোতের বাধ্যতামূলক ‘খাজনা লিজ’ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ‘চুক্তি চাষ’ বাড়ছে। খাজনা জমি দখলে কিংবা চুক্তি চাষে স্থানীয় তৃণমূলীরা দালালের ভূমিকা নিচ্ছে। প্রয়োজনে লেঠেল বাহিনীর কাজ করছে। প্রান্তিক-ক্ষুদ্র জোতের কৃষক, বর্গাদার এবং মূলত এদের উপর নির্ভর খেতমজুররা নতুন জমি সম্পর্কে ক্রমশই হতদরিদ্র হচ্ছেন। ক্ষোভ বাড়ছে। লাভজনক চাষ, গ্রামীণ ক্ষমতায়ন, বহুমুখী চাষ - পুরনো কৃষি সম্পর্ক পুনরায় ভাবনায় আসছে। সব কৃষকই জানেন, জমির অধিকার কৃষকের মূল শক্তি। তৃণমূলী প্রতিক্রিয়ার প্রচার ভেদ করে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের নতুন অনুভূতি শোনা যাচ্ছে। সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভের প্রভাব বাড়ছে। বিকল্প কৃষিভাবনা, কৃষকের অধিকার, কৃষিভিত্তিক শিল্প, লাভজনক চাষ, জমির অধিকার, শিল্পের মাধ্যমে কৃষিতে চাপ কমানোর কথা আমাদের আবার প্রচারে আনতে হবে। সমবায় আন্দোলন, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ঋণ, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ, দায়িত্বশীল পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য ও প্রয়োজনীয় নীতি আলোচনায় আনতে হবে। নীতি কৃষকের বিরুদ্ধে হলে নীতি পরিবর্তনের লড়াই কৃষকদের যুক্ত করেই এই কাজ শুরু করতে হবে।
আবার এটাও বাস্তব, মাঝারি ও বড়ো কৃষকের একটা অংশও ক্রমশ সংকটে পড়ছেন। উৎপাদন খরচের ক্রম-দামবৃদ্ধি এবং অনিশ্চিত বাজার মূল্য - যা উদারবাদী অর্থনীতির অনিবার্য পরিণতি। তার প্রভাব সর্বগ্রাসী। এরা মূলত অসচ্ছল কৃষকে পরিণত হচ্ছেন। রাজ্যে অকৃষি আয়ও কমছে। কৃষকের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হলেও কর্মহীন থাকছে। পিছনে নিঃশ্বাস ফেলছে করপোরেট পুঁজির কৃষি। চুক্তি চাষ। পুঁজির স্বার্থে ফসল চাষ, জমির চরিত্রের পরিবর্তন। বিজেপি সরকারের প্রস্তাবিত কালা কৃষি আইন এই পরিস্থিতির আইনি রূপ দিতে চায়। জমির মালিকানা দৃশ্যত থাকলেও জমির কার্যকরী অধিকারের দখল হয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক থেকে বড়ো কৃষক। বড়ো কৃষক থেকে করপোরেটের চাষ। মাঝে স্থানীয় দালাল। তৃণমূলী ক্ষমতার মধুর ভাণ্ডার। উপযুক্ত সহযোগী পঞ্চায়েতের ক্ষমতা।
সময়ের দাবি তাই অনিবার্যতা হিসাবেই দেখা দিচ্ছে। প্রান্তিক-ক্ষুদ্র কৃষক, বর্গাদার থেকে অসচ্ছল মাঝারি কৃষক অলাভজনক চাষ, স্বল্প আয় এবং দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। জমি সম্পর্কের নতুন পরিবর্তন হচ্ছে। লুম্পেনদের দল নির্বিচার লুঠ চালাচ্ছে। নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক বিন্যাস, তাই অনিবার্য পরিণতি। যে পঞ্চায়েত এক সময়ের প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার ছিল, তা আজ তৃণমূলের দখলে। বড়ো চাষি, করপোরেট চাষ - চুক্তি চাষের দালালির যন্ত্র হয়েছে। তাই গ্রামের পরিবর্তনে পঞ্চায়েতের ক্ষমতার পরিবর্তন আনতে হবে। রাজ্যের প্রায় ৬০ লক্ষ প্রান্তিক গরিব চাষির স্বার্থেই আমাদের এ কাজ করতে হবে।