৬০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা / ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ / ৩০ চৈত্র, ১৪২৯
আক্রান্ত বাবাসাহেব আম্বেদকরের স্বপ্নের ভারত
আসুন তাকে ঐক্যবদ্ধভাবে রক্ষা করি
নীতীশ বিশ্বাস
আম্বেদকর যে ভারতে জন্মেছিলেন ১৩২ বছর আগের সে ভারতবর্ষ আজ ইতিহাস। কিন্তু সকলেই জানেন ইতিহাস বেয়ে বেঁচে থাকে মহামানবের দর্শন। আর দর্শন ও চিন্তনকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকেন সেই বিশ্ববিদ দার্শনিক মনীষী। বিপ্লবী। ভারতের নিপীড়িত মানুষের মানবিক সম্মান, গণতান্ত্রিক অধিকার আর সামাজিক ন্যায়ের উজ্জ্বল প্রবক্তা মহামতি বাবাসাহেব আম্বেদকর। সমকালকে অতিক্রম করে শতাব্দীর এপারে তাঁর কণ্ঠস্বর প্রতিনিয়ত আমাদের বলছে - ‘শিক্ষিত হও, সংগঠিত হও, আন্দোলন করো। তিনি হিন্দুধর্মের বর্ণবাদ বিষয়ে সেদিনই লিখেছিলেন - "Caste in the hands of orthodox has been a powerful weapon for persecuting the reformers and for killing all reforms. Caste is the monster that crosses your path. You cannot have political reform, you cannot have economic reform, unless you kill this monster."
এর প্রায় সত্তর বছর আগে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন, “The Indian Castes, those decisive impediments to Indian progress and Indian power." কালান্তর প্রবন্ধে প্রায় এরকম কথাই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ ভারতীয় বর্ণাশ্রম নামক অমানবিক বিধানই যে আমাদের জীবনে চরম অভিশাপ একথা এই সব মহা মনীষীর আলোকপাতেই পরিষ্কার। এই দার্শনিকেরা শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু আজকের প্রযুক্তি বিপ্লব বা কম্পিউটার বিপ্লব তাঁরা প্রত্যক্ষ করেননি। যে প্রযুক্তি আমাদের হাতে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ তুলে দিয়েছে। অমৃতত্ত্ব ছাড়া আজ প্রায় সবকিছুই মানুষের হাতে। দু-একটি মারণ অসুখ ছাড়া সভ্যতার অগ্রগমনে তেমন বাধা আর যেন নেই। তবুও শ্রেণি বিভক্ত সমাজ, সামন্তবাদী, ধনবাদী এবং করপোরেট নামক সাম্রাজ্যবাদী একঝাঁক নেকড়ের আগ্রাসনের সামনে আজ আমরা। তারই মাঝে সমবেত ব্রাত্য মানুষের সামাজিক মুক্তির স্বপ্নে, আমাদের প্রিয় শিক্ষক ডঃ আম্বেদকরের আরাধ্য এদেশের দলিত দরিদ্র মানুষকে নিয়ে, তাদের সমস্যা নিয়ে দু-একটি কথা আজকের নিবন্ধের মূল উদ্দিষ্ট।
আমাদের দেশ ইংরেজের শাসন থেকে মুক্ত হয় ১৯৪৭ সালে। কিন্তু সে তো কোনো জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীন বা মুক্ত হয়নি। শ্রেণি চরিত্র তার আধা সামন্ততান্ত্রিক আর আধা ধনতান্ত্রিক। সেই চরিত্রের সীমাবদ্ধতায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সেদিন সংবিধান প্রণয়নও গ্রহণ করা হয়। গ্রহণের দিন ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। এর আগে এ বিষয়ে শেষ গণপরিষদের সভায় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর বি আর আম্বেদকর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেন, "On January 26, 1950, we are going to enter into a life of contradictions. In politics we will have equality ...and in social and economic life we will have inequality. We must remove this contradiction at the earliest moment, or else those who suffer from inequality will blow up the structure of political democracy which this Assembly has so labouriously built up." (১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমরা এক বৈপরীত্যময় জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের থাকবে সমতা... আর অসমতা থাকবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আমাদের এই বৈপরীত্য দূর করতে হবে, নইলে, এই অসমতার যারা শিকার তারা, এত পরিশ্রম করে এই সংসদ যে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কাঠামো গড়ে তুলেছে তাকে উড়িয়ে দেবে।)
তা সত্ত্বেও এই সংবিধানই ভারতের নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের কাছে গণতান্ত্রিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়কে তুলে ধরে। আজও দলিত-দরিদ্র মানুষেরা যে অধিকার ভোগ করেন তার বিধান তিনি এ সংবিধানেই রেখেছিলেন।
আর এখানে একথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই জাতীয় নেতা। তাই তিনি ভারতের ঐক্য ও সংহতির ভাবনাকে যে দেশপ্রেমমূলক মনোভাব গঠনের ভিত্তিমূলে স্থাপন করেছিলেন, সেখানে ছিল বহু ভাবনা ও বহু সংস্কৃতির ভারতবর্ষ। কোনো একটি ধর্ম মত আর প্রদেশ ভাবনার স্থান সেখানে ছিল না। তাঁর ভাষায়, “I am of opinion that the most vital need of the day is to create among the mass of the people the sense of a common nationality the feeling not that they are Indians first and Hindus. Mahamedans or Sindhis and Kanarese afterwards but that they are Indian first and Indians last." তবে ভারতের যে ৮৫ভাগ শ্রমজীবী মানুষ এর রথের চাকা টেনে নিয়ে চলছেন, তাদের শোষণ ও লাঞ্ছনার মুক্তি ছিল তাঁর জীবন সাধনার ধ্রুববিন্দু। জীবনের পরতে পরতে যার জন্য তাঁকে নির্যাতিতও হতে হয়েছে বহুবার বহুভাবে সারা জীবন ধরে। ব্যক্তি জীবন থেকে তাঁর দার্শনিক জীবনের প্রতি মুহূর্তের তাই স্বপ্ন ছিল এই মনুষ্যেতর মানব প্রজাতিকে মানবিক মূল্য ফিরিয়ে দেবার। ভারতকে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ দেওয়া।
আম্বেদকর কাদা-জলের অন্ধকার থেকে নিজে উঠে এসেছেন এবং কোটি কোটি ভারতবাসীকে সেই অন্ধকার পঙ্ক থেকে আলোকধারায় স্নান করিয়ে শিক্ষিত করে, সংগঠিত করে তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করার ডাক দিয়েছেন। তাই তিনি পঙ্কজ। মুক্তির এক প্রতীকী সূর্য-শতদল। যার পাপড়িতে লেগে আছে কোটি জনতার বেদনার অশ্রুবিন্দু। যা তাকে একটি রাতের জন্যও ঘুমোতে দেয়নি। এজন্য একদিকে দলিত জনতার কাছে তিনি আজ যেমন সামাজিক মুক্তির প্রতীকী পতাকা, তেমনি প্রতিক্রিয়ার শক্তির আক্রমণেরও কেন্দ্রবিন্দু। তাই গুজরাটে তাঁর মূর্তি ১৯৯৯ সালে বিজেপি’র শাসনে এক বছরে ১১০০বার আক্রান্ত হয়। আর আমরা দেখলাম বিগত বছরগুলিতে যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন (ইউপিএ) সরকার বিশেষকরে তার মানব সম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রী অর্জুন সিং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উচ্চশিক্ষায় ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণ প্রয়োগ করতে গেলেন, তখন রে রে নেমে পড়ল ভারতের সমস্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশক্তি। আজকের দিনের ধর্মের নামে অধর্মের চক্রান্তকারী ধনবাদী ও বিদেশি মদতপুষ্ট করপোরেট শক্তির হাঙরদের সংস্কৃতির ভয়ানক চাপে দিকে দিকে অমানবিক মূল্যবোধ ও শ্রেণি শোষকের নিষ্ঠুরতা ফ্যাসিস্ত রূপধারণ করে সারাদেশে যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যারা যুগে যুগে গ্লাডিয়েটরদের খুন করেছে। প্রমিথিউসের কলজে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাইয়েছে ঈগলকে দিয়ে। এরা জিওর্দানো ব্রুনোকে নিষ্ঠুরভাবে লিঞ্চিং করে মেরেছে, কলহনের জিভ কেটেছে। আর এদের রাম শূদ্র শম্বুকের শিরোচ্ছেদ করেছে - একলব্যের আঙুল নিয়েছে। এই এরাই আজ এসেছে দলিত-দরিদ্রের উচ্চশিক্ষার অধিকার হরণের মারণ চক্রান্তে নয়া শিক্ষানীতির নামে। মাতৃভাষাহীন, আশাহীন এক গভীর বেকারত্বের অন্ধকারে ডুবিয়ে মারতে। তারা হাতিয়ার করতে চাইছে বহুজন সংস্কৃতির বিপরীতে এক ভাষা এক জাতি (ওদের চক্রান্তের ভাষায় এক জাতি মানে এক ধর্ম), এক নেতার সেই হিটলার মার্কা হুঙ্কারে। তার প্রতিবাদে আজ আমাদের চাই নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের এক মহান ভারতবোধ। যার বীজ অঙ্কুরিত করে গেছেন বাবা সাহেব তাঁর আন্দোলনে, তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামে আর তাঁর বহুত্ববাদী শান্তির ভারতবোধে। তাঁরই নানা শিক্ষা আর দীক্ষা আজ তাই ভারতের যুবচিত্তে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছে। সে হায়দরাবাদ থেকে কাশ্মীরে - আসমুদ্র হিমাচলে।
তাই আমরা দেখি আম্বেদকরের গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ভাবনার পাশে আজ ভারতের প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের প্রতিজ্ঞা আম্বেদকরের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ভূলুণ্ঠিত পতাকাকে তাঁরা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন। তাঁরা মনে করেন, সে পতাকা তুলে ধরার মহান দায়িত্ব নবযুগের বৈজ্ঞানিক সমাজবাদীদের। সেই শ্রেণি-ঐক্যের মহান ঘোষণা আমরা শুনতে পেলাম ভারতে বাম আন্দোলনের মুখ্য শক্তি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির কণ্ঠে ২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে এক মহতি সমাবেশে। তিনি বল্লেন, “এখন নীল আকাশে চাই লাল তারা। লাল সালাম আর জয় ভীম স্লোগানের সঙ্গেই চাই ইনকিলাব জিন্দাবাদ। কেননা তা ছাড়া মানুষের সমতা আসবে না।” অর্থাৎ আম্বেদকরের লড়াই মিশে গেছে কমিউনিস্টদের লড়াইয়ের সঙ্গে। শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে সামাজিক আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াই। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে বামপন্থী ছাত্রযুব নেতারা। যার মুখ্য নামটি অবশ্যই শহিদ রোহিত ভেমুলা আর তাদের আদর্শের অনুগামী সারা দেশের বাম সংগঠনগুলির আদর্শবান অগণিত সৈনিক।
শেষ কথাঃ আজ যখন রাজ্যে ও কেন্দ্রে সে দিনের স্বাধীনতার শত্রুরা তথা আরএসএস’র পুত্র কন্যারা কোমরে শাড়ি জড়িয়ে দলিত দরিদ্র মানুষের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ নামিয়ে আনছে। সারা রাজ্যকে দুর্নীতির পাঁকে নরকে পরিণত করছে, আর তাদের দিল্লির বন্ধুরা পদে পদে আম্বেদকরের স্বপ্নকে চুরমার করে দিচ্ছে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর ত্রিশূল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন আমাদের আম্বদকরের সংবিধান রক্ষা করাই সমস্ত গণতান্ত্রিক ভারতবাসীর এই সময়ের মহত্তম ডাক-অন্যতম কর্তব্য। বাবা সাহেবের জন্মদিনে সেই হোক আমাদের শপথ উচ্চারণ।